পাকমদতপুষ্ট জঙ্গিদের প্রত্যাঘাত করা জরুরি ছিল। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে প্রত্যাঘাত এবং দেশপ্রেম মানে কিন্তু যুদ্ধবাজ হয়ে যাওয়া নয়। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ যেভাবে যুদ্ধন্মোদনার জিগির তুলছেন তাতে মনে হচ্ছে আমরা ভারতবাসীরা যেন এক যুদ্ধবাজ জাতিতে পরিণত হয়েছি। ইতিহাসের শিক্ষা বলছে যুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোন উপকার হয়না, উপকার হয় শুধু মারণাস্ত্রের ফেরিওয়ালা যুদ্ধব্যবসায়ীদের। বাড়ে জিনিসের দাম, ব্যহত হয় উন্নয়ন আর কোল খালি হয় অসংখ্য মায়ের। মারা যান কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো ভাই বা বোন। মঙ্গলবার সকাল থেকে পাড়ার গলি থেকে শহরের রাজপথ, গ্রামের চায়ের দোকান থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধুই মুখোমুখি হচ্ছি �সমরবিশেষজ্ঞ�, বহু যুদ্ধের �অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোদ্ধা�, সবজান্তা দেশপ্রেমিক এবং একশ্রেণীর লেখক-সাংবাদিকদের। অক্লান্তভাবে তারা লিখে ও বলে চলেছেন নিজেদের মতামত। একটা পোর্টালে দেখলাম লেখা হয়েছে দেশের এই প্রত্যাঘাতের পূর্বাভাষ আগেই দিয়েছিলেন রাজ্যের বিজেপি নেতা জয় ব্যানার্জি। আরেক জায়গায় দেখলাম জানানো হয়েছে ভারত মুড়িমুড়কির মত বোমা ফেলেছে। যারা এই জাতীয় দাবি ও বিশ্লেষণ করছেন তারা কী নিজেরাই দেশপ্রেম ও সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের মর্যাদা বাড়াচ্ছেন? �
আমাদের সবারই ভেতরে ভেতরে যেন একইসঙ্গে একটা ভীরু মানুষ ও উগ্রপন্থী বাস করে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে আমার যখন কোন ক্ষতির ভয় নেই তখন আমরা� সবকিছু জ্বালিয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো মার্কা দেশপ্রেমী ও প্রতিবাদী হয়ে উঠি, আবার যখন প্রকৃত অর্থে রুখে দাঁড়ানো বা প্রতিবাদ করা দরকার তখন প্রতিবাদ না করে সরে আসি কারন, তাহলে আমি বিপদে পড়তে পারি। অর্থাৎ আমি আদ্যন্ত সুবিধাভোগী একটি প্রাণী, কোনকিছুর জন্যই আমি নূন্যতম মূল্য দিতে প্রস্তুত নই। রাস্তার ভিড়ে পকেটমার সন্দেহে একজন নিরীহকে পেটাতে আমি সবার আগে এগিয়ে যাই। আবার পাশের ফ্ল্যাটের আমাকে কাকু বলা কিশোরীটিকে যখন পাড়ার মাস্তানরা হেনস্থা করে তখন দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিই। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি দেশ ও দশের কোনরকম খোঁজখবর না রাখা আমার কিছু বন্ধুবান্ধবও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের এই ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাঘাতের পর ফাটিয়ে দিয়েছি মার্কা এই যুদ্ধন্মোদনার শিকার হয়ে আরও আগেই এই কাজ করা উচিৎ ছিল গোছের বিবৃতি দিচ্ছেন, জ্ঞান বিলোচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। �
আমি একজন সামান্য মানুষ। সাধারণ বুদ্ধিতে আমি যা বুঝি তাহল, যুদ্ধ অসংখ্য প্রাণ নেয়, ধ্বংস করে অর্থনীতি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, ব্যহত হয় সাধারণ মানুষের চলাফেরা ও জীবনযাপন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন যুদ্ধই মানুষের কোন উপকার করেনি। বরং ধ্বংস করেছে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষগুলিকে। প্রাণঘাতী যুদ্ধের জ্বালানির সবচেয়ে বেশি খোরাক হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ যুবছাত্রসম্প্রদায়। তাই যুদ্ধকে এড়িয়ে চলাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ এবং যে কোনরকম যুদ্ধবাজরাই সমাজ ও সভ্যতার শত্রু। এটা ঘটনা তবুও লাগাতার নানা প্ররোচনা ও উস্কানিমূলক মন্তব্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেটা সম্প্রতি হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্তব্যে।
আমার মতে নিজে একজন সফল খেলোয়াড় হয়েও একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন অখেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়েছেন ইমরান। পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদীদের হানার ব্যাপারে ভারত প্রতিবাদ জানানোর পর কোন ব্যবস্থা না নিয়ে পাল্টা আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন। ভারতে পাকমদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের কাজকর্ম সম্পর্কে বারবার জানানো সত্বেও তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি। সহনশীলতা মানে কাপুরুষতা নয়, তাই জঙ্গিদের ঘাঁটিতে আক্রমণ হয়েছে। প্ররোচনামূলক দেশপ্রেমের জিগির ভারতের এই অবস্থানটাকেই বিপন্ন করতে পারে। এই সরল সত্যটা রাস্তাঘাটে কাশ্মীরি পেটানো তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের বোঝাতে হবে। আমাদেরও বুঝতে হবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে থাকা এই হুজুগে দেশপ্রেমীরা মানুষের শত্রু। এদের জন্যই দেশের বদনাম হয়। এই দেশপ্রেমীদের জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতকে সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে।
মনে পড়ছে গুপীর গান রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরের দ্বন্দ্বে অমঙ্গল। ভারত ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের যুদ্ধে ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার নেই। তাই বিদ্বেষমূলক যুদ্ধন্মোদনা থেকে দূরে থাকাই ভাল। কিন্তু রাজনীতি এবং রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই পরিকল্পিতভাবে মানুষকে এর সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। খুব হিসেব করেই গুজব, মিথ্যা প্রচার, অতিরঞ্জিত ভাষণ, পরিসংখ্যান, বিকৃত ছবি, কার্টুন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ রব তোলা হয়। সেটা কিন্তু ইতিমধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে একটা সময় গিয়ে মানুষ তা বিশ্বাস করতেও শুরু করবে। তৈরি হবে বিশেষ কোন দেশ বা তার মানুষের সম্পর্কে একটা অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাতির মানুষদের প্রতি তৈরি হবে ঘৃণা ও হিংসা। তা উত্তেজনাকে উস্কে দিয়ে সন্ত্রাস ও পাল্টা আক্রমণ আরও বাড়িয়ে তুলবে। যারা এগুলো করে সেই রাজনীতি ও রাষ্ট্রনায়কদের এতে কোন ক্ষতি হয়না। এই ভ্রাতৃঘাতী হিংসার বলি হন আপনার আমার মত সাধারণ মানুষ। এরথেকে বড় অমঙ্গল আর কী আছে?
আমার একটা জিনিস ভালো লাগছে যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির হিংসাত্মক প্ররোচনা সত্বেও দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দল স্বাভাবিক দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছেন। জঙ্গি দমনে দেশের বায়ুসেনার ভূমিকার প্রশংসা করার পাশাপাশি ধর্মীয়বিদ্বেষ ও গুজব ছড়ানোর রাজনীতির বিরোধিতা করছেন তারা। সেনানায়কদের অঙ্গুলি হেলনে চলা পাকিস্তানের ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনীতির এটাই তফাৎ। হিংসা কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদের বদলে গান্ধী, বুদ্ধ, অশোকের চিন্তাধারাই আমাদের জাতীয় রাজনীতির মূল সুর। ভারতের সার্বভৌমত্বকে যারা বিপন্ন করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় কর্তব্য। কিন্তু আমরা যেন মহাত্মার অহিংসার আদর্শ থেকে দূরে সরে না যাই।
আমাদের বুঝতে হবে দেশ মানে দ্বেষ নয়, দেশপ্রেমের সঙ্গে হিংসার কোন সম্পর্ক নেই। হিংসা থেকে অনেক দূরে মানুষে মানুষে মৈত্রী ও ভালবাসার মধ্যে বেঁচে থাকেন আমাদের দেশমাতৃকা। এই দেশকে ভালবেসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধা থেকে শুরু করে সীমান্তের জওয়ানরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। দেশপ্রেমের নামে মেকি দেশপ্রেমিকদের হাতে দেশের পতাকাকে তুলে নিতে আমরা দেবো না। ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতিকে রুখতে এই মুহূর্তে আমাদের সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদে নামা দরকার। তবেই আমরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারবো।
জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত