‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।’
সত্যানন্দ দাশ সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। আসলে কুসুমকুমারী দাশের ঘরেই ছিল সেই ‘আদর্শ ছেলে’। গম্ভীর স্বল্পবাক। ডাকনামে ‘মিলু’ ছিলেন সত্যানন্দ দাশ ও কুসুমকুমারী দাশের জ্যেষ্ঠ সন্তান, জীবনানন্দ।
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য জীবনে আত্মপ্রকাশ ছিল ‘আধুনিকতা’ বহির্ভূত। ‘ব্রহ্মবাদী’তে প্রথম কবিতা প্রকাশের ছয় বছর পর ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ শীর্ষক তিন পর্বের একটি গদ্য রচনা প্রকাশিত হয়। যদিও এ ছ’ বছর জীবনানন্দ নিশ্চুপ ছিলেন নিভৃতে। কিন্তু এর পর থেকে শুরু হয় তাঁর প্রকৃত কাব্যচর্চা। মূলত ১৯২৬ সাল থেকে তিনি দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত ‘কল্লোল’, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুরলীধর বসু ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কালি-কলম’, বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা প্রকাশ শুরু করেন। এ সময়ে তাঁর যেসকল কবিতা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেগুলোর মধ্যে ‘নিলিমা’, ‘পতিতা’, ‘খুশ্-রোজী’, ‘পাখিরা’, ‘শকুন’, ‘বনলতা সেন’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’, ‘হায় চিল’, ‘বেড়াল’, ‘’ক্যাম্পে, ‘হাওয়ার রাত’, ‘সমারূঢ়’, ‘আকাশলীনা’ ও ‘আট বছর আগের একদিন’ অন্যতম ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনানন্দ প্রশংসনীয় ছিলেন সবার কাছে। ‘নীলিমা’ কবিতাটি কল্লোলে প্রকাশের পর দীনেশরঞ্জন লিখেছিলেন, “কল্লোলের তৃতীয় বৎসরে কয়েকজন লেখককে (বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত ও অন্যান্য) বিশেষভাবে পাওয়া গেছে। তাদের প্রতিভা জয়যুক্ত হোক”। তন্মধ্যে ১৯২৮ সালে ‘শনিবারের চিঠি’ নামক পত্রিকাটি জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি নিয়ে একটি আপত্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পত্রিকার ‘সংবাদ সাহিত্য’ অংশে সজনীকান্ত দাস ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটিকে অশালীন-অশ্লীল হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা করেন।
জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় ‘কবি’ খ্যাতি সাহিত্যদর্পনে প্রকাশ পেলেও ততোটা খ্যাতি অর্জিত হয় নি, যা বর্তমান তাঁকে দিয়েছে। কেননা তৎকালের সমগ্র বাংলা সাহিত্য ছিল একমুখী, রবীন্দ্র নির্ভর। ফলে রবীন্দ্রের সাহিত্যধারাকে বর্জন করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব, তা মেনে নিতে পারেন নি তৎকালীন অনেক কবি-সাহিত্যিক। কিন্তু যে নবীনের দল সূচনা করলেন রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্য এবং যাঁরা মেনে নিলেন তাঁদের সাহিত্যকর্ম, তাঁরা খুঁজে পেলেন এক নতুন পথ; এক নতুন যুগ। যা বাংলা সাহিত্যে ‘আধুনিক যুগ’ বলে পরিচিত।
যদিও জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রাণপুরুষ হিশেবে পরিচিত, কিন্তু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে আধুনিকতার স্পর্শ ছিল না। ১৯২৭ সালে ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়। যা ছিল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) ও কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য রণনে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘প্রথম দিকের কবিতায় তিনি [জীবনানন্দ] রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন দত্তের অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন প্রাণপনে’। সেইসময় কল্লোলে সুকুমার সেন তাঁর কাব্যের সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ‘ঝরা পালক এর একটি কবিতায় (পলাতক) দ্বিতীয়-তৃতীয় দশাব্দসুলভ পল্লী-রোমান্সের-অর্থাৎ করুণানিধান-যতীন্দ্রমোহন-কুমুদরঞ্জন-কালিদাস-শরৎচন্দ্র প্রভৃতি কবি ও গল্পলেখকের অনুশীলিত- ছবি পাই।’ তবে কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫) জীবনানন্দের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছিলেন,
‘বর্তমান যুগে তরুণরা যাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলে মনে করেন, সেই জীবনানন্দ দাশ একদিন তাঁর ঝরা পালক নামক বইখানি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। সেই বইয়ের কবিতাগুলিতে তাঁর প্রতিভার অঙ্কুরের পরিচয় পেয়েছিলাম।’
জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। মূলত এতেই প্রথম ব্যাপকাকারে আধুনিকতার স্ফুরণ ঘটে তাঁর। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রে তিনি লিখিছিলেন দীর্ঘ একেকটি কবিতা। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেন নি।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থের সবগুলো কবিতাই তাঁর জীবৎকালে অপ্রকাশিত ছিল। এবং মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ এবং ‘রূপসী বাংলা’র মধ্যে এক নিগূড় যোগসূত্র রয়েছে। এখানে কবির গভীর স্বদেশপ্রীতি এবং ব্যক্তিগত প্রেমময় স্মৃতি প্রকটে প্রকাশ পায়। এছাড়া গ্রাম-বাংলার আবহমান প্রকৃতির সুচারু বর্ণনায় কবি ব্যবহার করেছেন কিছু প্রাচীন মিথ এবং প্রতীক। অবশ্য মৃত্যুকেও তিনি বিলাস-বাসনা হিসেবে খুঁজে নিয়েছেন প্রকৃতির মাঝে, এই কাব্যে।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ ‘কাক ও কোকিল’-কে অবিনশ্বর ও প্রবাহমানতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
জীবনানন্দের দাশের সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’-এর সংস্করণ দুটি। প্রথমটি ১৯৪২ সালে কবিতাভবন সংস্করণ এবং এর দশ বছর পর সিগনেট প্রেস-সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দের সময়বোধের নতুন ধারণা গভীরভাবে লক্ষনীয়। পূর্বের দুটি কাব্যগ্রন্থে ‘ঝরা পালক’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, তিনি ইতিহাসকে লুকিয়ে রেখেছিলেন মৃত্যুবিলাসের মধ্যে। কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এ এসে তিনি অকপটে প্রকাশ করেছেন ইতিহাস ও কালসচেতনতা।
উল্লেখ্য ১৯০৫ সালের দিকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর Special theory of relativity প্রকাশের পর শুধুমাত্র বিজ্ঞান সমাজে নয়, কবি-সমাজেও এক নিরব হৈচৈ পড়ে যায়। কারণ কবিতা লেখার উপকরণ হিসেবে ‘সময়’ বা ‘কাল’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেক্ষেত্রে আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রমাণ করেছে আমাদের চিরচেনা ত্রিমাত্রিক জগৎ আসলে ত্রিমাত্রিক নয়; প্রকৃতপক্ষে ‘সময়’ও এর সাথে যুক্ত আছে। অর্থাৎ ‘সময়’ সহ আমাদের জগৎটি চতুর্মাত্রিক। এর ফলে শিল্প-সাহিত্যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়; যা ‘subjective and relative reality’ দ্বারা নির্ধারিত।
১৯৪৪ সালে জীবনানন্দ দাশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশিত হয়। অবশ্য এই গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা (নিরালোকে, প্রেম অপ্রেমের কবিতা, আট বছর আগের একদিন) ১৯৩৪ সালের দিক থেকে চতুরঙ্গ, কবিতা ও অন্যান্য বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৩০ সালের দিকে পৃথিবী আক্রান্ত হয় দুর্ভিক্ষে। এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল পাশ্চাত্যের দেশগুলো। অর্থাভাব, কর্মহীনতা, বেকারত্ব ইত্যাদি নৈর্ব্যক্তিক সামাজিক অবক্ষয় প্রকট আকারে ধরা পড়ে দেশগুলোতে। এবং তার প্রভাব পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশে। মানুষ স্বাভাবিক জীবনপ্রণালী থেকে বিচ্ছিন্ন বিচ্যুত হয়ে বেছে নেয় আত্মহনন। অথবা দীর্ঘ ক্লান্তি-হতাশা-অবসাদ এসে ভর করে অসহায় নিষ্প্রাণ জীবনগুলোতে। ফলে এ সবকিছুই প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে তৎকালের সাহিত্যে; কবিতায়। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি সম্ভবত ‘বনলতা সেন’ এর পরে সার্বাধিক পঠিত। এই কবিতার নায়ক, যিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ, এক দীর্ঘ দুঃসহ ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে।
প্রয়াণ দিবসে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে টুইট করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। লিখেছেন,” কবি জীবনানন্দ দাসের প্রয়াণ দিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য। ওনার লেখা কাব্যগ্রন্থ রূপসী বাংলার নামে আমি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন একটি ট্রেনের নাম রাখি।”