টুং করে একটি শব্দ।
স্মার্ট ফোনটা জ্বলজ্বল করে উঠল। টুং মানেই নোটিফিকেশন। হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুকে বার্তা এসেছে। রকমারি মিষ্টি আর সঙ্গে লেখা ‘শুভ বিজয়া’। হোয়াটস অ্যাপের ওয়ালে এমন ছবি দেখে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়তেই হয়। টাইম মেশিনে চেপে পৌঁছে যেতে হয় কৈশোরে – পুজোর আগেই .বাড়ির বড়দের হুকুম মতো ডাকঘরে যেতে হত। কিনতে হত বেশ কিছু পোস্টকার্ড ও খাম। সাকুল্যে দু’পয়সা থেকে বেড়ে ৫ টাকা পর্যন্ত। খামের দাম ছিল পাঁচ পয়সা। পরে বেড়ে ৫০ পয়সা। দশমীর দিন থেকে লেখা শুরু হয়ে যেত বিজয়ার প্রণাম, স্নেহ, শুভেচ্ছার চিঠি।
এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ২-৩ দিন ধরে বিজয়া করার জন্য ছোটদের দল থাকত। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড়দের প্রণাম করত তারা। মিলত কপালে চুমু। সঙ্গে কোচর ভরে নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারপর চলত বড়দের ফরমাস মতো চিঠি লেখা।বিজয়ার চিঠি। তাতেই প্রণাম, তাতেই শুভেচ্ছা, তাতেই স্নেহ-ভালবাসা জানানো। তার পর কয়েক দিন ধরে পাল্টা শারদ-শুভেচ্ছা বহণ করে পোস্টকার্ড এসে ভরিয়ে দিত ডাক বাক্স।
চক-ইসলামপুর শ্রীকৃষ্ণ চম্পালাল মাহেশ্বরী হাইস্কুলের গ্রন্থগারিকের দায়িত্ব থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক বিশ্বাসের অভিজ্ঞতাও একইরকমের। তাঁর শৈশব কেটেছে নওদা থানা এলাকার সফদরনগর গ্রামে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের বিজয়ার সঙ্গে পোস্টকার্ড সংস্কৃতি ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। এ বাডি, সে বাড়ি গিয়ে প্রণাম ও
কোলাকুলি তো ছিলই। কিন্তু যাঁরা বহু দূরে থাকতেন তাঁদের জন্য হাতে লেখা চিঠিই ছিল এক মাত্র ভরসা।‘
দীপকবাবুর জ্যাঠামশায়, জেঠিমা থাকতেন কলকাতায়। দীপকবাবু বলেন, ‘আমার মা-বাবা পুজোর প্রণাম চিঠিতেই সারতেন। জ্যাঠামশায়, জেঠিমার কাছ থেকে বিজয়ার আশীর্বাদ পেতে বাড়িতে পোস্ট অফিসের পিওনের আগমনের দিকে চেয়ে থাকতেন বাবা-মা’। সেই চিঠি আদানপ্রদান নিয়ে বিজয়ার কয়েকদিন প্রতিবেশীদের মধ্যেও বেশ চর্চা ছিল। কার বাড়িতে চিঠি এসেছে, এলে কে কার কি খবর নিয়েছে, কার বাড়িতে আসেনি – দশমী অন্তে সেই প্রলম্বিত চর্চা চলতই।
তারপর একে একে এল ফোন তারও পরে মোবাইল, আর এখন – প্রৌঢ়ের কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
এখন সেই প্রযুক্তির হাত ধরেই প্রণাম নেন ওঁরা। চিঠি হারিয়েছে, এখন ওই ফোনেই কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। এ ভাবেই অতীতের উঠোনে জাঁকিয়ে বসে বর্তমান। টেলিফোন তো কোন ছাড়, স্মার্ট ফোনের দৌলতে এখন তো মহালয়া থেকে বিজয়া সবেরই ভরসা ওই সব উজ্জ্বল টুংটাং। এক বৃদ্ধের কথায়, ‘হারানো ইনল্যান্ডের জায়গাটা তো ওই ফোনের দখলেই চলে গিয়েছে’।সঙ্গে রয়েছে রাবন নিধন, মহিষাসুর বধ, পুজো ও ঢাকের বাদ্যির ‘মুভি’, হাজার কিসিমের ছড়া স্টিল ছবি।
তবে হোয়াটসঅ্যাপে উড়ে আসা একটি পোস্ট মন ভাল করে দিয়েছে এই প্রৌঢ়দের – বিজয়ার সঙ্গে এভাবে মিষ্টি পাঠাবেন না প্লিজ। মোবাইলে পিঁপড়ের পাল ঢুকে পড়ছে। একজন বললেন, ‘বড় মন খারাপ হয়ে গেল জানেন, সেই সব পিঁপড়ে মাখা মিষ্টি, এখন তো সবই ফ্রিজের দেরাজ-বন্দি। পিঁপড়ে হবে কী করে!