মঙ্গলবার, ঠিক বারো দিনের মাথায় পুলওয়ামা হামলার প্রত্যাঘাত হিসেবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বালাকোটে জইশের যে প্রশিক্ষণ শিবির গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা, সেটা ছিল পাঁচতারা রিসর্টের মতো। এমন খবরই মিলেছে বায়ুসেনা সূত্রে। জানা গেছে, বালাকোট শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের চূড়ায় জইশের প্রধান প্রশিক্ষণ শিবিরটি পাঁচতারা হোটেলের থেকে কোনও অংশেই কম ছিল না। এর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য ঘরগুলি রীতিমতো বিলাসবহুল। এই জঙ্গী শিবিরটিতে ৫০০ থেকে ৭০০ জনের থাকার সুবন্দোবস্ত ছিল। আর এত লোকের রান্না এবং শিবির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আলাদা লোকও ছিল। পাহাড়ের ওপরে ঘন জঙ্গলে ঘেরা হওয়ায় ভৌগোলিক কারণে এটি ছিল অত্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়।
শুধু তাই নয়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত ওই শিবিরে ছিল এক অসাধারণ সুইমিং পুল, যেখানে জঙ্গীদের জলের তলায় হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। জঙ্গীদের অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাটিতে নেমে হামলা, নিরাপত্তা কনভয়ে হামলা চালানোর কৌশল, বোমা তৈরি এবং তা ঠিকভাবে রাখার কৌশলও শেখানো হত ওই শিবিরে। এছাড়া আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য গাড়ি ছিনতাই, পাহাড়ের উচ্চতম চূড়ায় বেঁচে থাকা এবং অত্যধিক মানসিক চাপেও মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রাখার কৌশল শেখানো হত। ওই শিবিরের সিঁড়িগুলি ছিল আমেরিকা, ইজরায়েল এবং ইংল্যান্ডের পতাকার রঙে রাঙানো।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের আগে জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান কার্যালয় ছিল আফগানিস্তানে। সেই সময় তালিবানের সঙ্গে হাত মিলিয়েই কাজ করত এই সংগঠন। পাকিস্তানে তখন একচেটিয়া আধিপত্য ছিল লস্কর-ই-তৈবার। লস্করের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতেই জইশের পাকিস্তানে আত্মপ্রকাশ। কিন্তু, আইএসআইয়ের পরামর্শেই তারা পরে ডেরা বাঁধে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কাছে মানশেরা জেলার বালাকোটে। এই ডেরা আগে লস্করের দখলেই ছিল। ২০০৫ সালে বড় মাপের ভূমিকম্প হয়েছিল কাশ্মীরে। সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল বালাকোটেরও। তখনই লস্করের প্রধান হাফিজ সইদ জামাত-উদ-দাওয়ার ব্যানারে দুর্গতদের (সংখ্যায় কয়েক হাজার) উদ্ধার করে নিয়ে আসেন বালাকোটের আশ্রয়ে। সৌদি আরবের কাছ থেকে প্রচুর অর্থও পান। অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও প্রচুর আর্থিক সাহায্য আসে। যা দিয়ে বালাকোটের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়।
পরে লস্কর ছেড়ে দেওয়ার পর এই জঙ্গী ঘাঁটির দখল নেয় জয়েশ। ভারতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আঁতুরঘর বলা হয় বালাকোটের এই প্রাসাদোপম অত্যাধুনিক শিবিরকেই। গোয়েন্দাদের পরিভাষায়, বালাকোটের এই ঘাঁটি বছরের পর বছর ধরে পরিচিত জঙ্গী তৈরির কারখানা হিসেবেই। ভারত একাধিকবার প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও পাক সরকার এই জঙ্গী শিবির ধ্বংসের বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। শেষপর্যন্ত ভারতীয় বায়ুসেনার ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমানই ইতিবাচক পদক্ষেপ নিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, পুলওয়ামা হামলার পর পিওকে–র প্রশিক্ষণ শিবির থেকে পাহাড়ি জঙ্গলে কুনহার নদীর উপর অবস্থিত অন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরে সরানো হয়েছিল জৈশের কয়েকশো জঙ্গী এবং তাদের প্রশিক্ষকদের।
জানা গেছে, বায়ুসেনার অভিযানের সময় বালাকোটের জঙ্গী শিবিরে প্রায় সবাই ঘুমোচ্ছিল। তাই, বিপদের বিষয়ে কিছুই আঁচ করতে পারেনি। সেই সময় শিবিরে কমপক্ষে ৩২৫ জন জঙ্গী ছিল। প্রশিক্ষক ছিল ২৫ থেকে ২৭ জন। প্রশিক্ষকরা সবাই প্রাক্তন পাকিস্তানি সেনাকর্মী। এছাড়া ওই শিবিরে প্রশিক্ষণ নিত হিজবুল জঙ্গীরাও। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রত্যাঘাতের পর তারা কেউ বেঁচে নিই বলেই শোনা যাচ্ছে। বায়ুসেনা ওই জঙ্গী প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম দিয়েছিল ‘সিটিং ডাক’ বা বসে থাকা হাঁস। যে ১২টি মিরাজ–২০০০ যুদ্ধবিমানে বায়ুসেনা হামলা চালিয়েছিল সেগুলি কোনও আঁচড় ছাড়াই নিরাপদে ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।