বারবার তিনবার। বর্ষশেষে এক সপ্তাহের মধ্যেই পরপর তিনবার বিষাদে আক্রান্ত হলাম আমরা। বাংলার, শুধু বাংলারই বা বলি কেন ভারতের সংস্কৃতিজগৎ থেকে সরে গেল তিনটি দীর্ঘকায় ছায়া। চলনে-বলনে-মননে একান্ত বাঙালি হয়েও তাঁরা গান, কবিতা ও চলচ্চিত্রে তাদের সৃষ্টি দিয়ে ভারত তো বটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেদের স্বকীয়তার ছাপ রেখে গেছেন। পরপর প্রয়াত হলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও মৃণাল সেন। তিনটি আলাদা মানুষ, কাজের ক্ষেত্রও আলাদা তবুও তিনটি মৃত্যুর মধ্যে এক মিল খুঁজে পেলাম আমি। এ এক আশ্চর্য সমাপতন। তিনজনই সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ, ৯০পেরিয়ে শতবর্ষের দিকে যাচ্ছিলেন তিনজনই এবং তিনজনই যাকে বলে ধুতি পরিহিত আপাদমস্তক বাঙালি। দীর্ঘকায় তিনজন মানুষেরই চোখে ছিল চশমা। তিনজনই সফল কিন্তু সাফল্য তাঁদের কারোরই মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বভূমিতে স্থির ছিলেন তাঁরা। এই ত্রয়ীর মৃত্যুতে আমাদের সংস্কৃতি সত্যিই গরীব হল। প্রায় একইসঙ্গে এমন তিনজন নক্ষত্র পতনের ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ছে না।
কাজের সুবাদে আমি বহুবার এই তিনজনের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছি। সরকার বাড়িতে কাজের সুবাদে নীরেনদার সঙ্গে বহুবার নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। মনে পড়ছে একবার নীরেনদাকে মজা করে দুলাইনের একটা ছড়া শুনিয়েছিলাম। টাক মাথার এইতো গুণ/ টেকো মাথায় হয়না উকুন। নীরেনদা হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন। ছবি তুলতে বেরোবার ও ঢোকার সময় অনেকবার দেখেছি নীরেনদা ও রমাপদদা একসঙ্গে সিগারেট খাচ্ছেন। লুকিয়ে সেই ছবি তুলে রেখেছিলাম কিন্তু এখন খুঁজে পাচ্ছিনা। দ্বিজেনদার সঙ্গেও তাঁর বাড়িতে এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোন অনুষ্ঠানে বহুবার কথা ও দেখা হয়েছে । সুস্থ থাকাকালীন দ্বিজেনদাকে মুখ্যমন্ত্রী বহু অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতেন আর সম্বর্ধনা জানিয়ে একটা করে শাল উপহার দিতেন। এই শাল নিয়ে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশ মজা হত। আমরা বলতাম, এত শাল নিয়ে দ্বিজেনদা কী করবেন? একদিন গান মেলায় আড্ডার ফাঁকে দ্বিজেনদাকে একথা বলতেই তিনি হেসে বললেন, তুমি তো সল্টলেকে থাকো, আমার বাড়িও চেনো, বাড়িতে এলে আমি তোমায় চারখানা শাল দিয়ে দেবো।
সরকার বাড়ির কাগজের হয়ে কলকাতা পাতার ছবি তুলতে একবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি দ্বিজেনদা তৈরি হয়ে বসে আছেন। আমিও বসে আছি, কিছুক্ষণ পর দ্বিজেনদা আমায় বললেন, ও অশোক, আমি তো গানের অনুষ্ঠানে যাবো। আমি বললাম, আপনার তো নাতনিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার কথা, ওর সঙ্গে আপনার ছবি তোলার কথা ছিল। দ্বিজেনদা নাতনিকে খুব ভালোবাসতেন। দ্বিজেনদার সঙ্গে তাঁর নাতনির একটা ছবি তুলেছিলাম। সেই ছবি নিয়ে দ্বিজেনদা বহুবার আমার প্রশংসা করেছেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী দিদির কাছেও সেই ছবিটার প্রশংসা করেছিলেন তিনি।
মৃণালদার সঙ্গে আমার খুব একটা বেশি কথা হয়নি, তবে আমি বরাবরই তাঁর গুণমুগ্ধ। ছবিও তুলেছি বহুবার। একবার মৃণালদার জন্মদিনে তাঁর ছবি তোলার সময় মৃণালদার বকুনি খেয়ে আমার মুখের অবস্থা এমন হয়েছিল যে গীতাদির তা দেখে খুব মায়া হয় এবং তার চেষ্টায় আমি সেই জন্মদিনে দুজনের একটা ছবি তুলি। আরেকবার নিকন ম্যানুয়াল ক্যামেরার শাটারের আওয়াজে উনি বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, এত আওয়াজ শাটারের, কী ক্যামেরা ব্যবহার কর? সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের কথোপকথনের মুহূর্তের সাদা-কালো কিছু ছবি তোলা আছে। এবার সেসব ছবি খুঁজে বার করবো।
আমি সামান্য আলোকচিত্রী। গান, কবিতা, সিনেমা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমি যখনই এদের কাছে গিয়েছি তখনই মনে হয়েছে নিরভিমান এই সহজ সরল মানুষগুলি এত বড়বড় কাজ করেন কীভাবে? আমি তো জানতামই না, দেবানন্দের মায়া ছবির বিখ্যাত গান – অ্যায় দিল কঁহা তেরি মঞ্জিল গানটা দ্বিজেনদার গাওয়া। দ্বিজেনদাকে বলতে হো হো করে হেসে বললেন, হ্যাঁ, তাতে আর কী হয়েছে? অনেকেই বলেন ওটা হেমন্তদার গাওয়া। একজন তো বলেছিলেন ওটা সুবীর সেনের গান। এখানে একটা কথা বলে রাখি ছবিতে প্রথমে গানটা রফি সাহেবকে দিয়ে গাওয়ানোর কথা হয়েছিল, দেবানন্দের নির্দেশেই দ্বিজেনদাকে দিয়ে গানটা গাওয়ানো হয়। মূল বাংলা গানটা তো সবাই জানেন একদিন ফিরে যাবো চলে…।
কবিতার ত্রিসীমানায় না ঘেঁষা বহু মানুষকে দেখেছি তারা নীরেনদার উলঙ্গ রাজা, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল কিংবা স্বপ্নে দেখা ঘর দুয়ার কবিতাগুলি জানেন। কবিতা না পড়লেও কমিক্স পড়া আমার বরাবরের অভ্যাস। চাকরি করতে এসে জেনেছি ইংরেজি ফ্যান্টম থেকে অরণ্যদেব কমিক্সটা নীরেনদারই অনুবাদ করা। টিনটিনের অনুবাদও তাঁর। এগুলি যে ইংরেজি কিংবা বেলজিয়ান ভাষায় লেখা তা একবারও মনে হয়নি, এমনই তার প্রসাদগুণ। সরকার বাড়ির কাগজে কাজ করার সময় দেখেছি যে কোন বানান সংকটের সময় নীরেনদার রায়ই সবার শেষ কথা।
মৃণালদা তো নিজেই সিনেমার একটা স্বতন্ত্র স্কুল, চলচ্চিত্রের এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় সিনেমাতে এই বাস্তবধর্মী ধারাটির একজন অন্যতম পথ প্রদর্শক তিনি। আমি নিজে সিনেমা অত বুঝিনা কিন্তু সিনেমার যারা মনোযোগী দর্শক ও সমঝদার তারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, রাতভোর, নীল আকাশের নীচে, বাইশে শ্রাবণ ছবিতে তিনি গল্প বলার যে ধারা তৈরি করেছিলেন সেই ধারাকেই পরবর্তীকালে ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, কোরাস ছবিগুলিতে ভেঙে ফেলে নিয়ে এসেছিলেন একটা রাজনৈতিক ডিসকোর্স। ইউরোপীয় সিনেমার ফর্ম ভাঙার পরীক্ষানিরীক্ষাকে মৃণালদা ভারতীয় সিনেমাতেও নিয়ে এসেছিলেন। হিন্দি ছবি ভুবন সোম, ওড়িয়া ছবি মাটির অ মনিষ এবং তেলগু ভাষায় ওকা ওড়ি কথা করে প্রাদেশিকতার গণ্ডি অতিক্রম করেছিলেন তিনি।
বিত্তে ধনী না হয়েও বাংলা যে চিত্তে ধনী প্রয়াত এই তিনজন নিজেদের কাজ দিয়ে তা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন। বাংলার কৃষ্টি ও সৃষ্টির উৎকর্ষকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁরা। এই সব প্রয়াত গুণী মানুষেরাই আমাদের প্রকৃত শিক্ষক। আপনাদের স্মৃতি ও আমার তোলা আপনাদের ছবিগুলি চিরকাল আমার মনের অ্যালবামে থাকবে। আমার বিশ্বাস, আপনাদের সৃষ্টি পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন নতুন সৃষ্টিশীল কাজে অনুপ্রাণিত করবে। আপনাদের প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )