ভিডিও টা কর্নেল এমএন রাই এর শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দিলাম। ২০১৫-র ২৭ জানুয়ারি সেনা বাহিনীর একটি ছোট ব্যাটেলিয়নের ওপর হামলা চালিয়েছিল বুরহান ওয়ানি। ওই হামলায় ৪২ রাষ্ট্রীয় রাইফেলের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল এম এন রাই শহিদ হয়েছিলেন। কর্নেল রাইয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিল তাঁর আদরের মেয়ে অলকা। বাবার মরদেহের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে স্যালুট করছেন অলকা আর বাবার শেখানো ওয়ারক্রাই বা যুদ্ধের স্লোগান তুলছেন- “হো কে হৈ না হো হো হো৷” অর্থাৎ “আমরা পারবোই, হ্যা হ্যা হ্যা”। সেদিন দাঁড়িয়ে থাকা তাবড়-তাবড় অফিসার, জওয়ান নির্বিশেষে সেদিন গলা মিলিয়েছিলেন – হো হো হো। মানে পারবো পারবো পারবো। বদলা নিতে পারবো। এই দৃশ্যটা ভাইরাল হয়ে গেছিল। ” উরি” ছবিতে এই বাস্তব ঘটনাই পুনঃ নির্মান করা হয়েছে। এসেছে আরো রক্ত গরম করা স্লোগান – হাউ’স দা জোশ? হাই স্যার! সেনাবাহিনীর চাকরি আর পাঁচটা মোটা মাইনের চাকরি বোধহয় না। এইসব মুহুর্ত ও বটে।
পুলওয়ামাতে শহীদ হয়েছেন রাজস্থানের বাসিন্দা সিআরপিএফ জওয়ান রোহিতাশ লাম্বা। ২৭বছর বয়স। এক বছর হলো বিয়ে হয়েছিল। দুমাস হলো বাচ্চা। প্রথমবার নিজের একরত্তি সন্তানকে দেখবেন বলে উৎসাহ, উন্মাদনাও ছিল তুঙ্গে। হোলিতে আসবেন বলে ছুটি ও নিয়ে ফেলেছিলেন। হোলির আগেই আসলেন তবে কফিনে করে। ছিন্নভিন্ন হয়ে। সন্তানকে কপালে চুমু খাওয়া হয় নি আর। সেনাবাহিনীর চাকরি আর পাঁচটা মোটা মাইনের চাকরি বোধহয় না। এইসব আপসোস ও বটে।
পুলওয়ামার ঠিক পরের দিন নৌসেরাতে আই ই ডি বিস্ফোরণে নিহত হন এক সেনা মেজর। লাইন অফ কন্ট্রোল থেকে ১.৫ কিলোমিটার ভেতরে মাটিতে পোঁতা ছিল ওই মাইন। ডিফিউজ করতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হন মেজর চিত্রেশ। ৩০বছর বয়স। দেহরাদুনে বাড়ি। পরের মাসের সাত তারিখ বিয়ে। নিমন্ত্রণ করা হয়ে গেছিল, বাড়িভাড়া, কেনাকাটা ও শেষ প্রায়। এই মাসের শেষে ছুটি নিয়ে আসতো চিত্রেশ। হবু স্ত্রী মেহেন্দি ও করেছিল হয়তো পছন্দ মতো। এ ছেলেটিও কফিনে ফিরে এলো। এখন ঝামেলা বিয়ে নিয়ে। শাস্ত্রমতে কফিনের সাথে বিয়ে হয়না যে। সেনাবাহিনীর চাকরি আর পাঁচটা মোটা মাইনের চাকরি বোধহয় না। এইসব ঝামেলা আছে ও বটে।
ভুল করছেন। আবার ও ভুল করছেন। শোকের সময় বাস্তববাদী হওয়া ভালো কিন্তু অপরের বিশ্বাস, রোদন একদিনে চুরমার করে কোন বিপ্লব অর্জন হয়না। মনস্তত্ত্ব বলে, কারো সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটায় সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো হঠাৎ আঘাত দিলে, নুন ছেটালে, মস্করা করলে, প্রতিঘাত নেবে আসে। আর তাতে বৃহত্তর ক্ষতি এক নতুন সমাজের৷
ধর্মকে আফিম বলা আর ভগবানকে গালাগালি দেওয়ার মধ্যে সুক্ষ্ম ফারাকটা বুঝতে যেমন শিখছেন, তেমনি সেনাবাহিনীকে বেতনভোগী রাষ্ট্রের চাকর বলা আর ৪০জন জওয়ান শহীদ হলে ও আপনার সেসময় চালিয়ে যাওয়া তথাকথিত প্রেগম্যাটিক আলোচনা কতটা অসংবেদনশীল হতে পারে, সেটা বুঝতে শিখুন।
আপনার পাশের বাড়ির দত্ত পিসি আপনার দুচোখের বিষ৷ মারা গেলে পরে আপনি গেছেন ও বাঁহাতে ফুল মালা দিতে। কিন্তু ধরুন সেখানে দাঁড়িয়েই যদি আপনি দত্ত পিসি নিয়ে গালমন্দ করেন, আপনার গম্ভীর তত্ব আশেপাশের মানুষকে শোনান। আপনি ক্যাল খাবেন। কারণ সেটা ঠিক সময় না।
বর্তমান সময়ে ও ঠিক তেমনটা হচ্ছে। দেশত্ববোধে মজে গোটা দেশ। শোকের সময় এটা। এখন আপনি অপ্রিয় সত্যি কথা গুলো বললে ও দেশের মানুষ সেটা হজম করতে পারবেনা। এতে ওদের আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আমাদের এপিগ্লটিস, এড্রেনাল গ্যাল্ড, মস্তিষ্কে আমাদের কোন হাত নেই। এ মুহুর্তে পুলওয়ামাতে নিহত শহীদকে যদি আমার নায়ক মনে হয়, তার বিরোধে যে ভাষ্য দিচ্ছে তাকে ভিলেন মনে হবেই।
আপনি চাইলেও এখন প্রশ্ন করতে পারবেন না, কেন এই পাঁচ বছরে ৯৫% বেশী সেনা জওয়ান শহীদ হলো। এর পলিসিগত দায় কার। আপনি চাইলে ও এখন প্রশ্ন করতে পারবেন না, কেন সেনাকে ব্যবহার করা হবে বারবার ভোটের জন্য। আপনি প্রশ্ন করতে পারবেন না কেন আইবি নোট থাকার পরে ও, কাশ্মীরে এতো নিরাপত্তা থাকার পরে ও, রাজ্যপাল শাসন থাকার পরে ও এরকম একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যায়। আপনি এটা বলতে পারবেন যে ২৬/১১ হোক বা পুলওয়ামা, পাকিস্তান সুনিপুণভাবে কমবয়সী ছেলেদের মাথা খেয়ে তাদের সহজপথে কখনো সমুদ্র দিয়ে কখনো হাইওয়ে দিয়ে ঢুকিয়ে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে আর আমরা এখনো একজোট না হয়ে হিন্দু মুসলিম খেলে চলেছি।
সেনাবাহিনীর চাকরিতে শৌর্য আছে। অস্মিতা আছে। সম্মান আছে। কিন্তু কেউ বেঘোরে মরার জন্য সেনা বা আধাসেনাতে চাকরি করতে যায় না। আপনার আত্মীয় যে সেনাবাহিনীতে আছে তাকে জিজ্ঞেস করুন। আমার বন্ধুর বাড়ির লোক দেখে বলছি। তার নববিবাহিতাকে দেখে বলছি। রোজ ভোররাতে ফোন চেক করে তারা। যদি কোন খারাপ খবর আসে৷ আপনি তখন মনেপ্রাণে চাইছেন আরো তরতাজা প্রাণ শহীদ হোক।
“যারা যুদ্ধে যায়, তারা যুদ্ধ চায় না। যারা যুদ্ধ চায়, তারা যুদ্ধে যায় না”। যারা যুদ্ধে যায়, তারা যুদ্ধ চাইলে ”অল মাই ব্যাগস আর প্যাকড, আই অ্যাম রেডি টু গো…’ গানটি এতো জনপ্রিয় হতো না গোটা পৃথিবীর সেনাবাহিনীর মধ্যে।
প্রত্যেক সেনাবাহিনীর সদস্য চায়, ফিরে এসে বউকে জাপ্টে ধরতে। সন্তানের মাথায় চুমু খেতে। মা বাবার পাশে বসে গল্প করতে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে৷ প্রত্যেক সেনাবাহিনী মারার জন্য চাকরি করে। মরার জন্য না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )