‘এই মেলা দেশের সেরা মেলা হতে চলেছে। প্লাস্টিকমুক্ত এই মেলা নির্মল মেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমনকি মেলা এখন বিপন্মুক্ত।’ রাজ্যের তরফে মেলায় সাংবাদিক বৈঠকে এমনই জানিয়েছিলেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সোমবার ভোরের আলো ফুটতেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল তার কথাই ঠিক। সাগরের স্নানঘাটে যাওয়ার ৫টি পথই মিশে গিয়েছিল পুণ্যার্থীর ভিড়ে। বেলা যত বেড়েছে, ভিড়ও বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চতুর্দিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৭ লক্ষ পুণ্যার্থী এসেছেন।
আজ, মঙ্গলবারও ভোর থেকে ভগীরথের সেই পুণ্যতীর্থ পবিত্র গঙ্গা ও সাগরের মিলনধারায় মকর সংক্রান্তির স্নানে মোক্ষলাভ করতে হাজির লাখো লাখো পুণ্যার্থী। কোনও কোনও প্রাচীন পঞ্জিকা মতে সোমবার গভীর রাত থেকে মকরের স্নান শুরু হয়েছে। তবে সরকারি ও প্রশাসনের তথ্য অনুসারে মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের আগে থেকে স্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ। চলবে বেলা ১১টা ৪৭ মিনিট পর্যন্ত। কপিলমুনির আশ্রম কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত স্নানের সুযোগ রয়েছে।
পুরাণ ঘেঁটে জানা যায়, বহু যুগ আগে সাগরতটের এই বালুকাময় প্রান্তরে কপিলমুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল অযোধ্যার পরাক্রমশালী সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র। দীর্ঘ তপস্যার পর অভিশপ্ত পিতৃপুরুষের আত্মাদের উদ্ধারের জন্য গঙ্গাকে জলধারা রূপে কপিলমুনির তপস্থলিতে টেনে এনেছিলেন ভগীরথ। সেই জলের স্পর্শে পিতৃপুরুষদের উদ্ধারের পাশাপাশি সাগরের সঙ্গে গঙ্গাকে মিলিয়ে দিয়ে তীর্থশ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর ভিড়ের জন্য সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে এই সাগরতট। উল্টোদিকে কত মানুষ তাঁর সারা জীবনের একমাত্র পূর্ণতা পেতে ছুটে আসেন এই সাগরমেলায়। কেবলমাত্র একটা ডুব দিলেই মিলবে পুণ্য। সেই অবিচল বিশ্বাসে ভর করে সুপ্রাচীন সময় থেকে পুণ্যার্থীরা সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত দ্বীপে চলে আসেন। এবারও দেখা গেল সেই একই ছবি। গতকাল থেকেই গঙ্গায় ডুব দিয়ে দলে দলে পুণ্যার্থী গেছেন কপিলমুনির মন্দিরে পুজো দিতে। মানুষের ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য ছিল অসংখ্য ড্রপ গেট। সেই ড্রপ গেট পেরিয়ে পুণ্যার্থীরা এগিয়ে গেছেন কপিলমুনি মন্দিরের দিকে।
উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ থেকে ছুটে এসেছেন সাগরে মধ্য তিরিশের বিন্দু সিনহা। ব্যবসায়ী পরিবার। এই প্রথমবার এসেছেন। কাছের প্রয়াগের অর্ধকুম্ভে না গিয়ে সাগরে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বিন্দু বলেন, ‘অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল সাগরে আসার। কলকাতার এক বন্ধুর সাহায্যে চলে এলাম। খুব ভাল লাগল। আসলে কপিলমুনি বোধহয় নিয়ে এল। প্রয়াগে পরেও যেতে পারি।’ সাগরতটে দেখা মিলল এক বিদেশি পর্যটকেরও। লন্ডন থেকে এসেছেন মাইক ইব্রাহিম। মূলত ফটো তোলার জন্য তিনি এসেছেন। তিনিও মানুষের ভিড় দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক’।
জানা গেছে, ১ নম্বর থেকে আদি শংকরাচার্যের প্রতিকৃতি নিয়ে ভক্তদের সঙ্গে করে স্নান করবেন পুরীর শংকরাচার্য। দু’দিন ধরে মনশুদ্ধির জন্য আশ্রমের তাঁবুতে গীতা ও বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে পাঠ করে শোনাচ্ছেন ভক্তদের। আবার ৫ নম্বর রাস্তার দক্ষিণ পাশে ইস্কনের অস্থায়ী সেবা ক্যাম্প। সেখানে দেখা গেল, তাঁদের কেউ রাশিয়া, কেউ মালয়েশিয়া, কেউ আমেরিকা কেউ আয়ারল্যান্ড কেউ স্পেন থেকে এসেছেন। সাগর কে ১ বাস টার্মিনাসের কাছে লোকনাথ মিশন। স্নানযাত্রীতে ভরে গিয়েছে সেই আশ্রমও।
দুর্গম সেই যাত্রাপথ আজ অনেকটাই মসৃণ। কিন্তু আজও নদীপথ না পেরিয়ে সাগরে আসা সম্ভব নয়। জোয়ার-ভাটার জন্য যে নদীতে যাতায়াত আজও খুব সহজ নয়। তবুও পুণ্যার্থীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। কাকদ্বীপের লট নং আটে পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের জন্য তদারকি করছেন ৩ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও মন্টুরাম পাখিরা। ১৭ জানুয়ারি মেলা শেষ পর্যন্ত থাকবেন তাঁরা। উল্লেখ্য, গতকাল সাগরস্নান করেছেন রাজ্যের অপর ৩ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও অরূপ বিশ্বাস।