বাকি আর মাত্র ক’দিন। দোরগোড়ায় মকরসংক্রান্তি৷ চতুর্দিকেই পুণ্য সাগরে ডুব দিতে সাগরে যাওয়ার আয়োজন৷ তাই প্রায় গোটা দেশই এখন গঙ্গাসাগরমুখী। ডানা ঝাপটে হাঁসপাখিদের ইতিউতি সরে যাওয়াই প্রমাণ দিচ্ছে সাগরে মানুষের আনাগোনার৷ ড্রেজিংয়ের যান্ত্রিক শব্দ আর স্টিমারের ঘন ঘন যাতায়াত বুঝিয়ে দিচ্ছে সাজছে সাগর৷ দ্রাবিড়, বঙ্গ, উৎকল, মারাঠা এখন সঙ্গমমুখী৷ প্রয়াগে এবার অর্ধকুম্ভ৷ কিন্তু তাতে কি! ধারে, ভারে কুম্ভের দিয়ে কোনও দিক থেকেই পিছিয়ে নেই সাগরদ্বীপে গঙ্গাসাগর মেলার আয়োজন৷
পুণ্য ডুবের সত্যিই আর দেরি নেই৷ ইতিমধ্যেই বাবুঘাটে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন পুণ্যার্থীরা৷ সেই ভিড়ে সামিল অসংখ্য সাধু-সন্তও৷ অস্থায়ী কুঠিয়ায় ধুনি জ্বালিয়ে তাঁরা ভক্তদের আশিস বিলি করতে কোনও কার্পণ্য করছেন না৷ সবমিলিয়ে বাবুঘাট যেন এখন মিনি সাগরমেলাই। ফি বছরই বাবুঘাটের এই ভিড় ১০ জানুয়ারি থেকে এগোতে শুরু করে সাগরের দিকে৷ তাই অর্ধকুম্ভ থাকলেও সাগরমেলায় জন সমাগমে কোনও ঘাটতি হবে না। এমন কথা বলছেন সাগরের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই কলকাতার বাবুঘাটে এসে পড়া সাধু-সন্ন্যাসী ও ভক্তরা।
রবিবার বিকেলে এই মিনি সাগরমেলার মাঠে দাঁড়িয়েই নাগাসাধু দিগম্বরগিরি স্বীকার করলেন, সাগরমেলা এখন আগের তুলনায় অনেক গোছানো এবং যাওয়া-আসার কষ্ট এখন অনেকটাই কম।আবার ভুবনেশ্বর থেকে দু’টি বাস নিয়ে এখনই গঙ্গাসাগরের উদ্দেশ্যে বাবুঘাটে এসে পৌঁছেছেন বিকাশ মহাপাত্র, বলরাম পট্টনায়েকরা। প্রায় ১০০ জনের একটি দল। ১৩ জানুয়ারির দিন সাগরস্নান সেরে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
গঙ্গাসাগরে যাওয়ার জন্য বাবুঘাটে প্রতিবারের মতোই এবারও চালু করে দেওয়া হয়েছে ট্রানজিট ক্যাম্প। যা ইতিমধ্যেই জমজমাট মেলার চেহারা নিতে শুরু করেছে। বাসের পর বাস ভর্তি করে তীর্থযাত্রীদের যে আসা-যাওয়া, তা শুরু হতে আরও দিন তিন-চারেক লাগবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ‘মিনি-গঙ্গাসাগর মেলা’ বলে পরিচিত হয়ে ওঠা বাবুঘাট ময়দান ভরে উঠছে হরেক রকমের সাধুসন্ত থেকে শুরু করে ভক্ত, কৌতুহলী সাধারণ মানুষ এবং ছবিশিকারীদের ভিড়ে।
এবার রাজ্য প্রশাসন ভিনরাজ্যের তীর্থযাত্রী ও সাধুসন্তদের জন্য আরও যত্নবান। এবারই প্রথম বসানো হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এটিএম কাউন্টার, ক্লোক রুম। ক্লোক রুমে বিনা খরচে লটবহর রেখে সাগরস্নান সেরে আবার তা নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে যেতে পারবেন তীর্থযাত্রীরা। এবারও তৈরি হয়েছে সাতশোরও বেশি শৌচালয়। এবং সবকটাই পাকা। এছাড়া প্যান্ডেলের কাজ এখনও চলছে। পুলিশের ওয়াচটাওয়ার তৈরি। গোটা এলাকা টিন দিয়ে ঘেরা। যাতে ঠান্ডা হাওয়া না ঢোকে। আলো, পানীয় জল, শৌচাগার, জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সিভিল ডিফেন্স এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর এখানে অস্থায়ী একটি মিনি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছে। কলকাতা পুরসভা আউটরাম ঘাটে একটি বড় কন্ট্রোল রুম খুলেছে। ওই চত্বর ছেয়ে দেওয়া হয়েছে আগত তীর্থযাত্রীদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাবার্তায়। হিন্দি এবং বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর কাটআউটে লেখা ‘সকল গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রীদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা’। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মঞ্চে স্বামী বিবেকানন্দের, গঙ্গাসাগরের সাধুদের স্নান ও কপিল মুনির আশ্রমের ছবি। আলোয় সেজেছে মেলাচত্বর।
ইতিমধ্যেই বাবুঘাটের মেলায় এসে পড়েছেন নাগাসন্ন্যাসী জলেশ্বরগিরি, প্রেমেশানন্দগিরি, খাড়েশ্রী যোগীনাথ প্রমুখ অনেক সাধু-সন্ন্যাসী। নাগা সন্ন্যাসী মধুসূদন পুরি জানালেন, কেদারনাথ থেকে এসেছেন। শিবনাথ নাথ এসেছেন কাঁচরাপাড়া থেকে। গুজরাটের ধুলাগড় থেকে সেছেন পূরণ গিরি। এখান থেকে যাবেন সাগরে। বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচাতেই থাকছেন সকলে। বিচিত্র তাঁদের সাজগোজ। অনেকেই ২৪ ঘণ্টা দিগম্বর অবস্থাতে কাটিয়ে দেন। ধুনি জ্বালানোর জন্য আশপাশ এলাকা থেকে তাঁরা প্রচুর জ্বালানি এনে ডাঁই করেছেন। ভক্তরা এসে চাল, কলা, মুলো দিয়ে যাচ্ছেন। তা দিয়েই চলছে রান্না। রমরমিয়ে চলছে জড়িবুটি, মন্ত্রপূত তেলের ব্যবসাও।