দেশের রাজনীতি জোটযুগে প্রবেশ করেছে বহুকাল। প্রয়োজন এর একটা বড় কারণ। কিন্তু একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ এই বাস্তবতাটা বুঝতে চান না। তারা শুধু জোটের কথা বলেন বিপাকে পড়লে। আমাদের দেশের মত নানা ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় এবং অগ্রসর ও অনগ্রসর মানুষে বিভক্ত দেশে জোট রাজনীতি একটা অনিবার্য ঘটনা। জোট হওয়া বা না হওয়াটা শুধু স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করে না। এরা যখন দেখেন কোন জোট তাদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তারা যেনতেন প্রকারেণ সেই জোট ভাঙার চেষ্টা করেন। এখন যেমন তা করছেন একশ্রেণীর বিজেপি নেতারা। বিজেপি বিরোধী জোট গোটা দেশেই একটা স্পষ্ট চেহারা নিতে শুরু করতেই শুরু হয়ে গেছে সেই জোট ভাঙার জন্য ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি।
রূপকথার একই কুমীরছানাকে বারবার দেখানোর গল্পের মত কেউ তাদের বিপাকে ফেলতে পারে এমন আঁচ করলেই তার বিরুদ্ধে পুরনো মামলা জিইয়ে তোলার রাজনীতি শুরু করে দেন তারা। উত্তরপ্রদেশের এসপি – বিএসপি জোট যখন প্রায় নিশ্চিত ঠিক তখনই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবকে পুরনো একটা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে সিবিআই। ২০১২সালের বালি-খনন মামলায় ২০১৯সালে জিজ্ঞাসাবাদ করার মধ্যে দিয়ে শাসকদলের চাপ সৃষ্টি করার এই বহু পুরনো ডিজাইনটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে মায়াবতীর বিরুদ্ধেও। আমার প্রশ্ন, এতদিনে এই মামলাগুলির নিষ্পত্তি হল না কেন? এরা যদি সত্যিই কোন অপরাধ করে থাকেন তাহলে শাস্তিদানে এত বিলম্ব কীসের? বিলম্ব কী শুধু এ জন্যই যে মামলার জুজু দেখিয়ে এদেরকে তাঁবে রাখা যাবে? যদি কেউ বলেন, উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে ধুয়েমুছে সাফ করে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন এই দুই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যে আদতে ব্ল্যাকমেলের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা হল তবে তিনি কী কোন ভুল কথা বলবেন? মনে রাখতে হবে উত্তরপ্রদেশ ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র। অখিলেশ মায়াবতীরা উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে রুখে দিলে আগামী ভোটে বিজেপির পরাজয় অনিবার্য।
জোট ভাঙার এই গ্র্যান্ড ডিজাইনের পাশাপাশি দেশের বিরোধী রাজনীতিতেও জোট ভাঙার একটা খেলা চালু আছে। তা করেন একশ্রেণীর বিরোধী দলনেতা। দেশের বৃহত্তর রাজনীতির আঙিনায় পা ফেলতে না পারা এই নেতারা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে ওস্তাদ। বন গাঁয়ে শেয়াল রাজার মত এই নেতারা নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেখানে বলছেন, আগামী নির্বাচনে দেশের সাধারণ মানুষের লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে, ঠিক সেসময় বাংলার কিছু কংগ্রেস নেতা অন্ধ তৃণমূল বিরোধিতার জায়গা থেকে সেই প্রচেষ্টা ভাঙার জন্য আদা জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তারা বাণী দিচ্ছেন, বিজেপিকে ঠেকাতে কোনমতেই তৃণমূলের সাথে যাওয়া যাবে না। একথা বলার সময় তারা একবারও নিজেদের রাজ্যে স্রেফ কয়েকটা অফিস ও গুটিকয়েক নেতা সর্বস্ব কংগ্রেস দলটির দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। আমার দুটি প্রশ্ন, রাজ্যে কী কংগ্রেস দলটা খুব ভাল অবস্থায় রয়েছে? দুই, লোকসভা ভোটে এই জোটের সূত্রেই দলটি যদি রাজ্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে পারে তাহলে তা কি আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও রাজ্য কংগ্রেসকে কোন ডিভিডেন্ট দেবে না?
একই প্রবণতা শুধু কংগ্রেস নয়, দেশের দু তিনটে রাজ্যে কোনমতে টিঁকে থাকা সিপিএমের মধ্যেও স্পষ্ট। সূর্য সুজন সবাই মুখে প্রবল বিজেপি বিরোধী হলেও গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী লড়াইতে যিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী মহাজোট গড়ে তোলার কথা যিনি সবার আগে বলেছিলেন সেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোন জোটে যেতে নারাজ। তাদের মতে, তৃণমূল একটা স্বৈরতান্ত্রিক দল এবং রাজ্যে সিপিএমকে তারা ধ্বংস করছে। আমার প্রশ্ন, একটা দল টেঁকে তার লড়াইয়ের ক্ষমতায়, সাংগঠনিক দক্ষতায় এবং যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে। আমার কট্টর বাম বন্ধুরা কী বলবেন দলটির মধ্যে এখনও এই গুণগুলির কিছুমাত্র দেখতে পান? দলটির দুরাবস্থা তো সেই কারণেই? এর জন্য তৃণমূল নেত্রীকে দোষ দিয়ে কী লাভ? কূপমণ্ডূক এই রাজনীতিবিদরা জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তম প্রেক্ষিতটাই বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারা বুঝতে পারছেন না বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে তাদের দপ্তর খোলা রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে।
দোষী যেই হোক না কেন তার বিচার এবং শাস্তি দেশের প্রতিটি মানুষই চায়। কিন্তু তদন্তের নামে এই মামলা ও ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি আমরা কেউই চাই না। স্পষ্টতই এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। আইন দোষীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে কিন্তু তা কখনোই জেল বা মামলার জুজু দেখিয়ে প্রতিবাদীর মুখ বন্ধ করার অধিকার দেয়নি। অখিলেশ মায়াবতীর আসন সমঝোতা উত্তরপ্রদেশে একটা স্পষ্ট চেহারা নিতেই বিজেপি এই পুরনো তাসটা খেলে দিল। এছাড়া তার আর কোন উপায়ও নেই। শুধু বিরোধীদের চাপই নয়, সংকট এখন তাদের নিজেদের দলেও। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ, রাম জন্মভূমি ন্যাসের সঙ্গে বিরোধ তো ছিলই, এখন আবার দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বহু নেতারাও মোদী-অমিতদের কাজকর্মে বিরক্ত। মানুষ এদের কথা বিশ্বাস করেন, আগামী ১৯জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা তৃণমূলের ব্রিগ্রেড সমাবেশে যোগ দেবেন যশোবন্ত সিনহা, শত্রুঘ্ন সিনহা, অরুণ শৌরি, রাম জেঠমালানির মত বিজেপি নেতারাও। এছাড়াও এই সমাবেশে যোগ দেবেন জিগনেশ অল্পেশ হার্দিকের মত যুবনেতারা। দেশের বিরোধী রাজনীতির মহাজোটের এই সংহত চেহারাটাকে বিজেপি ভয় পেয়েছে। তাই ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। তারা জানে না মানুষ তাদের এই রাজনীতিকে ব্ল্যাকহোলে পাঠাবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )