(১)
-তুই আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না।
এইটুকু শুনেই ফোন কেটে দেয় রেহান।একটা চাপা উৎকণ্ঠা কিছুদিন ধরেই দানা বাঁধছিলো মনে, তবে জল এতদূর গড়াবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনি ও।সকালবেলার টিউশন থেকে বেরিয়ে অর্চনার সাথে বাস স্টপের দিকে হাঁটছিলো ও, তখনই আসে নয়নের ফোনটা।
আবু রেহান জয়পুরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।কলেজে বন্ধু বলতে একমাত্র নয়ন।নয়নতারা চ্যাটার্জি।বড্ড জেদি আর একরোখা মেয়ে।শান্ত-শিষ্ট রেহানের পুরো বিপরীত।
ফোনটা কেটে কিছুক্ষন ভাবলো রেহান।না,আজ আর কলেজ যাবেনা সে।
(২)
মুস্তাকের সাথে নয়নের পরিচয় হয় অনেক ছোটবেলায়।এতবছর যোগাযোগহীন থাকার পর ফেসবুকের দৌলতে আবার বার্তালাপ শুরু।
মুস্তাক দিল্লিতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ে,ওখানকারই এক নামী রেস্তোরাঁয় জব করছে।ফেসবুক থেকে নয়নের হোয়াটস্যাপের প্রোফাইল পিকচারে জায়গা করে নিতে বেশী সময় লাগেনা ব্যাচেলর মুস্তাক হোসেনের।তবে এসব কথা নয়ন ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়না রেহানকে,কষ্ট পাবে ভেবে।
ও কি আর জানতো,রেহান সব জানতে পেরে যাবে আর মুস্তাককে সরাসরি ফোন করে বসবে।
ধুস!কি যে করে ও এখন।এসবের মাঝে পড়ে ওদের বন্ধুত্বটা যেন নষ্ট না হয়ে যায়,চিন্তিত হয়ে পড়ে নয়ন।
(৩)
ঝিলমিল কে হারাবার পর রেহানের আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিলো না।দোষের মধ্যে একটা মেয়ের সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তুলেছিলো রেহান।শুধু এটুকুর জন্যে তিন বছরের প্রেমকে মাশুল গুনতে হয়েছিলো।সেইসব ভীষণ দুর্যোগের দিন গুলোতে নয়নের আগমন ঘটেছিলো জীবনে।প্রথম দেখা অবশ্য কলেজেই।এক স্টেশন আগে পরে বাড়ি ওদের।তাই নিত্য একসাথে যাতায়াত লেগেই ছিলো।বিপরীত মেরুর আকর্ষণের মতোই কাছে আসতে সময় লাগেনি ওদের।একসাথে টিউশন,কলেজ যাওয়া,খাওয়া দাওয়া….একেক করে রেহানের যাবতীয় কাজের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল নয়ন।
একবার কলেজের এক বান্ধবীর সাথে তেরো মিনিট কথা বলার অপরাধে ভীষণ বকেছিলো নয়ন।একটু অভিমান হলেও রেহানের অবশ্য ভালোই লেগেছিলো বকুনিটা।কিসের এক অদৃশ্য টান কাজ করে ওদের মধ্যে,ভেবে পায়না রেহান।
এই অধিকার বোধ,এই ভালোলাগা ভাগ হতে দেখে রেহান চুপ করে বসে থাকবে?
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে যায় রেহান।
(৪)
ভীষণ মনখারাপ নয়নের।এ কদিন পড়তে আসেনি রেহান।কলেজও আসছে না।হয়তো নয়নের উপর রেগে এসব করছে।রেহান কি বোঝেনা নয়নের খারাপলাগাটা?যে রোজ দু বার ফোন করে খোঁজ নেয় সে একদিন একবারও ফোন করলো না?দেখা হোক,আগে দুটো থাপ্পড় মারবে দু গালে তারপর বাকি কথা।
কলেজ থেকে বেরিয়ে শ্যামবাজারের দিকে যেতে যেতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে হাতে নেয় নয়ন।
(৫)
রেহান এবার পুজোর শপিং করবেনা, ঘুরতেও বেরোবে না।কার সাথে বেরোবে?নয়নকে নিয়ে পুরো উত্তর কলকাতা চষে বেড়াবে ভেবেছিলো।সেই নয়ন এখন ওর বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে,এটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না রেহান।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সাইকেল চালাচ্ছিলো।ক্লাস নাইনের দুটো ছাত্রকে পড়ায় ও।পরীক্ষা চলছে তাই পড়াতে যেতেই হবে।নয়তো ফোন করে ক্যান্সেল করে দিতো।একেই ইংলিশ মিডিয়ামের চাপ,তার উপর সিলেবাস খানিকটা বাকি রয়ে গেছে।কিছুটা বাধ্য হয়েই পড়াতে যাচ্ছিলো।ফোনটা বেজে উঠতেই সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেহান।স্ক্রিনে নয়নের নম্বর ফুটে ওঠে।ফোনটা ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে ধরেই ফেলে।
-রিসিভ করতে এতো দেরি কেন?
-যা বাবা।তুইতো যোগাযোগ করতে বারণ করেছিস।
-হ্যাঁ কিন্তু আমার কল ধরতে বারণ তো করিনি।
-ফালতু ঝামেলা করিস না।মুড ভালো নেই।কি বলবি বল।
-সপ্তমীর দিন এগারোটার মধ্যে রেডি হয়ে আমার বাড়ি আসবি।
রেহানের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দেয় নয়ন।ও চিরকাল এরকমই।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আরেকটা ফোন করে পড়ানো ক্যান্সেল করে দেয় রেহান।এখন ওর অনেক কাজ।পুজোর শপিং করতে হবে।
(৬)
“কেমন লাগছে বল আমায়?খারাপ বললে খুন হবি”।
ডাঙরি পড়েছে নয়ন।পায়ে স্নিকার্স আর চোখে হালকা কাজল।ওর চোখ দুটো যে এতো সুন্দর তা আগে কখনো খেয়াল করেনি রেহান।বাদামি চুলের নয়নকে এই ভরদুপুরে আকাশ থেকে নেমে আসা পরীর মতো লাগছে রেহানের।
(৭)
ওরা যখন দমদম তরুণ দলের মন্ডপ দেখে বেরোচ্ছে ততক্ষনে দুপুর গড়িয়ে গেছে।দমদম পার্ক জায়গাটা বেশ লাগে নয়নের।বেশ নিরিবিলি।এই এলাকায় তিন থেকে চারটে বড়ো বড়ো পুজো হয়।সবকটাই দারুণ।তরুণ দলের মণ্ডপের লাগোয়া একটা ঝিল আছে।নয়নের খুব ইচ্ছে করছে ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে বসার।কিন্তু জানে রেহান কিছুতেই রাজি হবেনা।অগত্যা গিয়ে রেহানের হাতটা জড়িয়ে হাঁটতে থাকে।এমনিতে ছেলেটা ভীষণ মুখচাপা।ঠিকঠাক হাত ধরতেও জানেনা।কলকাতায় এসে প্রথম প্রথম তো বাসে উঠতেও ভয় পেত,যদি স্টপেজ মিস করে ।তবে এখন জড়তা অনেক কেটেছে।
দমদম পার্ক যুবক বৃন্দের ঠাকুরটা দেখে নয়নের মন ভরে গেলো।কি সুন্দর ডাকের কাজ।যেন সাক্ষাৎ দেবী।হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো চারটে বাজে।সন্ধ্যে হলেই বাড়ি থেকে কল আসা শুরু হয়ে যাবে।নেহাত রেহানের সাথে বেরিয়েছে,নয়তো এতক্ষনে তিন বার কল এসে যেত।
(৮)
এই প্যাচপ্যাচে গরমেও অর্ধেক কলকাতা রাস্তায় নেমে পড়েছে।অন্তত শ্রীভূমির লাইনটা দেখে তাই মনে হল রেহানের।এতো ভিড় দেখে নয়নের হাতটা শক্ত করে ধরে রেহান।এমনিতে ও কোনো মেয়ের হাত ধরার আগে দুবার ভাবে।ছোটো থেকে মফস্বলে মানুষ।সেখান থেকে কলকাতার এই শহুরে হালচালে ঠিক করে মানিয়ে উঠতে পারেনি এখনো।তবে নয়নের ক্ষেত্রে ওর কোনো হিসেব নিকেশ খাটেনা।বড্ডো নিজের মনে হয় নয়নকে।
ভিড় বাড়তে দেখে নয়নের হাত ছেড়ে দিয়ে,ওকে বুকে আগলে নেয় রেহান।সুবিধাবাদী ভিড়ে,মানুষের আর কিছু না থাক একটা করে কনুই থাকে।আর এই কনুই গুলো বাস ট্রেন থেকে মন্দির সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।
লেকটাউনের বিশাল বড়ো ঘড়িটা জানান দেয় পাঁচটা বাজছে।লাইনের সাথে সাথে ধীর গতিতে এগিয়ে চলে দুটো শরীর,এক হয়ে..
(৯)
টালা বারোয়ারি হয়ে যখন ওরা শ্যামবাজার পাঁচমাথা পৌঁছলো তখন ঘড়িতে রাত্রি আটটা।নর্থ কলকাতার হার্ট হলো শ্যামবাজার পাঁচমাথা।সবদিক থেকে হাজারো মানুষ গিলে এনে বাস গুলো এখানে বমি করছে অনবরত।এখানকার অলিতে গলিতে একটা সাবেকি গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে।পেটুক লোকেদের জন্য আদর্শ জায়গা এটা।গোলবাড়ির কষা মাংস থেকে শুরু করে আমেনিয়া আর্সেলান কি নেই।আর এখানকার পুজো মানেই বনেদিয়ানা।
হাতিবাগান সার্বজনীন দেখে ওরা এগিয়ে চললো, মাইলস্টোনের মতো এক এক করে পার হল শোভাবাজার রাজবাড়ি, কুমোরটুলি পার্ক,আহিরিটোলা,বেনিয়াটোলা, কাশী বোস লেন,
কলকাতার জনজোয়ার,ব্যারিকেড,পুলিশ,টুনির চাদর,ফুচকাওয়ালা হাওয়াইমিঠাই,সব একে একে পার হয়ে ওরা হেঁটেই চললো একে অপরের হাত ধরে।দুটো প্রাণ,দুটো শরীর ,দুই ভিন্ন ধর্ম একাকার হয়ে মিশে গেলো কলকাতার রাস্তায়।
(১০)
-হ্যালো,জেগে আছিস?
-হ্যাঁ বল।
-তোকে ভীষণ মিস করছি রে নয়ন।ছেড়ে দে না তোর ওই প্রেমিকটাকে।আমাকে তোর প্রেমিক বানিয়ে নে।
-ওরে পাগল।প্রেমিক তো দুদিনের রে।তুই যে প্রেমিকের থেকেও বেশি কাছের।এটুকু বুঝিসনা তুই?
-বুঝি রে।কিন্তু ভীষণ রাগ হয় জানিস।
-ওসব রাগ টাগ ছাড়।তোকে একটা চুমু দেব আজকের দিনটার জন্যে।এই একটা দিন মনে করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবো জানিস।তোকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না…
-আর আমি তোকে অলরেডি ভুলে গেছি ম্যাডাম।
-খুন হবি???ফাজলামো হচ্ছে?
-হিহি,ছাড় এসব,আচ্ছা নয়ন আমরা আবার কবে একসাথে বেরোবো ?
-আর আমরা বেরোবো না রে।তাহলে হয়তো আর তোকে ছেড়ে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো না।তবে কথা দে, জীবনে কোনোদিন সপ্তমীর দিনটায় কোনো মেয়ের সাথে বেরোবি না?
-এতো নিষ্ঠুর তুই নয়ন???কাঁদবো তো?
-হ্যাঁ এতোটাই নিষ্ঠুর।কথা দিতে না পারলে ভালোবাসিস বলবি না।
-রাগছিস কেন?আচ্ছা বাবা,কথা দিলাম।
-শোন, রাখলাম।মা বকছে।ভালো থাকিস।
(১১)
দেখতে দেখতে দু বছর কেটে গেছে।রেহান এখন খড়গপুর থেকে মাস্টার্স করছে।বাড়ি প্রায় আসাই হয়না বললেই চলে।মহালয়ার পর থেকে টানা লক্ষ্মী পুজো অবধি একটা ছুটি পেয়েই তাই পালিয়ে এসেছে বাড়িতে।দক্ষিণ কলকাতায় পুজো শুরু হয় মহালয়ার পর থেকেই।মানুষের ঢল নামে রাস্তায়।ভিড় উপেক্ষা করতে অনেকেই প্রিয় মণ্ডপগুলোর দর্শন সেরে নেন আগে ভাগে।তবে দক্ষিণের জৌলুসের থেকে বরাবরই উত্তর কলকাতা প্রিয় রেহানের।একটা অদ্ভুত নাড়ির টান অনুভব করে ও।উত্তরের গলিতে গলিতে কয়েক দশক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।
এবারে সেরকম কিছু কেনেনি রেহান।পুজোর প্ল্যান বলতে স্রেফ ঘুম।সারাবছর প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে কাটে।তাই পুজোর কদিন আরাম করে কাটায় রেহান।তবে প্রতি সপ্তমীর দিন ঠিক ঘড়ি ধরে ১১ টায় বেরোয় ও।তারপর শুরু হয় ওর অভিযান।দমদম পার্ক,সেখান থেকে লেকটাউন, তারপর ফুল বাগান তারপর এক এক করে টালা বারোয়ারি ,শ্যামবাজার, হাতিবাগান,কুমোরটুলি…
নতুন নতুন মন্ডপ,নতুন পরিবেশ,লাইট,চাকচিক্যের ভিড়ে ও শুধু খুঁজে বেড়ায় একটা মুখ।পায়না।বদলে দেখতে পায় হাজারো রেহান আর নয়নকে।যারা হাতে হাত ধরে হেঁটেই চলেছে।সেই সব ফুচকাওয়ালা,ব্যারিকেড,আলোর রোশনাই কিছুতেই ওদের বিচলিত করতে পারেনা।নির্মমভাবে ওরা প্রতিটা বাধাকে পিষে দিয়ে এগিয়ে চলে,কোনো পিছুটান নেই ওদের….ক্রমশ সরু হয়ে আসে পথ।রেহান কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিঃশব্দে গিয়ে সামিল হয় এই মিছিলে আর হেঁটে চলে পৃথিবীর শেষতম হাঁটায়।তারপর একদিন উঠতি কবির চটকদার কবিতার মতোই হারিয়ে যায়।
(সমাপ্ত)