পূজার সময় নববস্ত্র পরিধান বাঙালিদের একটা সাধারণ নিয়ম। মা-ঠাকুমারা বলতেন, পুজোর সময় নতুন কাপড় পরতে হয়, শাস্ত্রে লেখা আছে। নতুন কাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বই কেনাও বাঙালির শাস্ত্রে লেখা আছে। তাই বোধহয় ঢাকে কাঠি পড়লেই বাঙালির হাতে পুজোসংখ্যা উঠে আসে।
পুজোসংখ্যা – বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক সিগনেচার। শারদসাহিত্যই ‘পুজো আসছে পুজো আসছে’ উত্তেজনাটা বাঙালির হৃদয়ে তিরতির করে বইয়ে দেয়। ঠিক কবে থেকে পুজোর আনন্দের সঙ্গে মিশে গেল সাহিত্যপাঠের অনাবিল আনন্দ? এখানেও রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল অবদান। বাঙালির হৃদয়ের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা মাখা শারদোৎসব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভেবেছিলেন পুজোর ছুটির অবকাশে বাঙালি পাঠকের হাতে একখানি মোটাসোটা পত্রিকা তুলে দেবার কথা। ১২৯৮ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর নির্দেশনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রথম সংস্করণ। এই কাগজেরই ১২৯৯ সালে ভাদ্র-আশ্বিন যুগ্মসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল পুজোসংখ্যা হিসেবে।
কলকাতায় এই পত্রিকার সম্পাদনার সহায়ক ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই সংখ্যায় কবির ‘স্বর্ণমৃগ’ নামে একটি দীর্ঘ গল্প ছিল। সেও শরতের গল্প।
আজও বাংলা সাহিত্য প্রকাশনার অন্যতম বড় আয়োজন চলে শারদোৎসবকে ঘিরে। পুজোর নতুন জামা-জুতোর মতই পুজোর বাজারের অবিচ্ছেদ্য অংশ শারদীয়া পত্রিকা। ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই হৈহৈ করে হাজির রঙবেরঙের পুজোসংখ্যা। সেই সময় এত টিভি চ্যানেল নেই, ইন্টারনেট আর সেলফোনও বিরল। কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বড়দের ছুটির বিনোদন বলতে কয়েকটি পুজোসংখ্যা আর তাই নিয়ে কি কাড়াকাড়ি! মহালয়ার আগে থেকে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেই লম্বা লাইন পত্রিকার অফিসের সেলস কাউন্টারে। যাঁরা সারাবছর বাংলা বই কিনে পড়েন না, তাঁদেরও একটা বড় অংশ কিন্তু পুজোসংখ্যা কেনেন। ক্রিসমাসের কেক, পয়লা বৈশাখের হালখাতা আর নতুন পোশাকের মত এও যেন এক বার্ষিক অভ্যেস।
পুজোসংখ্যা কেনার লম্বা লাইন পড়ত আনন্দবাজার অফিসের ঠিক উল্টোদিকে পত্রিকার সেলস কাউন্টারে। আনন্দমেলা সারাবছরই আসত, কিন্তু পুজোসংখ্যা মানে স্পেশ্যাল! তাই অধীর অপেক্ষা। সেখানে দেখা হবে ফেলুদা, কাকাবাবু-সন্তু, প্রোফেসর শঙ্কু, কিকিরা, গোগোল, অর্জুন- সব্বার সঙ্গে! থাকবে টিনটিন আর কুট্টুসও! আর সেইসঙ্গে সেইসব ঝকঝকে রঙিন কিংবা সাদাকালো ছবি। কোন গল্পে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, কোনটায় বা সুধীর মৈত্র, কোথাও কৃষ্ণেন্দু চাকী কিংবা বিমল দাস, আবার কোনটায় সমীর সরকার কি অনুপ রায়ের দুর্দান্ত সব ছবি। এইসব ছবির হাত ধরে, গল্পের সঙ্গে সঙ্গে চলত কল্পনার জাল বোনা! অসামান্য কার্টুনের সম্ভার নিয়ে থাকতেন রেবতীভূষণ, দেবাশিস দেব। শুকতারা আর কিশোরভারতীর পুজোসংখ্যাও আছে। পুজোর ক’দিন পড়ার বই শিকেয় তুলে সব পুজোবার্ষিকী পড়ে ফেলতে হবে হুড়মুড়িয়ে। সেটাই নিয়ম!
পুজোবার্ষিকীর লেখকদের মধ্যে প্রথমেই গোগ্রাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এখনও। কত যে মণি-মুক্তো আছে এইসব লেখায়। আচ্ছা ‘হ্যারিকেন’ শুনলে কী কী মনে পড়ে? আলো? ভয়াল ঝড়? নাহ, হল না। হ্যারিকেন আসলে একটা গরু। আর যে বাড়ির লোক গরুর নাম হ্যারিকেন রাখতে পারে, সেই বাড়িটি যে অদ্ভুত হবে তাতে আর সন্দেহ কি! মনোজদের বাড়ির মানুষগুলোও তাই বেশ অদ্ভুত। হাস্যরস দিয়ে জটিলতাকেও সরস বানানোর কায়দাটাকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। গোঁসাইবাগানের ভূত, পাগলাসাহেবের কবর, বনি, নবীগঞ্জের দৈত্য- কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। শীর্ষেন্দু মানেই অনাবিল হাসি, মজা আর তার মধ্যেই আবার গা-ছমছম করা জমজমাট রহস্য।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কাকাবাবু’ নিয়ে হাজির। সঙ্গে সন্তু। সবসময়। কখনও কখনও জোজো। ভারি সহজ-সরল ভাবে লেখার সঙ্গে চরম উত্তেজনা। সবসময় একটা কি-হয় কি-হয় ব্যাপার! এটাই তাঁর এসব লেখাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে। গল্পের প্লটও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই গল্পের প্রথমদিকে সন্তু কিন্তু ছিল না। শুধু কাকাবাবু আর দেবলীনা কেওনঝড়ের রাজবাড়ি গেছিল। জোজো আর সন্তু কলেজের পরীক্ষা থাকায় গেছিল পরে। পরের দিকে কাকাবাবুর অ্যাডভেঞ্চার কখনো কখনো সাদামাটা লাগলেও পুজোসংখ্যায় কাকাবাবুর উপস্থিতি না হলেই নয়।
আগে আনন্দমেলায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ও লিখতেন মন ছুঁয়ে যাওয়া অসামান্য কিছু উপন্যাস। সেরকমই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ঘরানার একটা উপন্যাস ছিল একবছর পুজোয়- ‘ইতি তোমার মা।’ অত্যন্ত আদর্শবাদী একটি পরিবার এবং তাঁদের কাছের কিছু লোকজন আর তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ কিছু লোকের সংঘাত। শেষ অবধি শুভবোধের জয় আর অশুভের পরাজয়। খুবই প্রত্যাশিত, সরলরেখায় এগোয় ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু শেষ করে খুব কষ্ট হয় আর সেই রেশ থেকে যায় অনেকদিন।
শৈলেন ঘোষের জাদু-কলমে রূপকথার গল্প পড়াও অসামান্য অভিজ্ঞতা। বন-সবুজের দ্বীপে, সোনাঝরা গল্পের ইনকা, মা এক নির্ভীক সৈনিক, গল্পের মিনারে পাখি- কত যে মন ভরানো লেখা!শৈলেন ঘোষের কলমের জাদুর সঙ্গে মিলত বিমল দাসের তুলির জাদু! আর তাতে ভর দিয়ে মন উড়ে যায় কল্পনার রাজ্যে।
এ তো গেল উপন্যাস আর গল্প! এর সঙ্গে থাকত শঙ্কু-কাহিনী, কয়েকটি কমিকস, টিনটিন-সহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলা নিয়ে একাধিক লেখা এবং সব শেষে সেই নিয়মিত ‘কী করে নম্বর বাড়াতে হয়।’ সব মিলিয়ে জমজমাট পুজোসংখ্যা! ঘুমোতে যাবার সময়েও সঙ্গী পুজোবার্ষিকী। পাশের বালিশে ঘুমোত বইগুলোও।
সুনীল-শীর্ষেন্দু-সঞ্জীব-সমরেশ বসু-বিমল কর-সমরেশ মজুমদার-পরবর্তী সময়ে বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, হর্ষ দত্ত, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদারেরা লেখনী ধরেছেন। এখনকার শারদসাহিত্য বিকশিত হচ্ছে সৈকত মুখোপাধ্যায়, সৌরভ মুখোপাধ্যায়, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, প্রচেত গুপ্ত, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমের ছোঁয়ায়।
পাঠকরা আনন্দ পান নতুন, কালজয়ী লেখা পড়ে এবং অবশ্যই নবীন লেখকদের হদিশ পেয়ে। যেমন, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গবাণী’র পুজো সংখ্যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘মহেশ’ গল্পটি। তেমনই, অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘দিগন্ত’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সন্তোষকুমার ঘোষের ‘কিনু গোয়ালার গলি’। আবার ‘দেশ’-এর পুজো সংখ্যাতেই জন্ম হয়েছিল বাঙালির প্রিয় ফেলু মিত্তিরের। এছাড়া ‘প্রসাদ’, ‘নারায়ণ’, ‘বিজলী’, ‘প্রবাসী’, ‘যমুনা’, ‘ভারতী’, ‘বসুমতী’, ‘এক্ষণ’-সহ নানা পত্রিকার পুজো সংখ্যাগুলিও ছিল নজরকাড়া।
অন্তত দু’জন লেখকের নাম করতেই নয়, যাঁদের উপন্যাস-শিল্পী হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল এই পুজো সংখ্যাতেই। প্রথম জন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন তরুণ বয়স তাঁর। সুশীল রায়ের বাড়িতে জমজমাট সান্ধ্য আড্ডা চলছে। সেখানেই সাগরময় ঘোষ উপন্যাস লেখার জন্য বললেন সুনীলকে। অগাধ জলে পড়লেন যেন তিনি। লিখবেনটা কী নিয়ে! মনে পড়ল জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’ বইয়ের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘প্লট খুঁজতে হয় না। জীবনের কোনও একটা ঘটনার কথা মনে করি।’ সুনীলও সেই পথ অনুসরণ করলেন। জন্ম হল ‘আত্মপ্রকাশ’-এর। পুজো সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘গা ঢাকা’ দিলেন সুনীল। কিন্তু প্রশংসাই জুটল আবু সৈয়দ আইয়ুবের মতো পাঠকের কাছ থেকে।
অন্য লেখকটি, নবনীতা দেবসেন। ১৯৭৬ সাল। তখন তিনি পদ্যে বেশ পোক্ত। হঠাৎ একটি চিঠি পৌঁছল তাঁর কাছে। লিখেছেন রমাপদ চৌধুরী, উপন্যাস চেয়ে। তরুণ নবনীতার মনে হল, এ যেন ‘লেখার আগেই জ্ঞানপীঠ পেয়ে যাওয়া।’ লিখলেন তিনি। জন্ম নিল, ‘আমি, অনুপম’। জন্ম নিলেন উপন্যাসশিল্পী নবনীতাও। এমনই এক পুজোসংখ্যায়।
লেখক– কৌশিক ভট্টাচার্য