‘ব্রাহ্মমুহূর্ত হল দিনের সবচেয়ে পবিত্র মুহূর্ত,..এই সময় প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর ও পবিত্র থাকে৷এই সময়টা ঘুমিয়ে নষ্ট কোরো না৷অন্ধকার কাটিয়ে সারা পৃথিবী কীভাবে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে তা বাইরে বেরিয়ে দেখ”…বাবার এই কথাগুলো শুনতে শুনতে ছোটবেলায় ঘুম ভাঙত৷একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতাম৷মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম ,বড় হলে কিছুতেই এই সময় ঘুম থেকে উঠব না৷এই সময় ই তো ঘুম সবচেয়ে গভীর হয়৷
কিন্তু আমার সে আশা আর পূরণ হল না৷পড়াশুনা শেষ হতে না হতেই চাকরি পেলাম এক মর্নিং স্কুল-এ৷ নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে আনন্দের থেকে দুঃখ বেশী হয়েছিল,আবার সকালে উঠতে হবে?
সেই সময়ে অনেকে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল,’এত মন খারাপ করিস না ৷রোজ চাকরি করতে যাওয়া ও হবে,আবার morning walk ও হবে৷ Morning walk এর উপকারিতা নিয়ে তখন সবাই আমাকে বোঝাতে লাগল৷ভাবলাম Buy one get one এর মতো ভগবান আমাকে চাকরির সাথে morning walk এর সুযোগ করে দিয়েছেন৷
প্রাতর্ভ্রমনের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা কমবেশী সবাই জানি৷আজ বরং একটু অন্য গল্প বলি৷
প্রতিদিন আমি সকাল ৫:৩০ এর মধ্যে বাস স্টপে পৌঁছে যাই৷স্বাভাবিকভাবেই এই সময় আমার অনেক প্রাতর্ভ্রমণরত মানুষের সাথে দেখা হয়৷বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েকজন মধ্যবয়সী মহিলাকে আমি রোজ দেখি,তাদের সবার হাতে একটা প্লাষ্টিক এর প্যাকেট৷প্রথমে বুঝতাম না,সকালে হাঁটতে বেরিয়ে কেন তারা প্লাষ্টিক প্যাকেট নিয়ে বেরিয়েছে৷একদিন লক্ষ্য করলাম তারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর অন্যের গাছ থেকে ফুল তুলছে৷ভীষণ অবাক হলাম!এই ভদ্রমহিলারা ফুল চুরি করছে?এই ফুল নিয়ে তারা নিজের ঘরে পুতুল ঠাকুরকে সাজাবে৷যে যত বেশী ফুল দেবে,তার ঠাকুর ও তত বেশী খুশী হয়ে মনোবাসনা পূর্ণ করবে৷হোক না সে অন্যের গাছ থেকে চুরির ফুল৷তাদের সাথে ঠাকুরের সম্পর্কটা কি Give and take policy?যত বেশী ফুল তত বেশী মনোস্কামনা পূর্ণ৷
সকালে এক বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে রোজ আমার দেখা হয়৷সদাহাস্যময় দুটি মুখ,দুজনে গুনগুন করত করতে হেঁটে চলে যায়৷জগতে কিছু কিছু মানুষ থাকে পরিচয় না থাকলে তাদের দেখলে মন ভালো হয়ে যায়৷এই দুজনকে দেখলে আমার ও এক ভালো লাগার অনুভূতি হয়৷মুখের মধ্যে অদ্ভূত শান্তি বিরাজ করে৷জগতের কোনো খারাপ ই যেন তাদের স্পর্শ করতে পারে না৷অথচ অামাদের মধ্যে এত অস্থিরতা এত অসহিষ্ণুতা কেন?
কিছু কিছু প্রাতর্ভ্রমণকারীদের দেখে মনে হত-তারা warning walk করছে৷তাদের কথোপকথন শুনে বুঝতাম৷ডাক্তারবাবু বলেছেন ‘সকালে না হাঁটলে রক্তে চিনি কমবে না,এদিকে রক্তচাপ ও উর্ধ্বগতি ৷অতএব হাঁটতেই হবে৷’তাদের দেখে বড়ো কষ্ট হয় ৷দর দর করে ঘামতে ঘামতে ,হাঁফাত হাঁফাতে তারা হেঁটে চলেছে৷বেদবাক্যের মতো ডাক্তারবাবুর উপদেশ তারা পালন করে চলেছে৷সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক ওরা …মনে মনে এই প্রার্থনা জানিয়ে এগিয়ে যাই৷
শীত,গ্রীষ্ম বারো মাস আরো এক প্রাতর্ভ্রমণকারী দলকে আমি দেখি৷অবসরপ্রাপ্ত কিছু মানুষ যারা সকালে সমমানসিকতার কিছু বন্ধু খুঁজে পেয়েছে৷তাই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে মনের রশদ জোগানোর জন্য তারা আসেন৷শারীরিক সুস্হতা ছাড়া ও তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে বন্ধুদের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া৷এদের মধ্যে কারো ছেলে মেয়ে হয়তো কর্মসূত্রে দূরে থাকে,আবার কারো ছেলেমেয়ে একই বাড়ীতে থেকেও মনের দিক তারা শত যোজন দূরে থাকে৷তাদের একাকিত্বের যন্ত্রনার কিছুটা উপশম হয় সকালে৷দিনের এই সময়টুকু তাদের শক্তি জোগায় একাকিত্বের সঙ্গে লড়াই করার৷
অার একটি ছোট্ট প্রাতর্ভ্রমণকারী কে আমি রোজ দেখি৷তার পোষাকি নাম হ্যারি৷সে তার মালিকের বড়ো আদরের,তার মালিকের কাছ থেকে সে সন্তান স্নেহ পায়৷হ্যারিকে নিয়ে তার গর্বিত প্রভু রোজ সকালে আসে৷মালিকের সাথে কথা বলে বুঝেছি,হ্যারির স্লিম থাকাটা কতটা জরুরি৷তাই টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ও দেখি ভদ্রলোক ছাতা মাথায় দিয়ে হ্যারিকে রেনকোট পরিয়ে প্রাতর্ভ্রমণ করছেন৷বেচারা হ্যারি..তার কিন্তু এক একদিন একটু হাঁটতে ইচ্ছা করে না৷কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে সর্বশক্তি দিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করে৷’হ্যারি তুমি কিন্তু খুব দুষ্টুমি করছ’…এ জাতীয় বকাঝকার পর ও যখন সে হাঁটে না,অগত্যা তার প্রভু বসার জন্য বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়৷হ্যারি তাতে খুব খুশি হয়ে লাফ দিয়ে আগেই বসে পড়ে৷মুখে তখন তার বিশ্বজয়ের অানন্দ৷এদের দেখতে দেখতে অামি রোজ রওনা দিই অামার গন্তবের দিকে, অপেক্ষা থাকে আরো একটা সুন্দর সকালের৷