শোভন ও রত্নার কিশোরী মেয়েকে এখন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হচ্ছে। মনখারাপ তাদের ছেলেরও। মাসাধিক কাল ধরে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক কলহ যে ভাবে গণমাধ্যমে লাগাতারভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে তারই পরিণতিতে এ ঘটনা ঘটেছে। পারিবারিক ঝগড়া প্রকাশ্যে আনার প্রাথমিক দায়িত্ব অবশ্যই শোভন ও রত্নার। দুজনের সঙ্গেই আমার খুব ভাল সম্পর্ক। শোভন আমার ভাইয়ের মত, রত্নাকেও বোনের মত দেখি। কিন্তু তারা যে ভাবে তাদের মনোমালিন্য ও অসন্তোষ দিনের পর দিন বসার ঘর এবং শোয়ার ঘর থেকে মিডিয়ার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তা আমার মোটেই ভাল লাগেনি। এই চাপানওতোরের এমন পরিণতি স্বাভাবিক ছিল। আমার প্রশ্ন, এটা তারা করলেন কেন? করে কী লাভ হল তাদের? ছেলেমেয়ে ও পরিবারের মানসন্মান তারা দুজনে নষ্ট করেছেন।
তৃতীয় একজন মহিলাকে ঘিরে দুজনের বিবাদে প্রথম থেকে সমানতালে উস্কানি দিয়ে গেছে কেচ্ছালোভী একশ্রেণির মিডিয়া ব্যারন। যে শালীনতা ও রুচির কথা তারা সমানে বলে চলেন সেই সরকার বাড়ির কাগজগুলিই ছিল এ ব্যাপারে প্রথম সারিতে। অথচ তাদের পেয়ারের সাংবাদিকদের অপকর্মও কম নয়। তাদের যে স্টার সাংবাদিক ও ভাষ্যকার প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের কী করা উচিৎ বা উচিৎ নয় বলে জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন তাকেই অভিযুক্ত করেছিলেন সহকর্মী এক মহিলা সাংবাদিক। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তাকে পালাতে হয়েছিল। ব্যাপারটা ম্যানেজ করার পর আবার তিনি প্রকাশ্যে আসেন। #মিটু মুভমেন্টে অনেক বাঘা বাঘা সাংবাকিদেরও নাম এসেছে। যৌন লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার মহিলারা সরব না হওয়ার আগে পর্যন্ত মালিকরা কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহিলাটির রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। এমনকি নুন্যতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেননি তাদের।
নিজের সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি গণমাধ্যমের এসব কেচ্ছা কেলেঙ্কারির ইতিহাস প্রকাশ্যে এলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন, যাদের নিজেদের ঘরেই এত অন্ধকার তারাই অন্যের পারিবারিক কেচ্ছা খুঁজতে আসরে নামলেন কেন? দিনের পর দিন প্রিন্ট ও ডিজিটাল মাধ্যমের ছজন রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান শোভন, রত্না ও বৈশাখীর বাড়িতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেন কেন? উত্তর খুব সোজা, এক, কেচ্ছা বাজারে খায়। দুই, এই ঘটনাকে সামনে রেখে তৃণমূলের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করা যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই কেচ্ছা কেলেঙ্কারি জেনে কোন লাভ নেই। এভাবে কোন দলের ভাবমূর্তিও কলঙ্কিত করা যায় না।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যাপারটা খুব সহজ অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে সামলেছেন। কোন পক্ষ না নিয়ে প্রথমে তিনি শোভনকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন তার দায়িত্ব ও পদের গুরুত্বের কথা, বুঝিয়েছেন রত্নাকেও। কিন্তু তারা কেউই তার কথা শোনেননি। আর একশ্রেণির মিডিয়া এই ব্যাপারটাতে সমানে ইন্ধন দিয়ে গেছেন। আমার প্রশ্ন, এটা কি সাংবাদিকতা? এটা কি ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম? সেটা কেমন হয় তা বুঝতে আজকের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বিগ মেডিক্যাল বাজার স্টোরিটা দেখে নিন। হুমকি, বাধাদান, তথ্য গোপনের মারপ্যাঁচ ডিঙিয়ে তদন্তমূলক সাংবাদিকতা কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে স্টোরিটা তার নমুনা। এমন স্টোরিই তো পাঠকরা চান। সরকার বাড়ির কাগজে ট্রেজারি কেলেঙ্কারি, বানতলার ঘটনা, বেঙ্গল কেমিক্যাল সংক্রান্ত স্টোরিগুলো যখন দিনের পর দিন বেরোতো তখন পাঠকরা তা আগ্রহ সহকারে পড়তেন। প্রবল পরাক্রান্ত বামফ্রন্ট সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই রিপোর্টগুলি। সে কাগজ এখন শুধু সার্কুলেশন বাড়ানোর আশায় পারিবারিক কলহের দিকে ঝুঁকেছে তা ভাবতেও অবাক লাগে।
শিক্ষিত সভ্য পাঠকরা কেউই কেচ্ছা কেলেঙ্কারির খবর পড়তে চান না। আমরা মোহন্ত-এলোকেশী সম্বাদের আমল পেরিয়ে এসেছি বহুকাল আগে। নিস্তরঙ্গ সমাজে ভদ্র পরিবারের গৃহবধুকে তারকেশ্বরের মোহন্তের ধর্ষণের সংবাদ আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু আমরা এখন আর সে সময়ে বাঁচিনা। আমাদের তো খাওয়া-পরা, বেঁচে থাকা, উন্নয়ন, অগ্রগতি, দারিদ্র, আর্থিক সংকট ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। এই পটভূমিতে পারিবারিক কলহ নিয়ে মেতে থাকার কোন পরিসরই নেই। তাহলে আমরা তাতে আটকে থাকবো কেন? তাতে আমাদের কোন লাভই নেই।
আমি জানি জবাব আসবে, এগুলো ঘটছে তাই এসবও পাঠককে জানানোর প্রয়োজন আছে। সরকার বাড়ির মিডিয়া ব্যারনদের দর্শন হল, তারা যেটা মনে করেন বা পাঠকদের জানাতে চান সেটাই খবর। তারা শোভন, রত্নার ঝগড়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাই সেটাই খবর। বড়দের অনুসরণ করে ছোটরা। অন্যান্য কাগজগুলিও সেই পথ ধরেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের খবরকে অনুসরণ করে থেকে থেকেই ভেসে উঠছে একজাতীয় চুটকি বা স্মার্ট কমেন্ট। অথচ বাংলার নানা প্রান্তে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সরকারি যোজনার সাফল্যের গল্পগুলিকে তারা কিন্তু এতটা গুরুত্ব দিয়ে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেন না। নানা ইস্যুতে নিজেদের দুর্নীতি, কর্মীদের শোষণ ও প্রভাবশালীদের তোষণের চেষ্টা নিয়েও তারা নীরব।
বাংলায় নির্ভীক সাংবাদিকতা কেচ্ছা ছাড়া এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্বাক। চুটকি মন্তব্যে এর সঙ্গে ওর ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়াটাই এখন তার কাজ হয়ে উঠেছে। অথচ ভাল ঘটনাগুলিকে তুলে ধরা, ভাল উদাহরণগুলিকে অনুসরণ করার জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা তো তাদেরই রয়েছে। দক্ষিণেশ্বরের স্কাইওয়াকে পানের পিক ফেলা নিয়ে সব গণমাধ্যমগুলি একযোগে প্রতিবাদ করেছেন, গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন তাকে তো কুর্নিশ করতেই হবে। আমার একটাই অনুরোধ, শুধু কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে আটকে থাকবেন না। খারাপ ঘটনাই বেশি ঘটে, তুলনামূলকভাবে ভাল ঘটনা কম। সেগুলিকে একটু বেশি করে তুলে ধরলে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের বাঁচার উৎসাহ বাড়ে।
কেচ্ছা মানুষ খায় ঠিকই, কিন্তু শুধু খারাপ খেয়ে তো মানুষ বাঁচে না। তার শরীর ও মন দুটোই খারাপ হয়। আর মানুষ না বাঁচলে সে খবরের কাগজই বলুন বা টিভি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া পড়বে, দেখবে বা সার্ফ করবে কে?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )