সংকটের মুহূর্তে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এই ভাবনা নিয়েই গতকাল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে হাজরা মোড়ে সবাইকে মোমবাতি মিছিলের জন্য জমায়েত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পুলওয়ামায় শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেই মিছিল হাজরা মোড় থেকে গিয়েছিল গান্ধী মূর্তির পাদদেশ অবধি। প্রকৃত দেশনেত্রীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু মানুষ সামিল হয়েছিলেন এই মিছিলে। ছাত্র, যুব, মজদুর, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষাব্রতী, উপাচার্য, বুদ্ধিজীবী সবার জন্যই ছিল এই মিছিলের অবারিত দ্বার। এটাই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর আবেদনের মূল সুর। এটা কোন বিশেষ দলের বা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর মিছিল ছিল না। এটা হল দেশের একটা সংকটজনক মুহূর্তে সবাইকে এক হয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান। কিন্তু অবাক হলাম আপনারা যারা প্রতিনিয়ত আলপিন টু এলিফ্যান্ট দেশের নানা বিষয়ে নিজেদের মতপ্রকাশ করে চলেন সেই শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চিত্র পরিচালক, গায়ক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, খেলোয়াড় তাদের প্রায় কাউকেই সেই মিছিলে আমি দেখিনি। এই মিছিলে কিন্তু কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর আসা বা না আসার নির্দেশ ছিল না। এমনকি যারা দিদির অসংখ্য অনুষ্ঠানে মঞ্চ আলো করে বসে থাকেন কিংবা সামনের সারিতে বসে তাদের উপস্থিতি জানান দেন, নানা অকর্ম কুকর্ম করেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমাশীল মনোভাবের সুযোগ নিয়ে যে গায়ক, কবি, লেখক, অভিনেতারা করেকম্মে খাচ্ছেন তাদেরও আমি মিছিলে দেখিনি।
মিছিলে ছিলেন একেবারে নেই হয়ে থাকা যাদের কেউ চেনেনা এমন সাধারণ মানুষ এবং টিএমসি করা নেতা ও কর্মীরা। এরা প্রত্যেকে এসেছেন শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কাপুরুষ সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি ধিক্কার জানাতে। অথচ ক্ষমতায় আসার পর দিদি যাদের আবার কাজকর্মে ফিরিয়ে এনেছেন তারা নির্লজ্জের মত অনুপস্থিত রইলেন। রাজ্যের প্রধান জননেত্রী যেকোন অনুষ্ঠানে এমনকি দলের নেতা, মন্ত্রী, সচিবদের উঠিয়ে যাদের সবাইকে সামনের সারিতে বসিয়ে রাখেন, জাতির এমন একটা দুঃখের দিনে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন তারা এটা ভেবে ভীষণ রাগ হচ্ছিল আমার। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় থেকে থেকে আপনাদের কতরকম বক্তব্যের ঝড়, কতরকমের প্রতিবাদ, কাল সেসব অদৃশ্য হয়ে গেল কেন? এই অদৃশ্য হওয়ার কারণ জানাতে এরপর হয়তো আপনারা নিজের মত করে একঝুড়ি অজুহাত হাজির করবেন।
৪০বছরের সাংবাদিক জীবন ও নিজের সামান্য বিদ্যাবুদ্ধিতে আমি জানি বিপদের দিনে মানুষ কাঁধে কাঁধ দিয়ে রুখে দাঁড়ায়। আবার আনন্দের দিনে কাউকে ব্রাত্য না করে সবাইকে পাশে ডেকে নেয়। জনবিচ্ছিন্নতা আপনাদের সাধারণ বোধটুকুও ভুলিয়ে দিয়েছে। অথচ দুর্গাপুজোর কার্নিভালে আপনারা দিদির পায়ের কাছে ঝাঁক বেঁধে বসেছিলেন। এটা কী শুধুই মানুষের নজরে পড়ার জন্য? কংগ্রেস, সিপিএম, ফরোয়ার্ড ব্লক সহ বিভিন্ন দল ও নানা সংগঠন তাদের নিজেদের মত করে এই ঘটনার প্রতি ধিক্কার, প্রতিবাদ ও শোক জানাচ্ছেন। সেসব উদ্যোগে তাদের ঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও সামিল হচ্ছেন। তাহলে যারা নিজেদের বাংলার জননেত্রীর কাছের মানুষ বলে প্রচার করেন তারা মোমবাতি মিছিলে অনুপস্থিত রইলেন কেন এটা আমার কাছে বিরাট ধাঁধা।
অথচ যারা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিজেদের নানা আপদ বিপদে ছুটে যান এবং কোন অনুরোধ রাখা মাত্র নিঃশর্ত সহায়তা পান তাদেরকে না দেখে আমার সত্যিই খারাপ লেগেছে। আমার মনে পড়ছিল কিছুদিন আগেই বাংলার এক কবি আসামে আক্রান্ত হওয়ার পর দিদির তার পাশে দাঁড়ানো এবং তাকে নিরাপদে রাজ্যে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার কথা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ছোট বড় নানা অনুষ্ঠানে কাজের সুবাদেই আমাকে থাকতে হয়। নজরুল মঞ্চ, নেতাজী ইন্ডোর, রবীন্দ্র সদন, সল্টলেক স্টেডিয়াম যেখানে যেদিকে তাকাই আপনাদের মুখ ভেসে ওঠে। কখনও আপনারা পাচ্ছেন পুরস্কার, কখনও দেওয়া হচ্ছে সংবর্ধনা কিংবা কখনও আপনারা গ্রহণ করছেন জীবনকৃতী সন্মান। নিজেরাই বলেন এরআগে কোন সরকার আপনাদের এত সন্মান ও মর্যাদা দেয়নি। গতকাল আপনাদের সেসব কিছুই কি মনে পড়লো না?
জানি আমার এসব কথায় আপনাদের অনেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন, কেউ করছেন রাগ, আবার অনেকেই আমার মুন্ডপাত করছেন। সত্যি বলতে কী আমার নিজেরও খারাপ লাগছে। আপনাদের অনেকের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও পরিচয় আছে, আপনাদের গুরুদের সঙ্গেও ছিল। কিন্তু এই দ্বিচারিতা কখনও দেখিনি। আপনারা নিজেদের প্রয়োজনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সামান্য অসামান্য সবরকম প্রয়োজনে নানা সুবিধা নেবেন অথচ তার একটা জরুরি আবেদনে আপনারা মুখ ফিরিয়ে থাকবেন! কীসের ভয় আপনাদের? দ্বিধাই বা কীসের? টিএমসি বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়? সত্যি বলছি বহু মানুষই আপনাদের কারও লোক বলেই ধরে না। গতকালের ঘটনায় সেটাই আবার প্রমাণিত হল। মানুষ মনে করেন আপনারা একটা সুবিধাবাদী শ্রেণী, নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী একেকসময় একেক দলে ভিড়ে যান। আপনারা কী ভেবেছিলেন এরকম একটা জরুরি পরিস্থিতিতে আপনাদের সবাইকে জনে জনে ডেকে চিঠি দিয়ে নেমন্তন্ন করা হবে? আপনাদের কী কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?
হে মহান বুদ্ধিজীবীরা, আপনারা শুনে রাখুন আপনাদের মত স্বার্থপর অনাগরিকদের সাধারণ মানুষের কোন দরকার নেই। কিছু মনে করবেন না, আপনাদের কোন নাগরিক চেতনা ও বোধই নেই তাই আপনাদের অনাগরিক বলছি। গতকাল মিছিলে যারা হাঁটছিলেন সেসব সাধারণ মানুষরা মানবিকতা ও দেশপ্রেমের বিচারে আপনাদের থেকে অনেক এগিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মোমবাতি মিছিল দেখে যারা সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন তারাই দেশের আসল নাগরিক। তারা আপনাদের মত সুবিধাবাদী নয়, তারা ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টান না।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দেখছি একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, কবি, গায়ক, লেখক, সাংবাদিক আগে যা ছিলেন এখন তার একেবারে উল্টোদিকে চলে এসে দিদির ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছেন। বামেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গোড়ার দিকে যারা দিদির সঙ্গে ছিলেন আপনাদের দাপটে তারা আজ অনেক পিছনে। কোন প্রাপ্তিযোগের আশা নিয়ে এরা দিদির ঘনিষ্ট হননি। মানুষের স্বার্থে, রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে, দলের স্বার্থে এরা হাসিমুখে পিছনের দিকে সরে গেছেন। আর আপনারা তাদের নীরব ত্যাগ এবং দিদির বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলেন!
আপনাদের সঙ্গে দিদির তো বটেই, সাধারণ মানুষের তফাৎটা কি জানেন? মিছিলের একটা ঘটনার কথা বলি। মিছিলে তার পাশে হাঁটা দোলা, চন্দ্রিমা, কাকলি, শিউলি সবাইকেই তিনি মোমবাতি ধরাতে বারণ করেছিলেন। কারণ, এতটা রাস্তা হাঁটার সময় মোমবাতির আগুনে জামাকাপড়ে আগুন লেগে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সবাইকে বারণ করলেও দিদি কিন্তু নিজে গোটা রাস্তাটা একটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে হেঁটেছেন। বারবার হাতে গলে পড়ছে গলন্ত মোম, তবুও তিনি মোমবাতি নিভতে দেননি। দিদির পিএসও স্বরূপ গোস্বামী একটা মোমবাতি শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই তার হাতে তুলে দিয়েছেন আরেকটা মোমবাতি। এই ঘটনাটা বারবার ঘটতে দেখে আমি পথের একটা চায়ের দোকান থেকে একটা ভাড় নিয়ে দিদিকে বললাম, মোমবাতিটা এই ভাড়ের মধ্যে বসিয়ে নাও, তাহলে আর হাতে মোম গলে পড়বে না। দিদি বললেন, নানা ছেড়ে দে, এটা ঠিক হবে না। এতটা রাস্তা কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তিনি এভাবেই হেঁটেছেন।
রক্তের বদলে রক্ত চাই, পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দাও ইত্যাদি উত্তেজক স্লোগান কিংবা দুর্বোধ্য কবিতা, সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব কম মানুষ বুঝতে পারে এমন কোন কমেন্ট তিনি করেননি। এই হচ্ছে আমাদের দিদি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনাদের সঙ্গে তার তফাৎটা কথায় নয় কাজে। তিনি বিশ্বাস করেন, খুন কা বদলা খুন নয়, এরকম একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে খুব সাবধানে এগোতে হবে।
দল, রঙ, পদমর্যাদা, আমন্ত্রণ, গুরুত্ব পাওয়া বা না পাওয়া এসবকিছু না দেখে দেশ বাঁচাতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। লেখক, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা যদি নিজেরা নিজেদের মত করে কোন মিছিল বা প্রতিবাদ সভা করতে চান তাও করতে পারেন। যাইহোক কিছু করুন, দেশের শত্রুদের এখন জানাতে হবে তোমাদের সন্ত্রাস আমাদের দেশকে ভাঙতে পারবেনা। ভারতবিরোধী সব শক্তির বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়ানোটাই এখন সময়ের দাবি। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই আমরা জঙ্গিদের ঠেকাতে পারবো। এই মানবপ্রাচীরের সামনে পাকিস্তান কেন বিশ্বের কোন শক্তি দাঁড়াতে পারবেনা।
জয়হিন্দ, বন্দে মাতরম।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )