আচ্ছা, প্রথম বাঙালি থুড়ি ভারতীয় কে যিনি বেলুনে উড়েছিলেন? না, এর উত্তর বোধ করি এখন আর সেরকম কেউ দিতে পারবেন না।এর কারণ রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে কজন আর মনে রেখেছেন-তার হিসাব কে রাখে?আসলে বাঙালি যে বড়োই আত্মবিস্মৃত জাতি যে!
সে যাইহোক, এবার আমরা পরিচয় করে নেব রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন কলকাতা সিমলাপল্লির কাঁসাড়িপাড়ায়।দুঃখের বিষয় তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি।যেটুকু জানা গেছে তাই বলা হচ্ছে।রামচন্দ্র ছিলেন একজন দেশভক্ত, বাঙালি দড়াবাজিকর, মল্লবীর, বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণকারী, প্যারাশূটের সাহায্যে ভূতলে অবতরণে একজন দক্ষ ব্যক্তি এবং কলকাতা গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের কর্ণধার।বলা যায় যে তিনিই প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় যিনি প্রথম বেলুনে চড়ে শূন্যভ্রমণ এবং প্যারাশূটের সাহায্যে ভূতলে অবতরণ করেছিলেন।তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্যোমযান ভ্রমণ বা বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।এইসব বেলুন ও প্যারাশূটের সাহায্যে সাহসী কার্যকলাপ করার জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে জাতীয় নায়ক হিসেবে ভূষিত হয়ে আছেন।
উনিশ শতকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘হিন্দু মেলা’-র প্রেরণাদাতা এবং ‘ন্যাশনাল পেপার’-এর সম্পাদক নবগোপাল মিত্রের ‘ন্যাশানাল সার্কাস কোম্পানি’র দড়াবাজিকর হিসাবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।রামচন্দ্র মল্লবীরের পাশাপাশি একজন ফ্লায়িং ট্রাপীজও ছিলেন।পরবর্তীকালে তিনি ‘গ্রেট ইউনাইটেড সার্কাস কোম্পানি’র পরিচালক বা কর্ণধার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।এসবের সাথে মল্লক্রীড়া বা শরীরচর্চার শিক্ষকতাও করেছিলেন চিৎপুর গভর্নমেন্ট নর্মাল স্কুলে।
তাঁর ছিল বেলুনে ওড়ার তীব্র ইচ্ছা(তখন অবশ্য এরোপ্লেন আবিষ্কৃত হয়নি)।আর সেই ইচ্ছার সূত্রপাত ঘটে কলকাতায় বিখ্যাত ব্রিটিশ অগ্রণী ব্যোমযাত্রী এবং বিমানছত্র ব্যবহারকারী পারসিভাল জি.স্পেন্সার-এর বেলুনে চড়ে শূন্যভ্রমণের একটি প্রদর্শনী দেখে।এখানে বলে নিই যে,পারসিভাল সাহেব ১৮৮৯ সালে ভারতে আসেন বেলুন প্রদর্শনী করতে এবং ১৯শে মার্চ,১৮৮৯ সালে ভারতে প্রথম বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণের প্রদর্শনীটি দেখান।এই ১৯শে মার্চের প্রদর্শনী কিনা তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও জানা যায় যে রামচন্দ্রের দেখা প্রদর্শনীটি হয়েছিল গরমকালের এক বিকেলে এবং স্পেন্সার সাহেব বেলুনে চড়ে এতোটাই উপরে(প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার ফুট)উঠেছিলেন যে তাঁর হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি বেলুনটি একটি বিন্দুর মতো ও নামার জন্যে প্যারাশুটটি একটি ন্যাকরার মতো দেখাচ্ছিল। স্পেন্সার সাহেবের এই বেলুনে ওড়ার প্রদর্শনী রামচন্দ্রের বেলুনে চড়ার সুপ্ত সাহসিকতা ও ইচ্ছাকে আরো উজ্জীবিত করে তোলে।আর সেই ইচ্ছাপূরণের জন্য তিনি স্পেন্সার সাহেবকে ধরেন এবং বেলুনের সাহায্যে শুন্যভ্রমণের কৌশল শিখিয়ে দেবার অনুরোধ করেন। অবশেষে তখনকার দিনে ৫০০ টাকা স্পেন্সের সাহেবকে দিয়ে তাঁর কাছে বেলুনে চড়ে উড়ানোর বিদ্যা শেখেন। ১০ই এপ্রিল ১৮৮৯ তারিখে স্পেনসার সাহেবের সঙ্গে তিনি বেলুনে ওড়েন।এরপর, রামচন্দ্র স্পেন্সারের কাছ থেকে ‘দ্য ভাইসরয়’ নামক বেলুনটি কিনে নিয়ে সেটির নাম দেন ‘দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা’।জানা যায় যে, রামচন্দ্র ‘ক্যালকাটা বেলুনিস্টস কোম্পানি’র বেলুনেও উড়েছিলেন।
প্রথমবার একা বেলুনে ওড়ার কাহিনীঃ-
১০ই এপ্রিলের ঘটনার পরে ২৭ শে এপ্রিল তিনি প্রথম একা বেলুনে উড্ডয়ন করবেন বলে ঘোষণা করেন। যদিও দুর্ভাগ্যবশত,সেদিন খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাঁকে তাঁর উড্ডয়নের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। অবশেষে সপ্তাহখানের পর ৪ই মে রামচন্দ্র ‘দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা’-য় নিজে প্রথম আরোহণ করেন নারকেলডাঙায় ‘ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি’র মাঠ থেকে।সেইদিন ওই মাঠে আট হাজার মানুষ এই চমৎকার প্রদর্শনীর সাক্ষী ছিলেন।এখানে বলে রাখা ভালো যে,ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির সহযোগী পরিচালক জে. রেইড বেলুনে গ্যাস ভরাট করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন।আর প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো যে, স্পেন্সার সাহেবের সাথে তাঁর বেলুনে আরোহণ নারকেলডাঙা ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির মাঠ থেকেই হয়েছিল এবং বেলুন ‘দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা’ বা তৎকালীন ‘দ্য ভাইসরয়’-এর গ্যাস ভরা হয়েছিল গ্যাস কোম্পানির পরিচালক ডি.কোটস নিভেন-এর তত্ত্বাবধানে। যাই হোক, সময় বিকেল ৫টা দশ মিনিটে সাদা স্যুট পরিধান করে,গলায় দূরবীন ঝুলিয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে টুপি নাড়িয়ে রামচন্দ্র তাঁর আরোহণ শুরু করেন।শুধু আরোহণ করেননি তিনি।বেলুন কিছুদূর উঠতেই তিনি বেলুনের মধ্যেই ব্যায়ামের নানা কৌশল দেখান।দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যায়।আসলে বেলুন আরোহীর পাশাপাশি একজন ব্যায়ামবীরও ছিলেন যে তিনি!পরাধীন দেশের একজন সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙ্গে আকাশ ছুঁয়েছে-এ যে রীতিমতো বিস্ময়কর!কিন্তু বিপত্তি দেখা দিলই।বেলুন উড়তে উড়তে একটু বেশিই ওপরে উঠে গেল। উপস্থিত অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে রামচন্দ্র আর নামতে পারবেন না বোধহয়।
দর্শকরা আশঙ্কায় ছিলেন।অনেকে চোথে দূরবীন রেখে দেখছিলেন।দর্শকরা দেখলেন যে বেলুনটি ক্রমাগত পাক খাচ্ছে। কিন্তু অবতরণের জন্যে প্যারাশুট খুলছে কই? অবশেষে প্যারাশুট খুলল।আর তাতে দর্শক আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল জয়ধ্বনি শোনা গেল-‘জয় রামবাবুকী জয়।’ বা ‘জয় রামবাবুর জয়’।
তা,সেই বেলুনটি চল্লিশ মিনিট উত্তরদিকে ভ্রমণ করার পরে সোদপুর থেকে দুই মাইল দূরে নাটাগড়ে আস্তে আস্তে প্যারাশুটসহ নেমে আসে। রামচন্দ্রের পরিচিতেরা দৌড়ে গিয়ে শরবত খাইয়ে ওঁকে স্থির করালেন।তারপর তাঁরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে,‘এত দেরি করলেন কেন বেলুন থেকে প্যারাস্যুটে লাফাতে?’ তখন রামচন্দ্র ঠোঁটে লেগে থাকা শরবত হাত দিয়ে মুছে বলেছিলেন যে, ‘আরে ভায়া আর বোলো না,যতবার নামতে যাই মনের ভেতর কেমন কেমন করে ওঠে।হাত সরিয়ে নিই প্যারাস্যুটের দড়ি থেকে। যখন দেখলাম অনেক বেশিই উঠে গেছি, তখন ‘জয় মা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।’
এই ঘটনাই এক ইতিহাস রচনা করে। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন কলকাতার প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় বেলুন আরোহী।তৎকালীন খবরের পাতার শিরোনামে উঠে এসে ভূয়শী প্রশংসা লাভ করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১১ই মে ‘দ্য বেঙ্গলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত রামচন্দ্রের এই অবিশ্বাস্যকর বেলুন ভ্রমণের কথা।
এরপরে, উৎসাহিত হয়ে তিনি জীবনে আরও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সন্ধানে ব্যোমযান ভ্রমণকেই নিজের পেশাদারীত্ব হিসেবে গ্রহণ করেন।যার ফসল হিসেবে তিনি “চ্যাটার্জী বেলুন কোম্পানী” নামে এক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।এবং ভারতের যে যে স্থানে বেলুন ওড়ানোর জন্য গ্যাস পেতে সুবিধা হত সেইসব স্থানগুলিতে তাঁর প্রদর্শনী করার আশা ছিল।তাঁর এই আশার ফলে কলকাতা, ঢাকা,এলাহাবাদ এবং আরও নানান জায়গায় বেলুন প্রদর্শনী করেন এবং এলাহাবাদ, লাহোর, লখনউ, ঢাকা এমনকি কাশ্মীর ভ্রমণের জন্যও মনস্থ করেছিলেন।আমরা বলতেই পারি যে,এ যুগের রামচন্দ্র তিনি সত্যযুগের রামচন্দ্রের অতোই বীরত্ব তাঁর মধ্যেও বর্তমান।সত্যযুগের রামচন্দ্র ছিলেন অযোধ্যার রাজা আর এযুগের রামচন্দ্র ছিলেন আকাশের রাজা।
দ্বিতীয়বার একা বেলুনে ওড়ার কাহিনীঃ-
তিনি দ্বিতীয়বার একা বেলুনে উড়েছিলেন ১৮৮৯ সালের ২৭ শে জুন এলাহাবাদের খুশরোবাগ নামক স্থান থেকে।সেদিন দশ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। প্রথমবার যেমন আবহাওয়া ও প্যারাশুটের ঝামেলা ঠিক তেমনি দ্বিতীয় উড্ডয়নের ক্ষেত্রেও তিনি যান্ত্রিক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন।যে বেলুনে চড়ে এই দ্বিতীয় প্রদর্শনী দেখাবেন বলে স্থির করেছিলেন, সেই বেলুনে অপর্যাপ্ত গ্যাস অথবা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের কারণে তা উড়তে পারছিল না।কিন্তু না, এই সচনীয় অবস্থাতেও তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির দরুন উপস্থিত দর্শকদেরকে নিরাশ করলেন না।তিনি বেলুনের সাথে সংলগ্ন ঝুড়িটিকে আলাদা করে ইস্পাতের হুফটিকে ধরে বেলুনে চড়ে শূন্যে বিচরণ করেন।যদিও এই অবস্থায় আকাশ ভ্রমণ করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তবুও বীর তিনি তাই এই সাহসী,অবিশ্বাস্য কাজটি তিনি তাঁর অসীম সাহসিকতার দরুন সম্পন্ন করেন এবং নিরাপদে মাটিতে অবতরণ করেন।
প্যারাশুটে চড়ে প্রথম অবতরণ করার কাহিনীঃ-
বেলুনের সাহায্যে আকাশে ওড়ার পর তাঁর প্যারাশূটে অবতরণ করার প্রবল ইচ্ছে জাগে।আর তাঁর এই প্যারাশূটে অবতরণের রোমাঞ্চকর প্রদর্শনীটি ঘটে ১৮৯০ এর ২২শে মার্চ বিকাল সাড়ে পাঁচটায়।তিনি তাঁর বেলুন ‘দ্য এমপ্রেস অফ ইণ্ডিয়া’-য় চড়ে কলকাতার মিন্টো পার্কের কাছে অবস্থিত টিভোলি গার্ডেনসের ৩,৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে বেলুনটির সাথে লাগানো প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণ করেছিলেন।এই প্রদর্শনীটিতে উপস্থিত ছিলেন চৈনিক রাষ্ট্রদূত মহামহিম দ্য আম্বান,বিখ্যাত ব্যোমযাত্রী এবং রামচন্দ্রের বেলুনে চড়ে ওড়ার শিক্ষক পারসিভাল স্পেন্সার, বিশবিখ্যাত চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার। প্যারাশুটের সাহায্যে সাফল্যের সাথে তিনি অবতরণ করেন এবং এই প্রদর্শনীর জন্য তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
এরপর তিনি তাঁর ব্যবহৃত বেলুনটির নাম ‘দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা ’ থেকে পরিবর্তিত করে ‘দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া’ নাম রাখেন।তিনি কলকাতা এবং এলাহাবাদের মধ্যে তাঁর প্রদর্শনী সীমাবদ্ধ আর রাখলেন না। দিল্লীতে চলে এলেন ১৮৯০ সালের নভেম্বর মাসে। তিস হাজারি নামক স্থান থেকে বেলুনের সাহায্যে আরোহণ করে প্যারাশূটের সাহায্যে সফলভাবে অবতরণ করেন। তাঁর এই কীর্তির জন্যে নবাব জালাল-উদ-দৌলাহ মুহাম্মদ মুমতিয়াজ আলি খান তাঁকে পুরস্কৃত করেন।আবার তাঁর এই সফলভাবে অবতরণের ঘটনা ঘটে ১৮৯১ সালের ৮ই মার্চ লাহোরে এবং তারপরে রাওয়ালপিন্ডিতে।এরপরের ঘটনা ঘটে ইন্দোরে সেখানকার মহারাজার অনুরোধে। ইন্দোরের মহারাজার সাথে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয়েও প্রদর্শনীটিতেও উপস্থিত ছিলেন।রামচন্দ্র তাঁর বেলুনের সাহায্যে আরোহণ ও প্যারাশূটের সাহায্যে অবতরণের এক চমকপ্রদ কৌশল দেখান।এই প্রদর্শনীর সফলতার পর, বেলুনের সাহায্যে আরোহণ ও প্যারাশূটের সাহায্যে অবতরণের ম্যাজিক অব্যাহত থাকে ফেব্রুয়ারী,১৮৯২ আগ্রার এবং ওই বছরের এপ্রিল মাসে বারাণসীর প্রদর্শনীতে।
বাঘের সাথে লড়াইঃ-
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, তিনি আরেক ইতিহাস রচনা করেছিলেন আর তা হল বাঘের সাথে লড়াই করে। সে যে সে বাঘ নয় একেবারে মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।তাঁর এই খেল তিনি দেখিয়েছিলেন গাথুরেঘাটার রাজবাড়িতে খোলা উঠোনেই। ছোট একটা খাঁচায় বাঘটাকে আনা হয়েছিল।রামচন্দ্র চড়থাপ্পড় মেরে বাঘটাকে বেশ বাগে এনেছিলেন এবং আগের বেলুনে চড়ে রোমাঞ্চকর খেলার মতোনই দর্শকের হাততালি পেয়েছিলেন এবং বাঘটিকে আবার খাঁচায় পুরে দিয়েছিলেন।
শেষ জীবন ও চির বিদায়ঃ-
তবে শোনা যায়, রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শেষ জীবনে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন এবং হিমালয় চলে যান সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে।তবে দুঃখের বিষয় যে এই রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষটির মৃত্যু হয়েছিল এক করুন ঘটনার মাধ্যমে।যে বেলুনে চড়ে দেশ ও বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছিলেন তাঁর সেই প্রিয় বেলুনে চড়েই একটি পাহাড়ের সাথে বেলুনটির ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন এবং তাঁকে তড়িঘড়ি কলকাতায় নিয়ে আনা হলেও তাঁর প্রাণ বাঁচানো যায়নি। অবশেষে,১৮৯২ সালের ৯ই অগাস্ট গোপাল চন্দ্র মুখার্জীর বাগান বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরিশেষে…..
সত্যি বলতে কি, বীরত্ব এবং আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তাঁর ডিএনএ তেই ছিল যা বংশানুক্রমে লাভ করেছিলেন।আমরা জানতে পারি দীর্ঘদিন কলকাতায় বসবাসকারী মেজর হ্যারি হবস-এর স্মৃতিকথায় যে রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা তাঁরই মত সাহসিনী ছিলেন যিনি বহুবার ব্যোমযানে আরোহণ করে শূন্যে বহু দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন। তখনকার দিনে যা রীতিমতো বিস্ময়কর!আরো জানতে পারি যে,তাঁর সেই কন্যা প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে আকাশ-ভ্রমণ করেছিলেন।
কথায় আছে যে,একজন বীরই পারেন তাঁর বীরত্বের নজির রেখে অন্যান্য বীরদের তৈরি করে যেতে। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও এই কথাটি খাটে।তাঁর বেলুনে ওড়ার সাহসী কার্যকলাপ প্রবোধ চন্দ্র লাহাকে এতোটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনিও বেলুনে চড়ার এই রোমাঞ্চকর খেলায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন।তিনি স্পেন্সার সাহেবকে পাশে রেখে ১৮৯০ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘দ্য সিটি অফ ইয়র্ক’ নামক বেলুনে চড়ে কলকাতা থেকে আকাশে আরোহণ করেন। এরপর প্রবোধবাবু ৮ই মার্চ স্পেন্সারের থেকে ‘দ্য ভাইসরয় অফ ইন্ডিয়া’ নামক বেলুন কিনে নিয়ে তাতে সাফল্যের সাথে একা চড়ে ওড়েন এবং সেই সফলতা ১৮৯২ এর মার্চ মাসে কানপুরেও দেখা গিয়েছিল।
এরপরের ব্যোমযান আরোহী যিনি রামচন্দ্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি হলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার, মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যাপক এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর জামাতা যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী।তবে তিনি কেবলমাত্র রোমাঞ্চের জন্য নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে ব্যোমজানে আরোহণ করেছিলেন।
রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ আকাশে মিলিয়ে গেলেও পৃথিবীর মাটিতে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম ও কাহিনী স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবেও। আর এবছর তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করার সময় এসেছে কারণ এবছর তাঁর প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণ করার গৌরব ১৩০তম বছর পূর্ণ করবে যে!