‘বাঙালির ছেলে শঙ্কর… এফএ পাশ করে সুবোধ ছেলের মতো কাজ করার সন্ধান করল না।’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর সেই কল্পকাহিনীই এবার পেল বাস্তবের ছোঁয়া। শঙ্করের মতোই নেশার টানে চাকরি ছেড়ে নিজের স্বপ্নের অ্যাডভেঞ্চার সফল করলেন এক বাঙালির ছেলেই। সাইকেলে চড়ে ‘চাঁদের পাহাড়’ জয় করলেন বীরভূমের উজ্জ্বল পাল। শুধু তাই নয়, প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই দুর্ধর্ষ কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি।
গত ২৭ অক্টোবর কলকাতা থেকে বাহন ‘চেতক’কে (সাইকেল) সঙ্গী করে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন উজ্জ্বল। ২৮ নভেম্বর, ২০১৮তে মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে শুরু করেন সাইকেল অভিযান। লক্ষ্য, দু’চাকার বাহন চেতকে চেপে ১০টি দেশে ভ্রমণ। গত কয়েক মাসে মিশর, সুদান, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, রোয়ান্ডা, বুরুন্ডি হয়ে অবশেষে গত ১৬ জানুয়ারি তিনি তানজানিয়ায় পৌঁছন। তারপরে ২৬ জানুয়ারি কিলিমাঞ্জারোর সর্বোচ্চ স্থান উহুরু শৃঙ্গে ওড়ালেন ভারতের তেরঙা।
বীরভূম জেলা স্কুলের ছাত্র উজ্জ্বল পরে এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যেই তাঁর দু’চাকায় সওয়ার হয়ে তিনি ভারতেই ঘুরেছেন মোট ২২ হাজার কিলোমিটার। শুরু করেছিলেন ২০১১ সালে ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ অভিযান দিয়ে। এর পর ঘুরেছেন তুরস্ক, গ্রিস, আলবেনিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ। এখনও পর্যন্ত দু’চাকায় মোট মোট ১৭টি দেশে প্রায় ৪৫ হাজার কিমি পথ পাড়ি দিয়েছেন উজ্জ্বল। সবুজের বার্তা নিয়ে গিয়েছেন আন্দামান-নিকোবরেও।
‘প্রত্যেকে জীবনে অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে তাকে বড়ো করে তুলুন’— এই বার্তা নিয়েই উজ্জ্বল পৃথিবীব্যাপী সাইকেল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন গত আট বছর ধরে। তাঁর অভিযানের নাম ‘গ্রিন অন হুইল’। উজ্জ্বল জানান, পৃথিবী জুড়ে ‘সবুজ বাঁচাও’ প্রচার-অভিযানের স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নকে সফল করতে সফরসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাইকেল। তাঁর কথায়, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব যান হল সাইকেল। তাই চিনের মতো দেশে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ সাইকেলে উপর নির্ভরশীল। আমার স্বপ্নের প্রকল্প গ্রিন অন হুইল। প্রত্যেক মানুষ সারা জীবনে অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে তাকে বড় করে তুলুন- সারা বিশ্বে আমি এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই দু’চাকায় চেপে।’
ফোনে তানজানিয়া থেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘এই অভিযান আমার স্বপ্ন ছিল। পাহাড়ে উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে। রাস্তা দুর্গম হওয়ায় বেশির ভাগ পথই সাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে হয়েছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর মাথায় জাতীয় পতাকা তুলতে পারাটা আমার কাছে গর্বের।’
পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ও আগ্নেয়গিরি শৃঙ্গ জয় করে সম্প্রতি বিশ্বরেকর্ড করেছেন সত্যরূপ সিদ্ধান্ত। আর এবার ‘অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে চিরযুগ’ এক বাঙালির তেরঙা-আখ্যানের সাক্ষী থাকল কিলি-টপ। সাইকেল নিয়ে আফ্রিকার সর্বোচ্চ শিখরে ৭০-তম সাধারণতন্ত্র দিবসে জাতীয় পতাকা ওড়ালেন আরেক বঙ্গসন্তান উজ্জ্বল। পরপরই এই কৃতিত্ব ‘ভেতো বাঙালি’ শব্দটিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে এ কথা হলফ করেই বলা যায়।