অঙ্কুরেই চেনা যায় বনস্পতিকে। ক্ষুদিরামের শৈশব এই প্রবাদ বাক্যেরই এক জ্বলন্ত প্রমাণ। তবে বনস্পতির আয়ু জোটেনি ক্ষুদিরামের কপালে। তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড, ফাঁসি, তার বয়ান – এগুলো নিয়ে যতটা আলোচনা বর্তমানে হয়, তার সিকিভাগও হয় না তাঁর শৈশব ও কৈশোর নিয়ে। অথচ তাঁর মধ্যে আগুনের ফুলকি দেখা দিতে শুরু করেছিল তাঁর শৈশব-কৈশোর থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে তাঁর নাম উচ্চারণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে করা প্রথম মামলাই (মেদিনীপুরে) বাংলা দেশে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারের করা প্রথম রাজদ্রোহের মামলা। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার প্রথম সাজাপ্রাপ্ত শহীদ। তাঁর বলিদান বহু বীরের জন্ম দিয়েছিলো।
‘‘The British newspaper, The Empire, wrote: “Khudiram Bose was executed this morning … It is alleged that he mounted the scaffold with his body erect. He was cheerful and smiling.’’
ক্ষুদিরামের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান দিতে পারলে ভারতের ঘরে ঘরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। আর সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হবে অত্যাচারী ব্রিটিশের সাজানো সাম্রাজ্য। ফাঁসির মঞ্চে প্রহরীরা যখন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখে মনে হয়েছিল যেন ক্ষুদিরাম ওই প্রহরীদের টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। হাঁসি মুখে মাথা উঁচু করে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন ক্ষুদিরাম। মুজাফ্ফরপুর থেকে অনেক দূরে কটক শহরে একটি ছোট্ট ছেলের মন আকুল হয়েছিল এই ঘটনায়। ১৯১১ সালের ১০ই আগস্ট সেই ছেলেটি তাঁর স্কুলের (Ravenshaw Collegiate School) বন্ধুদের একটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি সংক্ষেপে এইরকম – ‘‘আগামীকাল ১১ই আগস্ট। এই দিনেই ক্ষুদিরাম ফাঁসির মঞ্চে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এই দিনটি আমাদের জাতীয় শোকের দিন রূপে পালন করা উচিত। কাল আমরা সারাদিন অনশন করব।’’ সমস্ত ছাত্রই তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন এবং পরের দিন স্কুলের আবাসিক ছাত্ররা অনশন করে ক্ষুদিরামকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি ক্ষুদিরামের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর নাম ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু’। শুধু নেতাজি নয়, ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান সেদিন দেশের সমস্ত মানুষকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। আদালতে কানাই বলেছিল- ‘‘ক্ষুদিরামের ভূত এসে আমাকে জেলের মধ্যে বন্দুক দিয়ে গেছে।’’…
মেদিনীপুর শহরের হাবিবপুর এলাকার প্রসিদ্ধ এক দেবীমন্দির – দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির। মন্দিরের দেবী নাকি খুব জাগ্রতা। ভক্তরা যে যা কামনা করেন, দেবী সকলের মনস্কামনা সিদ্ধ করেন – তাই তিনি দেবী সিদ্ধেশ্বরী। সেই মন্দিরের মূর্তির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে ছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর তিনটি সন্তান ছিল, তিনটিই কন্যা – ‘অপরূপা’, ‘সরোজিনী’ ও ‘ননীবালা’। কিন্তু কোন পুত্রসন্তান তাঁর বাঁচত না। তাঁর দু’দুটি পুত্র জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায়। তাই একটি পুত্র সন্তানের কামনায় তিনি হত্যে দিয়েছিলেন দেবীর পায়ে। মন্দিরের পাশেই ছিল ‘লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী’র বাড়ি। তাঁর স্বামী ‘ত্রৈলোক্যনাথ বসু’ ছিলেন ‘নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কর্মচারী’। তাঁর আসল বাড়ি অবশ্য ছিল ‘মেদিনীপুরের কেশপুর থানার মোহবনি গ্রামে’। ত্রৈলোক্যনাথ মেদিনীপুর শহরের ‘তহশীলদার’ রূপে নিযুক্ত হয়ে সেখানে চলে এসেছিলেন। মন্দিরের পাশে কিছুটা জায়গা কিনে একটা বাড়ি তৈরি করে সেখানেই সপরিবারে বাস করছিলেন। তৃতীয় রাত্রে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয়া। সেদিন কে জানত যে দেবীর এই স্বপ্নাদেশ এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করবে। স্বপ্নাদেশ পাবার ঠিক এক বছর পরে এক সন্ধ্যায় জন্ম হয় সেই পুত্রের যিনি ‘অমর’। সাল-তারিখ ছিল ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর, দিনটা ছিল মঙ্গলবার। সেদিনের স্মৃতিচারণে সেই পুত্রের থেকে বারো বছরের বড় দিদি ‘অপরূপা’ পরে লিখেছিলেন – ‘‘সেদিন কি আনন্দ আমাদের! এর আগে পরপর দুটি ভাই মারা গেছে, আর আমরা বাঙালি ঘরের অভিসম্পাত তিন তিনটি বোন অজর অমর হয়ে বেঁচে রইলাম, এ লজ্জা রাখবার যেন ঠাঁই পাচ্ছিলাম না। তাই ছোট ভাইটি যখন হল, তখন কি আনন্দ আমাদের। নবজাতক ভাইটিকে কিনে নিলাম তিনমুঠো ক্ষুদ দিয়ে।’’ যে নারীর সন্তান বাঁচে না, তাঁর কাছ থেকে অন্য লোকে সন্তান কিনে নিলে সে সন্তানের নাকি গোত্রন্তর ঘটে, তাঁর মৃত্যুভয় কেটে যায়, সে সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে – এটা একটা প্রচলিত বিশ্বাস। তাই জন্মমুহূর্তেই তিন মুষ্টি ক্ষুদ দিয়ে মায়ের কাছ থেকে সেই ছেলেকে কিনে নিয়েছিলেন তাঁর বড়দিদি অপরূপা। ‘ক্ষুদ দিয়ে কেনা’ বলে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল ‘ক্ষুদিরাম’ – অতি সাধারণ একটা নাম। কিন্তু এই নামটাই যে একদিন অসাধারণ হয়ে উঠবে, দেশবাসীর মুখে মুখে সেই নাম মন্ত্রের মতন ছড়িয়ে পড়বে – সেই কথা সেদিন কেউ কল্পনাতেও আনেন নি। শোনা যায়, ক্ষুদিরামের জন্মমুহূর্তে আরও একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই নবজাতকের নাক আর কানের পাতা ফুটো করে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেবীর আশীর্বাদ-পূত সোনার তেঁতুলপাতা। মেয়েরা যেমন নাকে-কানে গয়না পরে, ঠিক তেমনই। এর পিছনে কারণ অন্য কিছু নয়, মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে ক্ষুদিরাম কে মেয়ে বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়রা – সেই নবজাতককে করে তুলতে চেয়েছিলেন ‘যমের অরুচি’ – এভাবে যদি মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়! সেদিন কি তাঁরা জানতেন, পোকা যেমন করে আগুনে ঝাঁপ দেয়, এই ছেলেও একদিন যেচে লাফিয়ে পড়বে মৃত্যুর আগুনে?
ক্ষুদিরামের সঠিক জন্মস্থান নিয়ে কেবলমাত্র ঐতিহাসিক ও গবেষকরা নন, তাঁর আত্মীয়রাও একমত নন। কারও মতে ক্ষুদিরামের জন্ম হয় হাবিবপুরে আর সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরেই তাঁর জন্মমুহূর্তের অনুষ্ঠান দুটি সম্পন্ন হয়েছিল। আবার কেউ বলেন, হাবিবপুরে তাঁর দুই পুত্রের মৃত্যু হবার জন্য ক্ষুদিরামের জন্মের আগেই মোহবনি গ্রামে চলে এসেছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী – সেখানেই জন্ম হয় ক্ষুদিরামের। কিন্তু যেখানেই জন্মান না কেন, তাঁর শৈশব যে হাবিবপুরেই কেটেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
নাম ক্ষুদিরাম, কিন্তু ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন ভয়ানক চঞ্চল ও দুরন্ত। ঠাকুরের কাছে মানত করে পাওয়া ছেলের ছিলেন রোগা, টুকটুকে ফর্সা ছিল তাঁর গায়ের রং, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি ছিল বেশ বড়, তাঁর পায়ে পরানো থাকত একটা সরু লোহার বেড়ি – তাঁর চেহারা দেখলেই সকলের মায়া লাগত। কিন্তু বিধাতা কোন দয়ামায়া দেখাননি তাঁর উপরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে প্রথমেই মা কে হারান ক্ষুদিরাম – ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২রা কার্তিক এক কালীপূজার রাত্রে কালীরচরণে ঠাঁই নেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। এখানেই শেষ নয়, মৃত্যুকে যেন মাথায় নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষুদিরাম। তাঁর মায়ের মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই আবার মৃত্যু এসে হানা দেয় তাঁর জীবনে। লক্ষ্মীহীন ভাঙা সংসারের হাল ধরবার জন্য ক্ষুদিরামের পিতা ত্রৈলোক্যনাথ দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন সুশীলা দেবীকে। ভেবেছিলেন মা হারা সন্তানেরা পুনরায় মায়ের ছায়া পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের কয়েকদিন পরেই একই বছরের ৩রা ফাল্গুন নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। মাতাপিতা হারানোর বেদনা বোঝার মতন বয়স তখন ক্ষুদিরামের ছিল না। আর তাঁকে কিছু বুঝতেও দেননি তাঁর বড়দিদি অপরূপা। ক্ষুদিরামের মৃত্যুর পরে তাঁর বিমাতা সুশীলা দেবী পত্রসায়রে চলে যান। প্রথমে কিছুদিন ক্ষুদিরাম আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁদের আত্মীয় অবিনাশ চন্দ্র বসু ও কৃত্তিবাস বসুর বাড়িতে। কৃত্তিবাস বসুর স্ত্রী হয়েছিলেন তাঁর ধর্মমাতা। শেষ পর্যন্ত তাঁর দিদি অপরূপা ও তাঁর স্বামী অমৃতলাল রায়, ক্ষুদিরাম ও তাঁর ছোটদিদি ননীবালাকে নিয়ে চলে আসেন তাঁদের নিজস্ব বাড়ি মেদিনীপুরের হাটগেছিয়া গ্রামে। সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই ননীবালার বিয়ে হয়ে যায়। সেই বিয়ের খরচ ও বাবার বকেয়া ঋণ শোধ করতে গিয়ে ক্ষুদিরামদের পৈতৃক বসতবাড়িটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। ভাগ্নে-ভাগ্নীদের সঙ্গে নিজের বড়দিদির বাড়িতেই বড় হয়ে উঠতে লাগলেন ক্ষুদিরাম। সাত বছর বয়সে ক্ষুদিরামকে ভর্তি করা হয় সেই গ্রামেরই গিরীশ মুখার্জির পাঠশালায়। ১৯০১ সালে চাকরীর প্রয়োজনে অমৃতলাল নিজের গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে তমলুকে চলে আসেন। সেখানকার হ্যামিলটন স্কুলে চতুর্থশ্রেণীতে ক্ষুদিরাম ও তাঁর ভাগ্নে ললিতমোহন ভর্তি হন। বয়সে ক্ষুদিরামের থেকে দুই বছরের ছোট হলেও ললিতমোহন ছিলেন তাঁর ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, বন্ধু ও সহপাঠী। তাঁর কাছ থেকেই ক্ষুদিরামের ছাত্রজীবনের অনেক ঘটনা জানা যায়। ছোটবেলা থেকেই ক্ষুদিরাম সকলের চেয়ে একেবারে অন্যরকম ছিলেন। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন ডানপিটে, বেপরোয়া ও একগুঁয়ে – তেমনি আবার পরোপকারী, বন্ধুবৎসল ও স্পষ্টবাদী। বিচিত্র গুণের অধিকারী ক্ষুদিরাম সহজেই তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষকদের মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন। দারুন প্রাণশক্তিতে ভরা এই ছেলেটির দুষ্টুমি ও দস্যিপানায় সকলে অবাক হতেন। পড়াশুনার থেকে দুষ্টুমিতেই তিনি বেশি পাকা ছিলেন ছোটবেলায়। সারাক্ষণ ভাগ্নে ললিতকে নিয়ে সারাক্ষণ নানা ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত থাকতেন। কখনও ঢিল মেরে পাখির বাসা ভেঙেছেন, তো কখনও বাড়ির ছাদ থেকে বা উঁচু গাছের ডাল থেকে লাফ দিয়েছেন, তো কখনও ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে পুকুর-নদী তোলপাড় করেছেন, আবার কখনও রণপায়ে বরযাত্রীদের সঙ্গী হয়েছিলেন। কখনও কখনও পাড়ার লোকেরা তাঁর দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকত তাঁর দিদির কাছে। কিন্তু এই মা-বাপ হারা আদরের ছোট ভাইকে শাসন করতে তাঁর হাত উঠত না। যদি বা কখনও নেহাৎ রাগের মাথায় তিনি ক্ষুদিরামকে মারতে যেতেন, মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াত তাঁর পুত্র ললিতমোহন। সে থাকতে তাঁর মামাকে মারে কে! বাধ্য হয়েই অপরূপাকে রণে ভঙ্গ দিতে হত। ক্ষুদিরামের দুরন্তপনা নিয়ে বেশ কিছু ঘটনার কথা জানা যায়। অসময়ে প্রায়ই বিভিন্ন বনে বাদাড়ে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন ক্ষুদিরাম। সাপের ভয় পেতেন না। বহুবার নিজের হাতে বিষাক্ত সাপ ধরেছিলেন। একবার তমলুক শহরে কলেরা দেখা দেয় মহামারীর রূপে। জীবনের পরোয়া না করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রোগীদের সেবা-শুশ্রূষায়। নির্ভয়ে কলেরা রোগে মৃত রোগীদের দাহ করতে যেতেন শ্মশানে। কোনকোনো দিন চার-পাঁচটা মৃতদেহও দাহ করেছেন। তাঁর সমবয়সী ছেলেরা তাঁর সাহস দেখে অবাক হতেন। একবার বন্ধুদের সাথে বাজী ধরে শ্মশানে রাত পর্যন্ত কেটেছিলেন। ফেরৎ আসার সময়ে চিহ্ন স্বরূপ নিয়ে এসেছিলেন সেখানকার তেঁতুল গাছের একটা ডাল। টিফিনের সময়ে স্কুলের গেটে খাবার বিক্রি করতে আসত এক ফেরিওয়ালা। স্কুলের ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে ভীড় করে খাবার কিনত – চালভাজা, মটরভাজা, ছোলাভাজা এইসব। একদিন স্কুলের একটি ছাত্র তাঁর কাছ থেকে খাবার কেনার পরে ফাউ হিসেবে একটু বেশি চেয়েছিল। ফেরিওয়ালা তাঁকে ফাউ না দিয়ে গাল দিয়েছিল। ক্ষুদিরাম তখন স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সাথে মার্বেল খেলতে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পৌঁছায় তাঁর কানে। তিনি খেলা ফেলে ছুটে আসেন স্কুলের গেটের কাছে। তখন টিফিন সময়ের শেষ। ফেরিওয়ালা তাঁর ঝাঁকা নিয়ে অন্যত্র যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষুদিরাম ছুটে গিয়ে এক লাথি কষিয়ে দেন খাবারের ঝুড়িতে। সব খাবার মাটিতে ছড়িয়ে একাকার কাণ্ড! সেই ফেরিওয়ালা নালিশ জানায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। ক্ষুদিরামের ডাক পরে প্রধান শিক্ষকের ঘরে। ক্ষুদিরাম একটুও ভয় পান নি। মাথা উঁচু করে সত্যি ঘটনা জানিয়েছিলেন। স্কুলের শৃঙ্খলার খাতিরে প্রধান শিক্ষক তাঁকে শাস্তি অবশ্যই দিয়েছিলেন, তবে সেটা খুবই সামান্য – সেই সঙ্গে খুশিও হয়েছিলেন তাঁর সততা ও স্পষ্টবাদিতায়। বন্ধুরা স্কুল ছুটির পরে চাঁদা তুলে ক্ষুদিরামকে মিষ্টি খাইয়েছিল। ক্ষুদিরামের এই বন্ধুপ্রীতির সঙ্গে দেশপ্রীতির একটা ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর ছাত্রজীবনের একটি ঘটনায়। দেশের বেশিরভাগ লোক তখন বিলাতী মিলের মিহি কাপড় পড়ত। ক্ষুদিরামের সহপাঠী ছিলেন ফণিভূষণ ঘোষ। তিনি একদিন দেশি মিলের মোটা কোরা জামা পরে স্কুলে এসেছিলেন। অন্য ছেলেরা তাঁর পিছনে লাগে, তাঁকে খ্যাপাতে, টিটকারি মারতে শুরু করে। শেষে দুঃখে লজ্জায় ফণিভূষণ কাঁদতে শুরু করেন। ছেলেদের হাত থেকে ফণিভূষণ কে রক্ষা করেন ক্ষুদিরাম। সবাই কে ধমক দিয়ে জোর গলায় ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, নিজের দেশে তৈরি কাপড় নিয়ে তোমরা মস্করা করছ?! এজন্য তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। এমন কাপড় পড়তে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। আমার যদি এরকম একটা জামাকাপড় থাকত, আমি তাহলে ধন্য হয়ে যেতাম। ক্ষুদিরামের কথায় নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন অন্য ছাত্ররা – তাঁরা ক্ষমা চেয়েছিলেন ফণিভূষণের কাছে। ছোটবেলা থেকেই ক্ষুদিরাম কোনদিন হারতে শেখেননি। নানা ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার স্কুলের এক শিক্ষক ছাত্রদের হাতের জোর পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। ছাত্রদের ক্লাসের টেবিলটি দেখিয়ে বলেছিলেন, দেখি তোমরা কে কত জোরে এই টেবিলে ঘুষি মারতে পারো। বড় জোর সাত-আটটা জোরে ঘুষি মেরেই সকলে হাতের ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়েছিল। এগিয়ে এসেছিলেন ক্ষুদিরাম। টেবিল কাঁপিয়ে ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারছেন তো মারছেনই – থামার আর নাম নেই। ক্লাসের শিক্ষক থেকে ছাত্র, সকলে তখন বিস্ময়ে হতবাক। একে একে যখন তিরিশটি টেবিল কাঁপানো ঘুষি মেরে ফেলেছেন ক্ষুদিরাম তখন তাঁর হাতের মুঠো ফেটে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। শিক্ষক নিজের হাতে ক্ষুদিরামের হাত আগলে ধরে তাঁকে ক্ষান্ত করেন। ওই বজ্রমুষ্টি হাত দিয়েই খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন ক্ষুদিরাম। এটি ছিল তাঁর অপর একটি শখ। বাঁশের বাঁশি দিয়ে আপন মনে সুর তুলতেন তিনি। এটা ছাড়া আরও একটি শখ ছিল বালক ক্ষুদিরামের, ডিটেকটিভ বই পড়ার নেশা। তখনকার দিনের বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের লেখক পাঁচকড়ি দে’র গল্প ছিল তাঁর খুব প্রিয়। গোয়েন্দাদের বুদ্ধি, সাহস ও মনোবল তাঁকে চমৎকৃত করত। হয়ত ভবিষ্যতের জন্য এসব কাহিনী প্রেরণা যোগাত তাঁর মনে।
ক্ষুদিরামের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে তাঁর দিদি অপরূপা লিখেছিলেন – ‘‘খুব দুরন্ত, লেখাপড়াতে মন নেই, শুধু খেলা আর খেলা। আবার যেদিন পড়ার ইচ্ছা হত, সেদিন যেন তপস্যায় বসত। মাস্টার আশু রায়ের যত কিছু শাস্তি ছিল, তার সবই হার মেনেছিল ক্ষুদিরামের একগুঁয়েমির কাছে।’’
ক্ষুদিরামের অস্ত্রগুরু বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো তাঁর এই নাবালক শিষ্যটির পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছিলেন – ‘‘যা করতে হবে বলে একবার সে স্থির করত, তা সাধনকালে যত কঠিন বলে অনুভূত হোক না কেন, বা তা সম্পন্ন করতে মৃত্যু আসন্ন হলেও সে কাজ সে অসম্পূর্ণ রেখে ছেড়ে দিত না। নেহাৎ ছোট খাটো কাজও না। হাডুডু খেলার সময় ছোটখাটো রোগা ক্ষুদিরাম সাংঘাতিক রূপে ক্ষতবিক্ষত হওয়া অবশ্যম্ভাবী জেনেও এমন মরিয়া হয়ে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ধরত যে, অপেক্ষাকৃত অনেক বলবান ছেলেও তাঁর হাত থেকে ছাড়ান পেত না। এত অল্প বয়সে ছাদ থেকে নীচে লাফিয়ে পড়া, সমস্ত রাত তেঁতুল গাছে বসে ভূত ধরা, নদীর ভীষণ স্রোতের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি তাঁর অনেক কাজ থেকে তাঁর বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যেত।’’
১৯০৪ সালে সরকারি চাকরির সুবাদে ক্ষুদিরামের ভগ্নিপতি অমৃতলাল সপরিবারে মেদিনীপুর শহরে চলে আসেন। ক্ষুদিরামও আসেন তাঁর দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে। সেখানে তাঁকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। শুধুমাত্র স্থান বা স্কুল বদল নয়, ক্ষুদিরামের জীবনের সম্পূর্ণ পালাবদল ঘটেছিল এখানে এসে। অল্পদিনের মধ্যেই নতুন স্কুলের শিক্ষক থেকে ছাত্র, সকলের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন দোহারা চেহারার এই প্রাণচঞ্চল ছেলেটি। স্কুলের ব্যায়াম শিক্ষক রামচরণ সেনের বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন ক্ষুদিরাম। ব্যায়াম শিক্ষা ও শরীরচর্চায় ক্ষুদিরাম ছিলেন সবার সেরা। প্যারালাল বারের খেলায় তাঁর জুড়ি ছিল না। সেই সময় একবার বাংলার ছোটলাট বা লেফটেন্যান্ট গভর্নর মেদিনীপুরে এসেছিলেন। তিনি ক্ষুদিরামের প্যারালাল বারের খেলা ও কলাকৌশল দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ব্যায়াম শিক্ষক রামচরণ বাবুর মাইনে স্বেচ্ছায় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পড়াশোনার চেয়ে শরীরচর্চাতেই তখন ক্ষুদিরাম বেশি মনোযোগী ছিলেন। অবশ্য দুষ্টুবুদ্ধি তাঁর তখনও কমে নি। অনন্তলাল সাহু ছিলেন তাঁর শ্রেণী শিক্ষক। কোন ছাত্রের পড়া তৈরি না হলে তিনি তাঁকে কোন কারণ জিজ্ঞেস না করেই বেঞ্চির উপরে দাঁড় করিয়ে বেত মারতেন। ছেলেরা কিছু বলার সুযোগই পেত না। একদিন তিনি ক্লাসে ঢুকে দেখেন যে ক্ষুদিরাম আগে থেকেই বেঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনন্তবাবু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কি ব্যাপার? পড়া করিসনি কেন?’ ক্ষুদিরামের প্রথম উত্তর ছিল, ‘আজ আপনি প্রথম পড়া না করার কারণ জিজ্ঞেস করলেন, স্যার’। থতমত খেয়ে অনন্তবাবু তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করেন। ক্ষুদিরাম তাঁকে জানায়, তাঁর পাশের বাড়ির একটি ছেলের কলেরা হয়েছে। তাঁরা খুব গরীব, তাঁর মা মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালান। আগের দিন সারারাত ক্ষুদিরাম সেই কলেরা আক্রান্ত ছেলেটির সেবা-শুশ্রূষাতে ব্যস্ত ছিলেন তাই পড়া করতে পারেন নি। বলা বাহুল্য এরপরে আর অনন্তবাবুর বেত তাঁর হাতে ওঠে নি। বরং শ্রদ্ধায় তাঁর মস্তক নত হয়েছিল। জানা যায়, এরপরে আর কাউকে পড়া না করার কারণ জিজ্ঞেস না করে অনন্তবাবু কোনদিন কাউকে বেত মারেন নি। ক্ষুদিরাম যখন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাজনারায়ণ বসু – পূর্ব জীবনে মহাবিপ্লবী ও পরবর্তী জীবনে মহাযোগী অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ। রাজনারায়ণ বসুর এক ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুও ছিলেন তৎকালীন সময়ে এই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। এঁরা দুইজনেই ছাত্রদের মনে সঞ্চার করার চেষ্টা করতেন দেশপ্রেমের ভাবনা, তাঁদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন ইংরেজ শাসনের কদর্য্য রূপ, তাঁরা ছাত্রদের দেশসেবার পরামর্শ দিতেন। রাজনারায়ণ বসুর চেয়েও জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এই বিষয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ব্যস্ত থাকতেন। ক্ষুদিরাম অচিরেই এই শিক্ষকের গভীর ভক্ত হয়ে ওঠেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথও সদ্য কিশোর হওয়া এই ছাত্রকে সস্নেহে নিজের কাছে টেনে নেন। ছাইচাপা আগুন চিনতে কোন ভুল করেন নি জ্ঞানেন্দ্রনাথ। ক্ষুদিরামের মনের গভীরে সুপ্ত দেশাত্মবোধকে প্রথম জাগিয়ে তোলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। তখন সারাদেশে সূচনা হয়েছে অগ্নিযুগের। অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন ঘোষের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি। মেদিনীপুর তখন বিপ্লবীদের প্রধান এক কর্মকেন্দ্র। সেখানেও অবিলম্বে গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। সেই সমিতির দায়িত্বভার ছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও হেমচন্দ্র কানুনগোর উপরে। মেদিনীপুরের বিপ্লবীদলের প্রধান দলপতি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। গুপ্ত সমিতির বিভিন্ন আখড়ায় ঘুরে ঘুরে সত্যেন্দ্রনাথ কুস্তি, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি শেখাতেন দলের ছেলেদের – বিপ্লবের মন্ত্র প্রচার করে বেড়াতেন সকলের মধ্যে। দেশজোড়া এই স্বদেশী আন্দোলনের হওয়া এসে লেগেছিল ক্ষুদিরাম বসুর মনেও। পড়াশোনায় তাঁর বিশেষ মন ছিল না। জ্ঞানেন্দ্রনাথকে তিনি মুখ ফুটে জানিয়েছিলেন তাঁর মনের কথা – জানিয়েছিলেন যে তিনি দেশের জন্য কাজ করতে চান। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ক্ষুদিরামকে নিয়ে গেলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। ক্ষুদিরামের প্রদীপ্ত চোখমুখ আর তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। খুদিরামকে তিনি কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, দেশজননী তোমার মতন সন্তান চাইছেন। আমার মন বলছে তুমি পারবে ক্ষুদিরাম। এই সত্যেন্দ্রনাথই ছিলেন ক্ষুদিরামের বিপ্লবী জীবনের দীক্ষাগুরু। কিশোর ক্ষুদিরামকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনিই নিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের বাড়ির কাছেই ছিল গুপ্ত সমিতির আড্ডা। বিপ্লবী দলে যাঁরা যোগ দিতেন, তাঁরা সেখানকার কালীমন্দিরে গিয়ে মাথায় গীতা ঠেকিয়ে এবং হাতে তরবারি নিয়ে দেবীর সামনে বাম হাঁটু মাটিতে রেখে, সিংহ যেমন ভঙ্গিতে শিকারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই ভঙ্গিতে শপথ গ্রহণ করতেন। তাঁদের প্রতিজ্ঞা ছিল, সাদা পাঁঠা বলি দিয়ে সেই রক্তে মা কে তৃপ্ত করবেন। বলে বাহুল্য, সাদা চামড়ার ইংরেজরাই ছিল সেই সাদা পাঁঠা। ক্ষুদিরামও হয়ত এমনিভাবেই বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের তত্বাবধানে সমিতির গোপন আখড়ায় আরও বেশি করে শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ইংরেজদের তাড়াতে হলে শক্তি চাই, সাহস চাই, লড়াই করতে জানা চাই। অল্পদিনের মধ্যেই লাঠি, তলোয়ার আর কুস্তিতে ক্ষুদিরাম হয়ে উঠেছিলেন সবার সেরা। তাছাড়া বন্দুক-রিভলবার চালাবার গোপন শিক্ষাও তিনি গোপনে নিয়েছিলেন। স্কুল পালিয়ে ক্ষুদিরাম গুপ্ত সমিতির নানা আখড়ায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এছাড়া তাঁর চেষ্টায় অন্যান্য জায়গায় কয়েকটা ব্যায়াম সমিতি স্থাপিত হয়েছিল। রোগীর সেবা, মৃতদেহ সৎকার, বন্যাপীড়িতদের সাহায্য করা – এ’সব জনসেবামূলক কাজ তো তার সাথে ছিলই।
মেদিনীপুরে সেবার কলেরার মড়ক দেখা দেয়, বহু লোকের মৃত্যু ঘটে। ক্ষুদিরাম মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে তাঁদের সেবা করেছিলেন। কারো বসন্ত হয়েছে – রোগীর বিছানায় সারারাত জেগে বসে থাকতেন ক্ষুদিরাম। মেদিনীপুর থেকে মাইল পাঁচেক দূরের জনার্দনপুর ভেসে গিয়েছিল কাঁসাই নদীর বন্যায়। ঘরবাড়ি ভেসে গিয়ে অসহায় মানুষ খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল। শুনে স্থির থাকতে পারেন নি ক্ষুদিরাম। তাঁর নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছিল। শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাত পেতে জোগাড় করেছিলেন টাকাপয়সা আর জামাকাপড়। সঙ্গীদের নিয়ে সেসব মাথায় করে ছুটেছিলেন জনার্দনপুরে। তাঁদের জন্য নিজের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন অস্থায়ী চালাঘর – এমনি আরও কত কি। এসব কারণে বাড়ি ফিরতে রোজই অনেক রাত হত ক্ষুদিরামের। দিদি-জামাইবাবুর যাতে অসুবিধা না হয় বা ঘুম না ভাঙে, তারজন্য একটা অদ্ভুত কৌশল করা হয়েছিল। বস্তুত কৌশলটি ছিল ক্ষুদিরামেরই সৃষ্টি। তাঁর শাগরেদ-ভাগ্নে ললিতমোহন পায়ে একটা দড়ি বেঁধে বাইরের ঘরে শুতেন। দড়ির অপর প্রান্ত থাকত জানলার বাইরে। ক্ষুদিরাম দরজার কড়া না নেড়ে সেই দড়ি ধরে টানতেন। পায়ে দড়ির টান লাগাতে ঘুম ভেঙে যেত ললিতমোহনের। তিনি উঠে চুপিসারে দরজা খুলে দিতেন ক্ষুদিরামের জন্য। তারপরে মামা-ভাগ্নে একত্রে ঢাকা দিয়ে রাখা রাতের খাবার খেতে বসতেন। একদিন বিপত্তি ঘটল। ঢাকা দেওয়া খাবার কখন যে বেড়ালে চুরি করে খেয়ে নিয়েছে সেটা ললিতমোহন টের পান নি। পরে দেখা গেল খাবার নেই। এদিকে ক্ষিদের জ্বালায় দু’জনের পেটেই আগুন জ্বলছিল। কিন্তু উপায় কি! ক্ষুদিরাম ভাগ্নেকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন – ভালোই হয়েছে। মাঝে মাঝে উপোস করা ভাল, তাতে শরীর ঠিক থাকে। বললেন তো বটে, কিন্তু ক্ষিধের জ্বালায় ঘুম আর আসে না। যত রাত বাড়তে লাগল, দু’জনের ক্ষিধেও তত পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। শেষে ক্ষিধের জ্বালায় আর টিকতে না পেরে, মামা-ভাগ্নে একত্রে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের বাড়ির পাশেই থাকতেন কুসুমকুমারী নামে এক দরিদ্র মহিলা। তিনি কলাইয়ের বড়ি বাজারে বিক্রি করে কোনমতে পেট চালাতেন। সেই রাতে কুসুমকুমারী তখনও কলাইয়ের ডাল বাটছিলেন বড়ি দেবার জন্য। অত রাতে দু’জনকে রাস্তায় দেখে তিনি বেরিয়ে এলেন। তাঁদের কারণ জিজ্ঞেস করে, সব কথা শুনে তিনি নিজের বাড়িতে ক্ষুদিরাম আর ললিতমোহনকে আমন্ত্রণ করলেন খাবার জন্য। ললিতমোহন তো একপায়ে খাড়া, কিন্তু ক্ষুদিরাম এক পাও নড়লেন না। ক্ষুদিরাম কুসুমকুমারীর হাতের দিকে ইশারা করে দেখিয়েছিলেন ললিতমোহনকে। কুসুমকুমারীর হাতে ছিল বিলাতী কাঁচের সস্তা চুড়ি। তখন বিলাতী জিনিষ বর্জনের জোর হওয়া বইছে চারিদিকে। যেকোন বিলাতী জিনিষই তখন স্বদেশী আন্দোলনকারীদের কাছে অস্পৃশ্য। সুতরাং বিলাতী চুড়ি পড়া হাতের খাবার কিভাবে খাবেন ক্ষুদিরাম? ক্ষুদিরামের সঙ্কোচের কারণ বুঝতে দেরি হয় নি কুসুমকুমারীর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘরের ভেতর থেকে একটা লোহার জাঁতি এনে ক্ষুদিরামের সামনেই ভেঙে ফেলেছিলেন দু’হাতের বিলাতী কাঁচের চুড়ি। তারপরে বলেছিলেন, আর নিশ্চই তোমরা আমার হাতে খেতে আপত্তি করবে না। এই ঘটনার পরে কুসুমকুমারীর জীবনের ধারাও বদলে গিয়েছিল। তিনিও বাড়ি বাড়ি ঘুরে মহিলাদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন দেশী তাঁতের শাড়ি, শাঁখা আর অন্যান্য স্বদেশী প্রসাধন দ্রব্য। জানা যায়, এগুলোর সঙ্গে তিনি স্বদেশী মন্ত্রও প্রচার করে বেড়াতেন বাড়ির মেয়েদের মধ্যে। যা উপার্জন করতেন, তার থেকে নিজের খরচের জন্য সামান্য রেখে বাকিটা দান করে দিতেন ক্ষুদিরামের আখড়ায়। ললিতমোহন ও ক্ষুদিরাম কুসুমকুমারীকে মাসি বলে সম্বোধন করতেন। এই মাসির কথা স্মরণ করেই পরবর্তীকালে কবি বোধহয় গান বেঁধেছিলেন –
‘‘দশ মাস দশ দিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে, মাগো!’’
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। কুখ্যাত বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে ভেঙে দু’টুকরো করে দিলেন। দুর্বল করে দিতে চাইলেন বাঙালির বিপ্লবী মনোভাবকে। ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান নিষিদ্ধ হল। কিন্তু বাঙালির কণ্ঠরোধ করা অত সহজ ছিল না। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সারা দেশ গর্জে উঠল। শোকদিবস হিসেবে ঘরে ঘরে পালিত হল অরন্ধন। চারিদিকে শুরু হল ধর্মঘট। রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন রাখীবন্ধন উৎসব। হাটে-বাজারে মাঠে-ময়দানে মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন দেশের নেতৃবৃন্দ। দিকে দিকে বিদেশি জিনিষ বর্জনের সাড়া পড়ে গেল। দোকানে দোকানে পিকেটিং শুরু হল – যাতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি জিনিষ বেচতে না পারে আর কেউ কিনতে না পারে। দেশের নির্ভীক তরুণ ছাত্রসমাজ সবার আগে এই কাজে এগিয়ে এল। সারা মেদিনীপুরও তখন অগ্নিগর্ভ। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে তৈরি হল বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ক্ষুদিরাম বসু সেখানে সবার অগ্রণী। মেদিনীপুর শহরে দশ হাজার মানুষের বিরাট মিছিল বেরোলো, ভিখারি থেকে জমিদার সবাই যোগ দিলেন সেই মিছিলে – মিছিলের পুরোভাগে ক্ষুদিরাম। স্থানীয় ছাত্র-যুবকেরা শপথ নিলেন, বিলাতী জিনিষ তাঁরা ব্যবহার করবেন না এবং যতদিন না বঙ্গভঙ্গ রদ হয়, ততদিন কোনও আনন্দ উৎসবে যোগ দেবেন না। অনেকে জুতো পড়াও ছেড়ে দিলেন।
ক্ষুদিরাম তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তখন স্কুলে যাওয়া তিনি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যেখানেই সভা হচ্ছে সেখানেই ক্ষুদিরাম। কোথাও চেয়ার-বেঞ্চ সাজাচ্ছেন, কখনও স্বদেশী প্রচারপত্র বিলি করছেন, মাঝে মাঝে বিলাতী জিনিষের দোকানে পিকেটিং করে বেড়াচ্ছেন। গুপ্ত সমিতির আড্ডায় চলছে উদ্দীপক গ্রন্থ পাঠ – ‘মুক্তি কোন পথে’, ‘বর্তমান রণনীতি’, সখারাম গণেশ দেওস্করের ‘দেশের কথা’, সেই সঙ্গে ‘মাৎসিনি’, ‘গ্যারিবল্ডি’, ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ প্রভৃতি বিপ্লবীদের জীবনী আলোচনা। সেই সময়ের এক আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। তখন বিদেশি দ্রব্য বর্জন, বিশেষ করে বিলাতী চিনি ও লবণ বয়কটের জন্য বিভিন্ন দোকানে দোকানে পিকেটিং করে বেড়াচ্ছেন মেদিনীপুরের ছাত্ররা। বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দিরেও যাতে চিনির বদলে দেশি গুড় ব্যবহার করা হয়, সেই জন্য মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে আবেদন করা হচ্ছে। তখন দেশের কাজে মনে-প্রাণে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছেন ক্ষুদিরাম। খবরের কাজে নেতাদের বক্তৃতা মন দিয়ে পড়ছেন, সেগুলোর পেপার কাটিং সংগ্রহ করে গুছিয়ে রাখছেন, অন্যদের পড়িয়ে শোনাচ্ছেন সেগুলো। সারা জেলায় বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন ব্যায়ামসমিতি ও আখড়া পরিচালনার কাজে। রণপায়ে চড়ে রাতারাতি পৌঁছে যাচ্ছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় – কখনো মুগবেড়িয়া, কখনো মহিষাদল, আবার কখনো মেদিনীপুর। এত কঠিন পরিশ্রম সহ্য হল না ক্ষুদিরামের, অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগলেন। স্নেহশীলা দিদি অপরূপার সেবা-শুশ্রূষায় আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন।
তখনও ক্ষুদিরাম পুরো সুস্থ হয়ে ওঠেন নি। জ্বরের জন্য শরীর দুর্বল। তবুও দিদির আদেশ-অনুরোধ অগ্রাহ্য করে, বাড়ির সবার চোখ এড়িয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ছেন বাড়ির বাইরে, দেশের কাজ করার জন্য। একদিন, মেদিনীপুরের অন্যতম বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো শহরের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে অসুস্থ দুর্বল শরীরে পথের মাঝখানেই ধরলেন ক্ষুদিরাম। হেমচন্দ্র যে গোপনে বিপ্লবী সমিতির জন্য অস্ত্রশস্ত্র আনেন, একথা ক্ষুদিরাম জানতেন। তাই তাঁর কাছে সটান অনুরোধ করলেন, ‘আমাকে একটা রিভলবার দেবেন?’ চমকে গেলেন হেমচন্দ্র। এইটুকু ছেলে, বয়স বড়জোর বছর চৌদ্দ হবে, সে কি করে জানলো তাঁর কাছে রিভলবার আছে?! প্রথমে ভীষণ চটে গেলেন তিনি। ভীষণ জোরে ধমক দিলেন ক্ষুদিরাম কে – ওসব কি খেলনা পেয়েছ নাকি? যাও, এসব কথা আর কখনো বলোনা। ক্ষুদিরাম নাছোড়বান্দা। বারবার বায়না করে হেমচন্দ্রকে বলতে থাকলেন, ‘দিন না আমাকে একটা রিভলবার’। হেমচন্দ্র এবারে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করবে রিভলবার নিয়ে?’ ক্ষুদিরামের সটান উত্তর – ‘সাহেব মারবো’। উত্তর দিয়েই, রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে সাহেবদের বিরুদ্ধে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে দিলেন ক্ষুদিরাম। হেমচন্দ্র হতভম্ব! তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ছেলেটির বক্তব্য শুনে, কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করলেন না। সেদিন কোনমতে ক্ষুদিরামকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে রেহাই পেয়েছিলেন হেমচন্দ্র। হেমচন্দ্রের সাথে সেটাই ছিল ক্ষুদিরামের প্রথম সাক্ষাৎকার। হেমচন্দ্র পরে নিজে এই ঘটনার বিবরণ লিখে গেছেন এভাবে –
‘‘একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি মেদিনীপুরের কোন নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তা থেকে একটু দূরে কয়েকজন ছেলে বসেছিল। তাঁদের মধ্যে থেকে ক্ষুদিরাম দৌড়ে এসে, আমার সাইকেল আটকে অত্যন্ত সহজভাবে বলেছিল, তাঁকে একটা রিভলবার দিতে হবে। তখন তাঁর বয়স আন্দাজ চৌদ্দ বছর, কিন্তু তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল মাত্র বারো কি তের বছর। দেখতে ছোটখাট পাতলা হলেও শক্ত ও দৃঢ় ছিল। আমার কাছে যে রিভলভার থাকত বা রিভলভার ব্যবহার যে শিক্ষা দেওয়া হত, এত কচি ছেলে যখন তা জানতে পেরেছে, তখন অনেকের মধ্যে কথাটা জানাজানি হয়েছে, এই সন্দেহে ভারি বিরক্ত হয়ে তাঁকে একচোট বকে দিলাম। কিন্তু তাতে সে কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে, তাঁকে যে একটা রিভলবার দিতেই হবে, তা এমন অকুণ্ঠিত আগ্রহের সঙ্গে জেদ ধরেছিল যে, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছিলাম, রিভলবার নিয়ে সে কি করবে? উত্তরে সে বলেছিল, সে একটা ‘সাহেব’ মারবে। ‘সাহেব’ মারার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে খুব উত্তেজিত হয়ে যা বলেছিল, তা শুনে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। এককথায় তাঁর ভাবটা ছিল এই যে, ভারতের উপরে ইংরেজ যে অত্যাচার করছে, তার প্রতিশোধ তাঁকে নিতেই হবে। তাঁর প্রতি আমার তখনকার হঠাৎ উদ্দীপিত মনের ভাবটা চেপে, রাগ ও বিরক্তির ভাণ করে তাঁকে বেশ ধমকে দিয়েছিলাম।
পরে সত্যেনের কাছে খোঁজ করে তাঁর সব খবর পাই। সেই হতে তাঁর ছোটখাটো কাজের ভেতর থেকে তাঁর কয়েকটি অনন্য অসাধারণ গুণের পরিচয় পেয়েছিলাম। তার একটি হচ্ছে, নিজের বা অন্যের প্ৰতি আচরিত কারো অন্যায় অত্যাচার সে সহ্য করতে পারত না।’’
১৯০৬ সালের দিকে দেশপ্রেমের একটা ছোট বই ছাপা হয়, এগুলো বিক্রির জন্য তরুণদের উপর দায়িত্ব পড়ে। ক্ষুদিরাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মেদিনীপুর মারাঠা কেল্লায় প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম বই হাতে বলছিলেন – “আসুন পড়ুন। দেশের দুর্দশার খবর জানুন। অত্যাচারী রাজশক্তির নির্মমতার নজির – এই বই আপনাদের জন্য।’’ এমন সময় একজন হাবিলদার এসে ক্ষুদিরামের হাত চেপে ধরেন। শক্তি ও বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি হলেও ক্ষুদিরাম হাবিলদারের মুখে এক ঘুষি মেরে দিলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। তৎক্ষনাৎ হাবিলদারের নাক ফেটে রক্ত বেরুলো। সত্যেন বসু ঠিক ওই সময় এসে হাজির হলেন। দেখলেন বিষয়টি। ছল করে সান্ত্বনা দিলেন হাবিলদারকে। ক্ষুদিরাম মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রইলেন। তাতে কি আর একজন দেশপ্রেমিক শান্তি পায়? দেশ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার কাজে। পুলিশের হাতে ধরা পরার ভয়ে আর কত দিন পালিয়ে থাকা যায়? মনস্থির করলেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। তাই আলীগঞ্জের তাঁতশালায় চলে এসে ধরা দিলেন। পুলিশ মারা ও নিষিদ্ধ বই বিলির অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা করা হল। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষ এই প্রথম ক্ষুদিরামকে চিনলো। ১৩ই এপ্রিল ক্ষুদিরাম মুক্তি পেলেন। ১৯০৭ সালের শেষের দিকে কালী পুজার সময় একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি ডাকহরকরাকে ছুরি মেরে গুপ্ত সমিতির জন্য টাকা সংগ্রহ করে আনেন। ১৯০৮ সালের ২৫শে এপ্রিল ক্ষুদিরাম কলকাতায় এসে পৌছালেন। গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী ‘book bomb’ তৈরী করলেন। এ বোমা বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্ডের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ড বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে, প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম প্রথম মিলিত হলেন রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁরা। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম কলকাতা রেলস্টেশনে পৌঁছোবার পর বারীণ ঘোষ তাঁদের কাছে কিংসফোর্ডকে মারার জন্য বোমা পৌঁছে দিলেন। বোমার সঙ্গে রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজঃফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো তাঁদেরকে। কারণ গোয়েন্দা সূত্রে কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা জানার পরে তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে এখানেই বদলি করা হয় কিংসফোর্ডকে। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে নিয়মিত বাড়ি ফিরে আসে কিংসফোর্ড। পাঁচ দিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উপযুক্ত সুযোগ পেলেন না। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল, রাত ৮টায় এল সেই সুযোগ। ক্লাব হাউজ থেকে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যে পথ, সেই পথের মাঝখানে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটি জায়গায় ওঁত পেতে ছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িটি তাঁদের কাছে পৌঁছোন মাত্র গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। প্রচণ্ড শব্দে বোমাটি ফাটে গাড়ির উপর। ভারতের বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে ইংরেজ শক্তির উপর এটাই ছিল প্রথম বোমা হামলা। হামলার নায়ক ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল কাজ শেষ করে ছুটতে থাকেন। কিন্তু তখনও তাঁরা জানেন না যে ভুলবশতঃ বোমা গিয়ে যে গাড়িতে পড়েছে সেই ফিটন গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন দু’জন বিদেশিনী। নিহত হন মিসেস কেনেডি আর তাঁর কন্যা ও চাকর। এরপরের ঘটনা আজ ইতিহাসের পাতায় ও সকলের জ্ঞাত।
ধরা পড়ার পর বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে নেন ক্ষুদিরাম। অন্য কোন সহযোগীর নাম বা কোন গোপন তথ্য শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেননি। মজফফরপুর আদালতে ক্ষুদিরামের বিচার কাজ শুরু হলো ০৮ই জুন ১৯০৮ সালে। কিন্তু সারা পশ্চিম বাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে কোন আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। তখন পূর্ব বঙ্গ থেকে রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলায় পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে বিচারকের অনুরোধে কালিদাস বসু নামে স্থানীয় এক আইনজীবী এগিয়ে আসেন আসামী পক্ষে। ৬ দিন চললো বিচার অনুষ্ঠান। বিচারের শুরুতেই ক্ষুদিরাম স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। কিন্তু বিচারক কর্নডফ এই স্বীকারোক্তিকে এড়িয়ে আদালতের প্রচলিত নিয়মেই বিচার করা হবে মর্মে ঘোষণা দিলেন। রংপুর থেকে যাওয়া তিন আইনজীবী ‘সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী’, ‘কুলকমল সেন’ ও ‘নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী’ দুই দিন সরকারী সাক্ষীদের জেরা করলেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম তখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিজেকে দেশমাতৃকার হাতে সমর্পণ করেছিলেন। আইনজীবীদের তিনি সহযোগিতা করেননি। উকিলদের সাথে তাঁর একটা সংলাপ ছিল এরকম –
‘‘… উকিল: তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?
ক্ষুদিরাম: হ্যাঁ, আমি একবার মেদিনীপুর দেখতে চাই, আমার দিদি আর তাঁর ছেলেপুলেদের।
উকিল: তোমার মনে কি কোন কষ্ট আছে?
ক্ষুদিরাম: না, একেবারেই না।
উকিল: আত্মীয় স্বজনকে কোন কথা জানাতে চাও কি? অথবা কেউ তোমায় সাহায্য করুন এমন ইচ্ছা হয় কি?
ক্ষুদিরাম: না, আমার কোন ইচ্ছাই তাঁদের জানাবার নেই। তাঁরা যদি ইচ্ছা করেন আসতে পারেন।
উকিল: জেলে তোমার সাথে কি রকম ব্যবহার করা হয়?
ক্ষুদিরাম: মোটামুটি ভালোই।
উকিল: তোমার কি ভয় করছে?
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) ভয় করবে কেন?
উকিল: তুমি কি জানো আমরা রংপুর থেকে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি? কিন্তু তুমি তো আমাদের আসার আগেই দোষ স্বীকার করেছো।
ক্ষুদিরাম: (স্মিতহাস্যে) কেন করবো না? …’’
এটা প্রমাণ করে যে তিনি নিজের প্রাণ রক্ষায় ছিলেন খুবই নিঃস্পৃহ। মামলার উকিলরা সওয়াল জবাবকালে যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই ঘটনার সময় ক্ষুদিরামের গায়ে একটা ভারী কুর্তা, কোর্ট, দুইটি পিস্তল এবং বেশ কিছু কার্তুজ ছিল তাই ঐ পরিমাণ ওজন নিয়ে তাঁর পক্ষে এতো ক্ষিপ্রতার সাথে বোমা ছুঁড়ে মারা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া দীনেশ (প্রফুল্ল চাকীর ডাক নাম) ক্ষুদিরামের থেকে বলিষ্ঠ গড়নের এবং বোমা বানানো জানতো সে। তাই বোমাটি প্রফুল্ল চাকীর পক্ষেই ছোঁড়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রফুল্লের আত্মহত্যাও এই দিকেই ইঙ্গিত করে। কেননা সে জানতো সে দোষী। আর দোষী বলেই ধরা পড়লে সাথে সাথে আত্মহত্যা করে সে। সুতরাং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে ক্ষুদিরামের পক্ষে ‘সন্দেহের অবকাশ’ (‘Benefit of doubt’) থেকেই যায়। কিন্তু সব কিছু বৃথা যায়। বৃথা যায় রংপুর থেকে মামলায় লড়তে যাওয়া আইনজীবীদের তৎপরতা। ঘটনার তিন মাস তের দিন পর ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করলেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবী বীর ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরামের উকিল কালিদাসবাবুর ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্টের চাক্ষুস বর্ণনা ছিল এইরূপ – ‘‘১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হইল। আমরা দরখাস্ত দিলাম যে, ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিব এবং তাঁহার মৃতদেহ হিন্দুমতে সৎকার করিব। উডম্যান সাহেব আদেশ দিলেন দুজন মাত্র বাঙালি ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিবে, তাঁর শববহন করিবার জন্য বারোজন এবং শবের অনুগমনের জন্য বারোজন থাকিবে। ইহারা কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে যাইবে। ভোর ছয়টায় ফাঁসি হইবে। পাঁচটার সময় আমি খাটিয়াখানি ও সৎকারের বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম নিকটবর্তী রাস্তা লোকারণ্য, ফুল লইয়া বহু লোক দাঁড়াইয়া আছে। সহজেই আমরা জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঢুকিতেই এক পুলিশকর্মী প্রশ্ন করিল – বেঙ্গলী কাগজের সংবাদদাতা কে? আমি উওর দিলে হাসিয়া বলিলেন যান ভিতরে। জেলের আঙিনায় প্রবেশ করে আমরা দেখিলাম, ডান দিকে একটু দূরে ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুটি খুঁটি আর একটা মোটা লোহার রড, তারই মধ্যস্থানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি, শেষপ্রান্তে একটি ফাঁস। একটু অগ্রসর হতেই দেখিলাম চারজন পুলিশ ক্ষুদিরামকে নিয়ে আসছেন। ক্ষুদিরাম আগে আগে দ্রুত পদে আসিয়া যেন পুলিশগুলোকে টেনে আনছেন। আমাদের দেখিয়া ক্ষুদিরাম হাসিল। তারপর দৃঢ়ভাবে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হইল। মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাঁহার হাত দুখানি পিছন দিকে আনিয়া দড়ি দিয়ে বাঁধা হইল। একটি সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে তাঁহার গ্রীবামূল অবধি ঢাকিয়া গলায় ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হয়ে দাঁড়াইয়া রহিল। উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখে একটি রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একজন প্রহরী মঞ্চের অন্য প্রান্তে একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দিল। ক্ষুদিরাম নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া উপরের দড়িটি নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির। আধঘন্টা পর দুজন বাঙালি ডাক্তার আসিয়া খাটিয়া ও নতুন বস্ত্র নিয়ে গেল। নিয়ম অনুসারে ফাঁসির পর গ্রীবার পশ্চাদদিক অস্ত্র করিয়া দেখা হয়, পড়বার পর মৃত্যু হইল কিনা। ডাক্তার সেই অস্ত্র করা স্থান সেলাই করিয়া, ঠেলিয়া বাহির হওয়া জিহ্বা ও চক্ষু যথাস্থানে বসিয়া, নূতন কাপড় পড়াইয়া জেলের বাহিরে আনিলেন।’’
(তথ্যসূত্র:
১- ক্ষুদিরামের ফাঁসি, সুনীল জানা, দে’জ পাবলিশিং (২০১৪)।
২- ক্ষুদিরাম, সারা বাংলা ক্ষুদিরাম শতবার্ষিকী কমিটি (২০০৮)।
৩- কে ক্ষুদিরাম?, অরিন্দম ভৌমিক, অরিন্দম’স (২০১৮)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত