৪ঠা জুলাই, ১৯৫২ সাল। মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটি অবলুপ্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক সংসদে। বলতে উঠলেন কলকাতা উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে বেলচা-কোদাল প্রতীক নিয়ে জয়ী, বাম সমর্থিত নির্দল সাংসদ— বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। শুরুতেই তীব্র আক্রমণ করলেন সরকারপক্ষকে। আক্রমণের লক্ষ্য, তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রকের মন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ। ১৫ মার্চ, ১৯৫০-এ প্ল্যানিং কমিশন তৈরি হয়। ’৫১-য় মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পরে গুলজারিলাল কমিশনের কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিরোধীদের আহ্বান জানালেন। কটাক্ষ করে মেঘনাদ বললেন, ‘‘কমিশনে তো কংগ্রেসের লোকজনই আমন্ত্রিত। কখনওই বিরোধীরা ডাক পাননি।’’ শিক্ষা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পারমাণবিক শক্তি ও দেশের নদী-বাঁধ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মেঘনাদের। সে দিন তাঁর পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে কিছু ‘জ্ঞান’ আছে জানিয়ে, কেন এ ক্ষেত্রে সব পরিকল্পনা সাংসদদের থেকে গোপন করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। ছুড়লেন মোক্ষম বাণ, ‘‘বর্তমান কার্যক্রমই বলে দিচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’’
‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিই যেন বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালল। বলতে উঠলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু— ‘‘ডক্টর সাহা ফ্যাসিবাদ শব্দটির অর্থ জানেন না। … উনি বিজ্ঞানকেও অসম্মান করেছেন।’’ পিছু হঠার পাত্র নন মেঘনাদও। ১১ই জুলাই, মেঘনাদের এ বার লক্ষ্য স্বয়ং নেহরু। জানালেন, ১৯২৭-এ বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা-র মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কংগ্রেসে’ যোগ দিতে তিনি ইটালি গিয়েছিলেন। সেই সময়ে ফ্যাসিবাদ নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা ও এই মতবাদটিকে কাছ থেকে জানার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এমনকি, সেই সময়ে বেনিটো মুসোলিনির আমন্ত্রণে এক ভোজসভায় গিয়ে দেখেছিলেন, কী ভাবে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে নামী বিজ্ঞানী, গুণী লোকজন শাসকের ‘ইয়েস ম্যান’-এ পরিণত হয়েছে। পরে কৌটিল্য-শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবণতাটিকেই ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করলেন মেঘনাদ। এ বার বললেন, ‘‘আমি বলিনি সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে গিয়েছে। বলেছি, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে চালিত হচ্ছে।’’
সংসদে তুমুল হট্টগোল শুরু হল। স্পিকার কোনও মতে থামালেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী সম্পর্কে নেহরুর মন্তব্যকেও ছেড়ে কথা বললেন না মেঘনাদ। জানালেন, এখনও বিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর ভাল যোগাযোগ। বিশ্বের বিজ্ঞানমহল তাঁকে বিজ্ঞানজগতের ‘পিছনের সারির সদস্য’ বলে মনে করে না।
এ বার নেহরু বলতে উঠে মেঘনাদকে ‘সম্মাননীয় বন্ধু’ বলে উল্লেখ করলেন। জানালেন, বিজ্ঞানী হিসেবে মেঘনাদ সাহার কাজ দেশের জন্য গর্বের। বিজ্ঞানের জগতে তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার কোনও অর্থই হয় না। এর পরেই তুখোড় বাগ্মী নেহরুর আত্মপ্রকাশ, ‘‘বৈজ্ঞানিক মেজাজ রাজনীতির ক্ষেত্রেও আসবে, এটাই প্রত্যাশিত।’’ শুধু তাই নয়, সাহার ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দ ব্যবহারের তিনি প্রতিবাদ করেননি। বরং মেঘনাদ তাঁর বিতর্কে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর চেয়ে ভাল শব্দ কেন প্রয়োগ করলেন না, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন মাত্র, দাবি করলেন তিনি। এও জানালেন, ‘অপশব্দ’ হিসেবে সাহাকেও তিনি ‘ফ্যাসিবাদী’ বলতে পারেন। এক জন বিজ্ঞানী তখনই এই শব্দ ব্যবহার করতে পারেন, যখন বিজ্ঞানের সংস্রব থেকে দূরে সরে যান তিনি।
ইটালিতে কী ভাবে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে জেনেছিলেন, সে কথা জানিয়েছিলেন মেঘনাদ। নেহরুও তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুললেন: ‘‘আমি রোমে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার নেমন্তন্ন করেছিলেন মুসোলিনি। কিন্তু তা গ্রহণ করতে পারিনি।’’ মুসোলিনিকে দূরে সরিয়ে রেখেই ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁর জানা! এ প্রসঙ্গে মুসোলিনিকে সম্বোধনটিও ভারী মজার। মেঘনাদ তাঁর বক্তব্যে মুসোলিনিকে ‘ডুচে মুসোলিনি’ বলেছিলেন। ডুচে-র অর্থ, ‘দ্য লিডার’। এই সম্বোধনেই জনপ্রিয় ছিলেন মুসোলিনি। কিন্তু নেহরু এ ক্ষেত্রেও দূরত্ব বজায় রাখতে সচেতন ভাবেই বললেন, ‘সিনর’ অর্থাৎ ‘মিস্টার’ মুসোলিনি!
বেশ কয়েকবার সাহা-নেহরু বৌদ্ধিক দ্বৈরথের সাক্ষী থেকেছে ভারতীয় সংসদ। নেহরু কিছু ক্ষেত্রে মেঘনাদকে ব্যক্তিগত কটাক্ষও করেছেন। দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ১৯৫৪-র ২০ ও ২১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলোধোনা করলেন মেঘনাদ। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, মেঘনাদ ভারত সরকারের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন চিনের মিল রয়েছে বলায়। নেহরু মেঘনাদকে ‘ইউজ়ড টু বি এ গ্রেট সায়েন্টিস্ট’ বলে কটাক্ষ করলেন। প্রত্যুত্তরে মেঘনাদ বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খুব অল্পই কিছু করেছি। কিন্তু একশো বছর পরেও আমার নাম স্মরণে থাকবে। তবে কিছু রাজনীতিবিদ কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে চলে যাবেন।’’
ভারতবর্ষের সংসদ এমনই নানা বৌদ্ধিক লড়াইয়ের সাক্ষী। তাই কলকাতা উত্তর-পূর্বের একদা-সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, প্রথম সংসদে ‘‘হর্ষ-নাট্য ও বারুদের কমতি ছিল না।’
অতীতে ও আজও বহুচর্চিত ড. মেঘনাদ সাহা ও অনিলবরণ রায় বিতর্ক, যার সূত্রপাত ১৯৩৯ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে। ‘এক নতুন জীবনদর্শন’ শীর্ষক এই প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক সাহা ভারতবর্ষের তৎকালীন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা শিল্পের বিকাশ, বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক রচনা লিখেছিলেন। ভারতের তথা প্রাচ্যের ধর্মমূলক ও আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার প্রাধান্য কী ভাবে আধুনিক শিল্প স্থাপন ও বিকাশের অন্তরায় হয়েছে, তার কিছু উদাহরণ সেখানে ছিল। অধুনা পুদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমের তৎকালীন সম্পাদক অনিলবরণ রায় প্রবন্ধটির সমালোচনা করে একটি রচনা লেখেন, যা ‘ভারতবর্ষ’-এ প্রকাশিত হয়। সেই সমালোচনায় ড. সাহার বক্তব্যের কিছু উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি, অনিলবরণ ‘‘লব্ধপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ড. মেঘনাদ সাহা’’-র হিন্দু ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মেঘনাদ সাহা এর একটি দীর্ঘ উত্তর দেন, যা ‘সমালোচনার উত্তর’ শিরোনামে মোট চার কিস্তিতে ‘ভারতবর্ষ’-এ প্রকাশিত হয়। সৃষ্টি হয় ‘‘সব ব্যাদে আছে’’ বিতর্ক। যার উত্তর আবার অনিলবরণ রায়ের তরফে এম এম দত্ত দেন; যার সর্বশেষ জবাব মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষের পাতায় প্রকাশিত করেন। ১৯৩৯-৪০ সালে এই বিতর্ক সংক্রান্ত ড. সাহার রচনাগুলি তাঁর অনন্যসাধারণ প্রজ্ঞা, হিন্দুশাস্ত্র ও বৈদিক সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তির নিদর্শন।
‘সমালোচনার উত্তর’-এর দ্বিতীয় রচনায় অধ্যাপক সাহা বলছেন, “অনেক পাঠক আমার প্রথম প্রবন্ধে ‘সব ব্যাদে আছে’ এইরূপ লিখায় একটু অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে আমি ‘বেদের’ প্রতি অযথা অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এই বাক্যটির প্রয়োগ সম্বন্ধে একটু ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে। প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা যাহা Theory of Ionisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুই-একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, ‘‘মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?’’ তিনি বলিলেন, “আমি তো কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।” অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যাবসায় প্রসূত।”
আজ যখন দেশ জুড়ে হিন্দু ধর্মের মেকি পুনরুত্থানের যুগে ধর্ম, শাস্ত্র, মিথ, ইতিহাস সব কিছুই তথাকথিত বিশ্বাসের অজুহাতে ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন ড. সাহার যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুবই জরুরি।
১৯১৭ সাল। ব্রিটিশশাসিত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড চেম্সফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন স্থাপন করলেন। কমিশনের প্রধান হিসেবে বসানো হল এম ই স্যাডলারকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন কেমন চলছে তার রিপোর্ট তৈরি করাই স্যাডলারের দায়িত্ব। যদিও কমিশনের আসল উদ্দেশ্য অন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে নজর রাখা। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রিটিশ সরকারের চোখে বিপ্লবী তৈরির আখড়া। স্যাডলার একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট ৬৭১ জনকে বিলি করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আরও দাবিদাওয়া আলাদা করে লিখে জানানো যাবে। স্যাডলার জানতেন, উত্তরপত্রে কড়া নজর থাকবে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের। উত্তরদাতাদের মধ্যে একজনের উত্তরপত্র ছিল বেশ দীর্ঘ। পঠনপাঠনের সমস্যা ছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যময় পরিবেশের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর উত্তরপত্রে লেখা ছিল,
“যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় তা হলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণির (আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণি বলে অভিহিত করছি, যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বলা হয়) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্রেরা। কোনও গণতান্ত্রিক শ্রেণির ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র এক ঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয়।”
উত্তরদাতা বছর কুড়ির এক লেকচারার মেঘনাদ সাহা। তখন, মাত্র দু’বছর আগে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন এবং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টে মেঘনাদ সাহার মতোই পিছিয়ে পড়া বা ‘নিচু জাত’-এর ছাত্রদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। কিন্তু তাঁর ও মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদি পার্থক্য ছিল, যা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর রিপোর্টে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্য আলাদা আর্থিক তহবিল গড়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। শীলের রিপোর্টে যুগ্গি, বারিক, সুবর্ণবণিক, নমঃশূদ্র, সাহাদের ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ বা কোথাও ‘লোয়ার কাস্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে মেঘনাদের রিপোর্টে এরা প্রত্যেকেই এক ছাতার তলায়, গণতান্ত্রিক শ্রেণি। নিজের রিপোর্টে পৃথক তহবিল গড়ে তোলাকে একদমই প্রশ্রয় দেননি মেঘনাদ। তিনি সবার সমান অধিকারের পক্ষে। মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বর্তমান ভর্তুকিপুষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সরাসরি বিপক্ষে। তিনি সেই সময়েই বুঝেছিলেন, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভেদ টেনে এবং ভর্তুকি দিয়ে কোনও এক বিশেষ শ্রেণির উন্নতির সম্ভাবনাকে মেরে ফেলায় দেশের সত্যিকারের উন্নতি সম্ভব নয়। ২৮ বছর পরে, দেশভাগের সময়েও মেঘনাদ সাহার গলায় ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টেরই সুর। তখন তিনি আর ২০ বছরের লেকচারার নন। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। কিন্তু ল্যাবরেটরির বাইরে এসেও তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর সাম্যের গান। স্বাধীনতার বছর দুই আগে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকায় মেঘনাদ লেখেন,
“দেশভাগের ফলে ভারতে থাকা মুসলমানরা হিন্দুরাজের পদদলিত হয়ে থাকবে এবং সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত হবে বলেই মনে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকেও একটা কড়া জাতীয়তাবাদের রেখা দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হবে, যা সংখ্যালঘু শ্রেণির মধ্যে ডেকে আনবে সীমাহীন দারিদ্র্য।”
পরের বছর ফের একই পত্রিকায় লেখেন,
“সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে, অশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে হলে, রোগ-জরা-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।”
‘আওয়ার ন্যাশনাল ক্রাইসিস’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে মেঘনাদের মূল বক্তব্য ছিল, সবাইকে কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের ভূমিকায় অথবা পরবর্তী কালে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-সংঘটকের ভূমিকায়, সবাইকে একই সম্ভাবনার সুযোগ করে দেওয়া, জাতি-ধর্ম ভুলে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাইকে সমান কর্মযজ্ঞে শামিল করা, যা সাম্যবাদের গোড়ার কথা, তা-ই ছিল মেঘনাদ সাহার জীবনের মূল জীবনদর্শন। কিন্তু তাঁর এই জীবনদর্শনের উৎস কোথায়? উত্তর জানতে পৌঁছে যেতে হবে বিশ শতকের গোড়ার শেওড়াতলি গ্রামে, মেঘনাদ সাহার জন্মস্থলে। অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের সেই গ্রাম ব্রিটিশ শাসনের সময় তখন সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে। সেখানেই ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর মেঘনাদ সাহার জন্ম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১০ কিলোমিটার দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। যাওয়া-আসার দুস্তর সমস্যা। তাই বিদ্যালয়ের কাছাকাছি বসবাসকারী ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন কিশোর মেঘনাদ। বাড়ির গোয়ালঘর দেখাশোনা, বাসন মাজার মতো কাজ মেঘনাদকে করতে হত। তবেই জুটত খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই। যদিও কাজগুলো মনের আনন্দেই করতেন তিনি। কারণ, তার বদলে মিলত পড়াশোনার সুযোগ। কিন্তু অনন্ত দাসের বাড়িতে ছিল জাতপাত নিয়ে চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। মেঘনাদ ‘নিচু জাত’-এর ছেলে। তাই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। নির্দেশ ছিল, নিজের বাসনপত্র গ্রামের পুকুর থেকে নিজেকেই ধুয়ে মেজে আনতে হবে। বাড়ির বাসনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেই কেলেঙ্কারি। পড়াশোনার জন্য সব মুখ বুজে মেনে নিলেও সংবেদনশীল মেঘনাদের মনে গ্রামের দিনগুলি দাগ কেটে গিয়েছিল। নিজের কৈশোরের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, জাতিভেদ, অসাম্য আসলে সমাজের এক গভীর অসুখ। জাতিভেদ প্রথার কদর্য দিকটা আরও ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে। তিনি তখন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত সাইকেলে চড়ে গৃহশিক্ষকতা করে বেড়ান। বাকি সময়টা ডুবে থাকেন গণিতে। মেধা বৃত্তি পাওয়ায় তখন সহপাঠীদের সম্ভ্রমের পাত্র মেঘনাদ।
তবে এক্ষেত্রে অন্য একটি দৃষ্টিকোণও আছে। মেঘনাদ সাহার কন্যা শ্রীমতী চিত্রা রায় জানিয়েছিলেন, “আমার বাবা মেঘনাদ সাহা বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন ঠিকই, তবে ড. অনন্ত দাশের বাড়িতে যখন অাশ্রিত হিসাবে পড়াশোনা চালিয়েছিলেন, তখন সে রকম কিছু ঘটেনি। ড. দাশ বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, ড. দাশকে আদর্শ রেখে, বাবা নিজের বাড়িতেও অনেক পড়ুয়াকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। মা’কে লেখা একটি চিঠিতে এই কথা বলেছেন। ড. দাশের পরিবারে সবাইকেই নিজের বাসন নিজে মাজতে হত, শুধু আশ্রিতদের নয়। আমরা ইলাহাবাদ থেকে কলকাতায় আসার পর, ড. দাশের ছেলের আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল এবং তিনি আমার দিদিকে বাংলা ভাষার শিক্ষা দিতেন। আসলে এই অতিনাটকীয় (ও বহুচর্চিত) গল্পটি আমার বাবার মৃত্যুর পরে চালু হয় এবং সে সব পড়ে আমার মা খুবই ব্যথিত হতেন। … বাবার সব কাজের পিছনে বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতার চেয়েও বড় কারণ ছিল ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা। যে কারণে বাবা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভ্য হয়ে পুলিন দাশের মতো বিপ্লবীর কাছে লাঠিখেলা, ছোরাখেলা শেখেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের মেসবাড়িতে জ্ঞান ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন ধরের সঙ্গে থাকতেন এবং বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) সংস্পর্শে এসেছিলেন। পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়ায়, বাবাকে ইন্ডিয়ান ফিনানশিয়াল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি এবং তখনই বিজ্ঞানের আঙিনায় প্রবেশ। এর পর সার্থক গবেষণা করে ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান জগতের সঙ্গে যুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। হেনরি নরিস রাসেল-এর সঙ্গে তাঁর পত্রবিনিময়ে এই দ্বন্দ্বের কথা জানা যায়।”
কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গিয়েছিল সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। মেঘনাদের ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের ভাবগতিক এমনই ছিল। এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল মেঘনাদের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বৈদিক ধর্মের প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা সামাজিক বিভেদের প্রতি বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে তিনি পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন।
১৯৯০ সালের ১৪ই জানুয়ারি, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা জানিয়েছিলেন, যে দিন তাঁর বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় মেঘনাদ সাহা বিপ্লবী স্বদেশী আন্দোলনকারী নেতৃত্ববৃন্দের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং শৈলেন ঘোষ। অবশ্য বিপ্লবীদের গুঢ় আন্দোলনপন্থার কারণে ইতিহাসবিদগণের পক্ষে মেঘনাদ সাহার বিপ্লবী আন্দোলনের বিস্তারিত জানা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎকালীন আইরিশ রিভোলিউশনারি সিন ফেইন পার্টির স্বাধীনতা আন্দোলন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। জার্মানির সহায়তায় আইরিশ অভ্যুত্থানকারীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু গুপ্ত সংগঠন তৈরি করেছিল। সিন ফেইন বাঙালিদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল কারণ শত্রুপক্ষ ছিল একই –ব্রিটিশ, যারা এই দুটি জাতির মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশ কায়েম করে রেখেছিল। আইরিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির আন্দোলন নানা দিক থেকেই উপমহাদেশীয় গান্ধীবাদী আন্দোলনের সাথে তুলনীয় ছিল। মেঘনাদ সাহা এই ধরনেরই সংগঠন অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তরের সাথে জড়িত ছিলেন।বিপ্লবী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি(বাঘা যতীন নামে অধিক পরিচিত) এবং পুলিন দাসের মতো নেতার সংস্পর্শে এসে তরুণ মেঘনাদ সাহা সশস্ত্র প্রতিরোধে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এবং এর ফলে ব্রিটিশ নানাবিধ চাপে তাঁর জীবন ওষ্ঠ্যাগত হয়ে যায়। একটি ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে একজন পদার্থবিদের এধরনের বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে যাওয়া খুবই বিরল ঘটনা। বাঙালিদের সংগঠন অনুশীলন সমিতির সাথে ১৯১৫ এর দিকে পাঞ্জাবের বিপ্লবী সংগঠন গদর পার্টির বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে এই দলটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত কানাডা ও সানফ্রান্সিসকো প্রবাসী বিভিন্ন বিপ্লবী নেতার মাধ্যমে। বার্লিনে অবস্থিত গদর বাহিনীর কিছু সদস্য বাঘা যতীনকে অবহিত করেন যে জার্মানির কাইজার উইলহেম ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং জার্মানি এই বিপ্লবীদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে আগ্রহী। এই কর্মকাণ্ডের তদারকিতে ইন্ডিয়ান রেভোলিউশন কমিটি নামে বার্লিনে একটি সংগঠন তৈরি হয়। কাইজারের মারফত বাঘা যতীন জানতে পারেন হেনরী নামের অস্ত্রবাহী একটি জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে ফিলিপাইন হয়ে সুন্দরবনে ভিড়বে।মেঘনাদ সাহা এবং যাদুগোপাল মুখার্জিকে এই জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে ১৯১৫ এর ২রা জুন, হেনরী যখন সাংহাইয়ের বন্দরে ভেড়ে, তখন ব্রিটিশ এবং ফরাসী বাহিনী জাহাজটিতে তল্লাশি চালিয়ে সব অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যায়। জাহাজটি সুন্দরবনে না এসে জার্মানিতে ফিরে যায় এবং মেঘনাদ সাহা খালি হাতে ফিরে আসেন।
মেঘনাদ সাহার বিপ্লবী চরিত্রটি বাঙালি নেতৃত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিল, যারা গান্ধীবাদী আন্দোলনের বিপরীতে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বু্দ্ধ হয়েছিল। সাহার বেড়ে ওঠার সময়কালীন রাজনৈতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তাঁর ক্যারিয়ারে প্রবলভাবে ছাপ রেখে গিয়েছিল। তাঁর চারিত্রিক বৈচিত্র্য তাঁর জীবনযাত্রার বৈচিত্র্য থেকেই উঠে এসেছে। বাঙালি ও ভারতীয় তরুণসমাজের কাছে তিনি হতে পারেন অন্যতম কাছের উদাহরণ এবং সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
১৯১৫ সালে যখন স্নাতকোত্তর পাশ করেন মেঘনাদ সাহা, তখন বিশ্ব জুড়ে পদার্থবিদ্যায় নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা তাঁর মধ্যে এক উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। ছাত্রাবস্থায় সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। যোগ্য সহপাঠীর উপস্থিতিও মেঘনাদকে অনেকটাই উৎসাহ জুগিয়েছিল। পরের বছরই নব্য প্রতিষ্ঠিত রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে লেকচারার পদে যোগদান। শুরু হয় পড়ানোর পাশাপাশি নিজের গবেষণা। মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান গবেষণার প্রথম দিকের বিষয় ছিল তাত্ত্বিক ও ফলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান। একাধিক বিষয়ে গবেষণা করলেও তিনি বিখ্যাত হন তাপজনিত আয়নন বা thermal ionization বিষয়ক তত্ত্বের জন্যে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান গবেষণা নির্ভেজাল পদার্থবিদ্যা ও শুষ্ক গাণিতিক সমীকরণের সমাহার। কিন্তু ছোটবেলা থেকে জাতপাতের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সামাজিক বিভাজনের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ যে সাহার তাপজনিত আয়ননের গবেষণার মূলে নিহিত ছিল, তা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজির (এমআইটি) বিজ্ঞানের ইতিহাসের গবেষক আভা শূর। ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ডিসপার্সড রেডিয়েন্স— কাস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মেঘনাদ সাহা সূর্য বা কোনও নক্ষত্রে স্থিত পদার্থগুলির পরমাণুর আয়ননের ঘটনা ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর জাতপাত বিরোধী সমাজভাবনার প্রেরণায়। নক্ষত্রের মধ্যকার পরমাণুগুলি প্রচণ্ড তাপ ও চাপে যেমনটা ব্যবহার করে, তা তাদের নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী। নিজস্ব ইচ্ছে অনুযায়ী। নক্ষত্রের প্রভাবে নয়। অধ্যাপক সাহার চিন্তাভাবনায় গোটা সমাজটাই একটা নক্ষত্র, যে সব সময়ই তার মধ্যকার পদার্থের পরমাণুগুলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পরমাণুগুলি নিজের ইচ্ছে মতোই জীবন কাটাবে, যেমনটা কাটিয়েছিলেন মেঘনাদ। শেওড়াতলির অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রাম থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া, আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা, আরও পরে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হওয়া— তাঁর নিজের জীবনটাই যেন নক্ষত্রের প্রচণ্ড তাপ ও চাপের সম্মুখীন হওয়া এক পরমাণুর গল্প, যে কিনা চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিধিনিষেধে প্রভাবিত হয়নি। বরং তাঁর স্বাধীন ইচ্ছে, নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই বেছে নেওয়ার প্রত্যয় প্রভাবিত করেছে গোটা সমাজকে। তবে এই সমস্ত কিছুই খুব সহজে হয়েছিল, এমনটা নয়। তাপ আয়নন বিষয়ক গবেষণা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আনকোরা লেকচারারকে ভবিষ্যতের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়ার মঞ্চ তৈরি করে দিলেও পদে পদে এসেছিল বাধা, যা ক্রমশই তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল এক নতুন সত্তার দিকে— রাজনীতিক মেঘনাদ সাহা। ১৯২০ সালে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যাপক আলফ্রেড ফায়োলারের গবেষণাগারে কাজ করতে যান মেঘনাদ। উদ্দেশ্য, নিজের তাপ আয়নন তত্ত্বকে হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখা। সেখানে থাকাকালীন জ্যোতির্বিদ হিলবার্ট হল টার্নার মেঘনাদকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট উইলসন অবজ়ারভেটরির প্রধান জর্জ এলারি হেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তখন একমাত্র মাউন্ট উইলসন অবজ়ারভেটরির গবেষণাগারেই মেঘনাদের তত্ত্বকে পরীক্ষা করে দেখার মতো যন্ত্রপাতি ছিল। ১৯২১ সালের ৯ই জুলাই, হলকে চিঠি লিখে মেঘনাদ জানান যে, তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপ আয়নন বিষয়ক গবেষণা প্রমাণ করে দেখার ক্ষমতা নেই। হল যদি তাঁকে সেই সুযোগ দেন, তা হলে তিনি নক্ষত্রের অন্দরমহলের পরিবেশ নিয়ে আরও কাজ করতে পারবেন। হলের কাছ থেকে কখনও উত্তর পাননি মেঘনাদ। ১৯৮৯ সালের মে মাসে ডিভরকিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সেই প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে হলের হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন হেনরি নরিস রাসেল। সেই চিঠিতে মেঘনাদের তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে মাউন্ট উইলসন অবজ়ারভেটরির আগামী কয়েকটি গবেষণা প্রকল্পের উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সাহাকে সশরীরে উপস্থিত থেকে সেই কর্মকাণ্ডে শামিল হতে কেউই আমন্ত্রণ জানাননি। এর পরেও রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সাহা। সামান্য একটি কোয়ার্টজ়ের স্পেকট্রোগ্রাফের জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। যথারীতি সেই সাহায্যও আসেনি। পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকা এই ঘটনাগুলি মেঘনাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি যতই প্রতিভাধর হন না কেন, আসলে এক পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী। ১৯১৯ সালটি শুধু মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এ বছরটি ভারতীয় মুক্তিকামী আন্দোলনের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার ঠিক পর-পরই এইবছর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বিতর্কিত রাওলাট আইন জারি করে। এই আইনের আওতায় যে কোনও ব্যক্তিকে সন্দেহের বশে এবং কোনো রকম আপিল করার সুযোগ প্রদান ছাড়াই আটক করে রাখা যাবে এবং তাদের আইনি সুবিধাবঞ্চিত করা যাবে। এই আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আন্দোলনের তীব্রতা বাংলা এবং পাঞ্জাবেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই আইনের প্রেক্ষিতেই মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ চালু করেন। ব্রিটিশ সরকার সেই সময় যেখানে সম্ভব হয়েছে কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে।
১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসারের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি নৃশংস ঘটনা ঘটে। বি্রটিশ কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ার একটি নিরস্ত্র প্রতিবাদের উপর নির্বিচারে গুলি করার আদেশ দিলে প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। মেঘনাদ সাহা এর প্রতিবাদে লেখালেখি করেন। বিদ্যমান নৃশংসতায় মনোবল হারিয়ে তিনি পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেন। নিজের জ্ঞান দিয়ে তিনি ভারতের উন্নয়নকল্পে মনোনিবেশ করেন।
অন্য অনেক বিদুষকের বিপরীতে মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষের নানাবিধ সমস্যা যেমন: নদী ব্যবস্থাপনা, রেলওয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারতের বিদ্যুৎব্যবস্থা এসব নিয়ে লেখালেখি করেন এবং ভারতজুড়ে এসব বিষয়ে সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাঁর সারা জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলো জাতির জন্য বিজ্ঞান সচেতনতা এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমেই জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। ১৯৩১ সালে তিনি Academy of Sciences of the United Provinces of Agra and Oudh প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালে তিনি এর প্রেসিডেন্ট নিয়োজিত হন।
কলেজে পড়ার সময়ে জাতিভেদের শিকার হওয়া, সেই স্মৃতি পিছনে ফেলে বিজ্ঞানী হিসেবে কেরিয়ার গড়ার পথেও পদে পদে পশ্চিমি বিজ্ঞানীদের নিস্পৃহ মনোভাবের সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশের প্রকৃত অবস্থার কথা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধি করা। ছোটবেলার অন্ধকার শেওড়াতলার গ্রাম্য জীবন, কলেজে পড়ার সময়ে খাস কলকাতা শহরে কুসংস্কারের ছায়া তাঁকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে দেশের নিচু তলার মানুষের দুর্দশা তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ১৯১৩ সালে প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রেরণায় গড়ে তোলা বন্যাত্রাণ প্রকল্পের দিনগুলি। মেঘনাদ বুঝেছিলেন এই সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য দেশকে আগে প্রস্তুত করতে হবে। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। দেশে শিল্প গড়লে তবেই তা ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আবার বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ফলাফলে সমৃদ্ধ হবে শিল্প। তবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড তখনই সম্ভব হবে, যখন সম্পদের বণ্টনে সমতা আসবে। দেশের সম্পদ বণ্টনের দায়ভার বিজ্ঞানীদের কাঁধে থাকে না, থাকে দেশচালক আমলাদের হাতে। তাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলীয়ান দেশচালকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন মেঘনাদ। ধীরে ধীরে সেই গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তোলার দিকে ঝুঁকছিলেন তিনি।
১৯৩৫ থেকে ’৫১— এই ১৬ বছর রাজনীতিক ও বিজ্ঞান প্রশাসক মেঘনাদকে আত্মপ্রস্তুতির মঞ্চ গড়ে দেয়। সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকার হাত ধরে দেশের বিবিধ সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান নির্দেশ এবং ১৯৩৮ সালে তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসুকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসের জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যার সূত্রপাত। এর পরে ঘটে দেশভাগের মতো ঘটনা। ভিটেহারা মানুষদের দুরবস্থা সামনে থেকে দেখেন তিনি। কলকাতায় তখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভিড়। শরণার্থীদের সাহায্যার্থে একাধিক সম্মেলন, আলোচনাচক্রে যোগ দিয়ে মানুষের দুর্দশার কথা আরও বেশি করে উপলব্ধি করেন অধ্যাপক সাহা। এই সমস্ত ঘটনাই তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। ১৯৫১ সালের সাধারণ নির্বাচনে মেঘনাদ সাহা নির্দল প্রার্থী রূপে দাঁড়িয়ে বিপুল জয় পান। উল্লেখযোগ্য হল, মেঘনাদ সাহার নির্বাচনী ইস্তাহারে তাঁকে ‘সাম্যবাদী’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। তাঁর প্রচারচিহ্ন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুই প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, কোদাল ও বেলচা। সেখানেও তিনি তথাকথিত নিচুতলার মানুষেরই প্রতিনিধি।
বিজ্ঞানী মেঘনাদ, প্রাবন্ধিক মেঘনাদ সম্পর্কে জানার সবচেয়ে ভাল উপায় তাঁর নিজের লেখাগুলিই। দীর্ঘদিন ধরে মেঘনাদ সাহার সুযোগ্য শিষ্য শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় তাঁর মাস্টারমশাইয়ের লেখাগুলি সযত্ন সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছেন। রাজনীতিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা জানার ক্ষেত্রে জ্যোতির্ময় গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে লেখা শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়েরই বই ‘মেঘনাদ সাহা ইন পার্লামেন্ট’ একটি আকরগ্রন্থ।
কিন্তু কেমন ছিলেন ব্যক্তি মেঘনাদ?
তাঁর ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায়, স্পষ্টবক্তা হিসেবে ‘কুখ্যাতি’ ছিল মেঘনাদের। আসলে কাজের জায়গায় কোনও রকম কুঁড়েমি তিনি পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা তাঁকে ভয় পেত। কিন্তু কড়া শিক্ষকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এক ছাত্রদরদি নরম মনের মানুষ। ব্রজেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় জাপানি বোমাতঙ্ক ছড়িয়েছে, অধ্যাপক সাহার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। সকালে চা খেয়ে পড়াশোনা, গবেষণার কাজ শুরু করায় অভ্যস্ত ছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। কিন্তু অধ্যাপক সাহার বাড়ির রান্নার লোক অনেকটাই দেরি করে আসতেন। ছাত্রের অসুবিধের কথা ভেবে নিজে হাতে চা তৈরি করে খাওয়াতেন তিনি। তবে হঠাৎ করে রেগে যাওয়াও ছিল মেঘনাদের স্বভাবের একটি অঙ্গ। আসলে, অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী মানুষটি সারা জীবনই বঞ্চনা ও গঞ্জনার শিকার— যা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর স্বভাবেও। এমনকি নিজের বিবাহেও সহ্য করতে হয়েছিল গঞ্জনা। মেঘনাদ সাহার বউমা বিশ্ববাণী সাহার লেখা থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালে রাধারাণী রায়ের সঙ্গে বিবাহ হয় মেঘনাদের। বিয়েতে তাঁর পাঞ্জাবির তলা দিয়ে ছেঁড়া গেঞ্জি দেখা যাচ্ছিল। পাত্রের দুর্দশা দেখে বিয়েতে প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন রাধারাণীর ঠাকুমা। আসলে গবেষণায় মগ্ন মানুষটি তখনও জীবনে বিশেষ টাকাকড়ি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বিদ্যাচর্চায় খামতি থাকেনি। গবেষণাগার থেকে ফিরেও বইয়ের জগতে ডুবে যেতেই পছন্দ করতেন। বাড়িতে ছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। মেঘনাদ সাহার তৃতীয় কন্যা চিত্রা রায় সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, অধ্যাপক সাহা যখন গবেষণার কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতেন, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’ থেকে পড়ে শোনাতে হত তাঁকে। অধ্যাপক সাহার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে জায়গা পেয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের বিশাল সম্ভার— যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাক্সিম গোর্কি, নুট হামসুন, লিয়ো টলস্টয়ের লেখা বইপত্র। অধ্যাপক সাহার এই সাহিত্যপ্রেম দানা বেঁধেছিল ইলাহাবাদে থাকাকালীন। ইলাহাবাদে সেই সময়ে একটা বাংলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যমণি ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছিলেন যোগেনচন্দ্র গুপ্ত। এঁদের সান্নিধ্য অধ্যাপক সাহার কাছে ছিল বিজ্ঞান ও রাজনীতির বাইরে এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতো। সাহিত্য পাঠ ও চর্চা ছাড়াও দেশবিদেশের পত্রিকা সংগ্রহে তাঁর উৎসাহ ছিল। বাড়ির ছোটদের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ম্যাগাজ়িন থেকে বিভিন্ন ছবি দেখাতেন, অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি পড়ে শোনাতেন। ছোটদের জন্য কলমও ধরেছিলেন কয়েক বার, যা প্রকাশিত হয় যোগেনচন্দ্র গুপ্তের ‘শিশুভারতী’ পত্রিকায়। সাহিত্য ছাড়াও অধ্যাপক সাহা উৎসাহী ছিলেন ভাষাতত্ত্ব চর্চায়। বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আকর্ষণের সূত্রপাত ঢাকার স্কুল থেকে। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশন আয়োজিত এক পরীক্ষায় তিনি সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে জার্মান ভাষার সঙ্গে পরিচয়। এর পরে সারা জীবনই যখন সুযোগ পেয়েছেন বিভিন্ন ভাষা চর্চা করে গিয়েছেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজা শঙ্কর গুহর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাষা চর্চা করতেন নিয়মিত। সেই বিষয়ে একাধিক বই সংগ্রহ করাটাও তাঁর নেশা ছিল। অধ্যাপক সাহার বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। এক বার পাড়ার ছেলেরা তাঁর বাড়িতে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে তিনি তাদের নিজের ঘরের বিশাল বইয়ের সম্ভার দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এই ভাবেই সরস্বতীর আরাধনা করি। চাঁদা তুলে পুজোয় বিশ্বাস করি না।’ আসলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সরস্বতী পুজোয় ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের অপমান তিনি কোনও দিন ভুলতে পারেননি।
ধীরে ধীরে প্রশাসকের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া মেঘনাদ সাহার তাত্ত্বিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষতি করেছিল বলে বিজ্ঞান মহলের একাংশের ধারণা। যদিও দেশের মানুষের স্বার্থে মেঘনাদ বারবারই চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীর গ্ল্যামারকে ঝেড়ে ফেলে ‘আইভরি টাওয়ার’ থেকে নেমে আসতে এবং বিজ্ঞানকে সর্বসাধারণের কাজে ব্যবহার করতে। তাপ আয়ননের মতো গবেষণাপত্র আর তিনি প্রকাশ করেননি। ফলে আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান গবেষণা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়েছেন।
একবার-দুইবার নয়, পাঁচবার নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তাঁকে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেকার কথা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লেডিজ গ্রুপ’-এর সদস্যদের একটি অত্যন্ত জটিল গোলকধাঁধা থেকে বের করে এনেছিলেন এক ‘কালা আদমি’ বাঙালি। তাঁর হাতে থাকা ‘জাদুদণ্ড’ দিয়ে! সেই বাঙালির জাদুকাঠির ছোঁয়া আর ‘খুল্ যা সিম সিম’ মন্ত্রেই ‘চিচিং ফাঁক’ হয়ে গিয়েছিল! গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন হার্ভার্ডের ‘লেডিজ গ্রুপ’-এর সদস্যরা। তাতে যদিও সেই ‘কালা আদমি’ বাঙালির কপাল খোলেনি! পাননি বলব না। বলব, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নোবেল পুরস্কারের জন্য যদিও সেই ‘কালা আদমি’র নাম মনোনীত হয়েছিল পাঁচ বার। কিন্তু প্রতি বারই শেষ মুহূর্তে প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় তাঁর নাম। প্রতি বারই সেই ‘মেঘনাদবধ’-এর কাব্য! অথচ ‘মেঘের আড়াল’ থেকে ‘যুদ্ধ’ করা সেই মেঘনাদ সাহার অঙ্কই গত ১০০ বছর ধরে গোলকধাঁধার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ‘আলো’ দেখাচ্ছে। হার্ভাডের ওই মহিলা সহকারী বিজ্ঞানীরা তখন আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের তারাগুলির দিকে তাকাতে শুরু করেছিলেন। সেই তারাগুলি কতটা উজ্জ্বল আর তাদের সেই উজ্জ্বলতায় কেন বাড়া-কমা হয়, তা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র নক্ষত্রগুলিকে তাঁরা সাতটি দলে ভাগ করেছিলেন। ‘ও’, ‘বি’,‘এ’, ‘এফ’, ‘জি’, ‘কে’ এবং ‘এম’।সেই গোলকধাঁধাটা কী? হার্ভার্ডের মহিলা বিজ্ঞানীরা দেখলেন, শুধুই উজ্জ্বলতা দিয়ে কোনও তারার বাছবিচার করে তার ‘গোত্র’ ঠিক করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা দেখলেন, কোনও তারার উজ্জ্বলতার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন আলোক নির্গমনের (‘কনটিনিউয়্যাস এমিসন) সম্পর্ক থাকলেও সেই তারা থেকে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখার (লাইন এমিসন) উজ্জ্বলতার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা এও দেখলেন, কোনও তারার উজ্জ্বলতা বাড়লে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখার উজ্জ্বলতা বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে। সেটা যে কেন হয়, সেই জটটাই খুলতে পারছিলেন না হার্ভার্ডের সহকারি বিজ্ঞানী মহিলাদের দলটি। সাহা সমীকরণ এর আবিস্কারের পর ওই মহিলা বিজ্ঞানীদের দলটি দেখলেন, যে তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, তারাই হয় সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। সেই তারার রয়েছে ‘ও’ দলে। আর ‘বি’, ‘এ’, ‘এফ’, ‘জি’, ‘কে’ হয়ে কমতে কমতে যে নক্ষত্রগুলির উজ্জ্বলতা সবচেয়ে কম, সেগুলি রয়েছে ‘এম’ দলে। সেই তাপমাত্রাও তারা মেপে ফেললেন। সেই প্রথম। ‘এম’ দলে থাকা তারাদের তাপমাত্রা আমাদের সূর্যের পিঠের তাপমাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ । মেরেকেটে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তাপমাত্রার নিরিখে আমাদের সূর্য পড়ে ‘জি’ দলে। তার পিঠ বা ‘ফোটোস্ফিয়ার’-এর তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। মনে রাখার সুবিধার জন্য ওই পাঁচটি দলের নক্ষত্রকে বলা হয়, ‘ওবিএ ফাইন গার্লস কিস মি’!মেঘনাদের সমীকরণই দেখাল, তারাদের ‘গোত্র’ বিচারের ক্ষেত্রে বেশি জরুরি ওই ওই বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখাই। এই ‘লাইন এমিসন’ নির্ভর করে মৌলগুলির আয়নীভবনের উপর। বোলৎজম্যানের তত্ত্ব মানা হলে, আলোর বর্ণালি রেখার উজ্জ্বলতা তাপমাত্রার সঙ্গে বাড়ে। কিন্তু সাহার আয়নীভবনের তত্ত্ব বলছে, সেই উজ্জ্বলতা কমেও যেতে পারে, যদি কখনও মৌলটি আগেই আয়নীভুত হয়ে যায়। এই ভাবেই ব্রহ্মাণ্ডে যে কোনও অজানা নক্ষত্রকে জানা বা অচেনা তারাকে চেনা-বোঝার রাস্তাটা খুলে দিলেন মেঘনাদ। আজ থেকে ৯৯ বছর আগে। ১৯২০ সালে। প্রকাশিত হল কিংবদন্তী বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সেই বিখ্যাত সমীকরণ। যার নাম- ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইক্যুয়েশন’ বা ‘সাহা আয়নীভবন তত্ত্ব’। এখনও ভিনগ্রহের ভিন মুলুকে পৃথিবীর মতোই জল রয়েছে কি না, সেই জল তরল নাকি কঠিন বা গ্যাসীয় অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে এখনও আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেই মেঘনাদের সমীকরণের কাছেই। কোন কোন মৌল দিয়ে গড়া সেই সব নক্ষত্রের শরীর আর তা রয়েছে কতটা পরিমাণে তা জানতে সেই লাইন এমিশনের উপরেই নজর রাখতে হয়। যেমনটি বলেছিলেন মেঘনাদ সাহা। আর এই সন্ধান যেহেতু চলবে আর আগামী দিনে তা বাড়বে আরও কয়েক গুণ, তাই বলাই যায়, সভ্যতা যত দিন টিঁকে থাকবে, তত দিনই ভিনগ্রহের ভিন মুলুকে প্রাণ বা প্রাণ সৃষ্টির ‘বীজ’ মৌলগুলির খোঁজ করতে আমাদের বার বার দ্বারস্থ হতে হবে সেই মেঘনাদের কাছেই।
মেঘনাদের ওই সমীকরণ নিয়ে তখন তোলপাড় হয়ে গেল গোটা বিশ্ব। দাবি উঠল তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার। নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছে মেঘনাদ সাহার নাম প্রথম বার মনোনয়ন করে পাঠালেন আর্থার হোলি কম্পটনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী। সেটা ১৯৩৭ সাল। কিন্তু শেষ বিচারে মেঘনাদকে হিসেবের মধ্যেই রাখল না নোবেল কমিটি। তার ঠিক তিন বছরের মাথায় ১৯৪০-এ আবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মেঘনাদকে মনোনয়ন দিলেন কম্পটন। না, সে বারও ‘মেঘের আড়ালে’ই থেকে গেলেন মেঘনাদ। মেঘনাদকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার ঠিক আগের বছর, ১৯৩৯-এ নোবেল কমিটির কাছে সুপারিশ করেছিলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্র (যাঁর নামে চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে)। তাঁর কথাও কানে তোলেনি নোবেল কমিটি। তার পরেও হাল ছাড়েননি অধ্যাপক মিত্র। ১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালে ফের নোবেল পুরস্কারের জন্য মেঘনাদ সাহার নাম সুপারিশ করেছিলেন অধ্যাপক মিত্র। কিন্তু ‘কালা আদমি’কে মেঘের আড়াল থেকে বের করে আনতে সেই দু’টি বারেও এগিয়ে আসেনি নোবেল কমিটি! লেখা হয়েছিল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’! সারাটা জীবন ধরে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন মেঘনাদ। আর সেই যুদ্ধে জিতেই সভ্যতার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন অজানা, অচেনা ব্রহ্মাণ্ডকে জানা, চেনা ও বোঝার এক ব্রহ্মাস্ত্র! ‘দেশ’ পত্রিকাকে (১৯৯৩, ৯ই অক্টোবর সংখ্যা) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিত ডেভিড ডিভরকিন জানিয়েছিলেন, মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯২৭-এর পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটন। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় ভাটা পড়ার কারণেই হোক বা দেশীয় বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায়, নোবেল পুরষ্কার তিনি পাননি। তাঁর জীবনযাপনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষীও ছিলেন না তিনি। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে জাতিভেদ, অসাম্যকে জয় করা এবং তথাকথিত উঁচু তলার মানুষদের তৈরি করা বিভাজন রেখাকে মুছে ফেলা। আমৃত্যু সেই কাজটাই করে গিয়েছেন মেঘনাদ নিষ্ঠার সঙ্গে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞান সংগঠক মেঘনাদকে না পেলে ভারত বিজ্ঞান গবেষণায় সাবালক হয়ে উঠত না। কংগ্রেসের চরকা কাটার নীতির বিরোধিতার কারণে দেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না, যা বাধা সৃষ্টি করেছিল মেঘনাদ সাহার কর্মকাণ্ডে। স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকারের পারমাণবিক শক্তি কমিশনেও তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংগঠক হিসেবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করা, প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরিও তাঁর সাহসী পদক্ষেপের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়াও দেশীয় উপাদানে নিজের বিটা স্পেকট্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক সাহা, যার সাহায্যে ভারতীয় খনিজ পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা জরিপ করা, এ দেশে জীববিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্রিক বিজ্ঞান বা নিউক্লিয়ার সায়েন্সের প্রয়োগ তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়।
১৯৫৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি আচমকাই মৃত্যু এসে থামিয়ে দিয়েছিল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোরের লেখায় আছে, ‘ড. জ্ঞান ঘোষের ফোনে অধ্যাপক সাহার অসুস্থতার খবর পাই। ওয়েলিংটন নার্সিংহোমে পৌঁছে জানতে পারি সব শেষ।’
বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, তিনি সময়ের আগে জন্মেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত হয়ে উঠতেই পারেনি তৎকালীন ভারত। তাই বিজ্ঞান বা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, ভারতীয় বিজ্ঞানের তিন নক্ষত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আচার্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মেঘনাদ সাহা আজও শুধুই অধ্যাপক সাহা। এ ক্ষেত্রেও তিনি ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের ‘পিছিয়ে পড়া’ বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- মেঘনাদ সাহা: বিপ্লবী পদার্থ বিজ্ঞানী, প্রদীপ দেব, মীরা প্রকাশন (২০১৮)।
২- অবিনাশ মেঘনাদ সাহা: বিজ্ঞান সমাজ রাষ্ট্র, অত্রি মুখোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ (২০১২)।
৩- মেঘনাদ সাহা ও বিজ্ঞানের যুগান্তর, ডঃ জয়ন্ত বসু, দে’জ পাবলিশিং।
৪- বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, প্রশান্ত প্রামাণিক, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী (২০০৯)।
৫- রচনা সংগ্রহ, মেঘনাদ সাহা, নবযুগ প্রকাশনী (২০১৯)।
৬- ‘ডিসপার্সড রেডিয়েন্স, কাস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স ইন ইন্ডিয়া’: আভা শূর
৭- ‘মেঘনাদ সাহা: দ্য সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড দ্য ইনস্টিটিউট বিল্ডার’: শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়
৮- ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স পত্রিকায় ২৯শে জানুয়ারি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ।
৯- ৯ই অক্টোবর ১৯৯৩ সালে দেশ পত্রিকা তে প্রকাশিত প্রবন্ধ।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা নভেম্বর ২০১৮ সাল, ১লা অক্টোবর ২০১৯ সাল, ২৮শে নভেম্বর ২০১৮ সাল, ২২শে ডিসেম্বর ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত