নিজেদের প্রয়োজন মিটে গেলে বা নিজেদের স্বার্থে ঘা পড়লে মার্কিন সরকারের দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়ে। তখন তারা হয়ে ওঠেন এক রক্তলোলুপ জীব। যারা তার বিরোধিতা করছেন ধনে-প্রাণে তাদের বিনাশ করাটাই তখন হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। হো চি মিন, চে গুয়েভারা, কাস্ত্রো, গদ্দাফি, সাদ্দাম, লাদেন সবার ক্ষেত্রেই বিশ্বের মানুষ তাদের একই ভূমিকায় দেখেছেন। যাদের নাম করলাম তাদের কেউ কেউ যে খুব ধোয়া তুলসীপাতা তা নয়, বিশেষ করে শেষের তিনজন প্রচুর অন্যায় কাজ করেছেন, অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছেন তারা। কিন্তু মজার কথা হল মার্কিন সরকার তাদের মৃত্যুর ফতোয়া জারি করেছেন নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থেই। যখন তারা তাদের হাতের ইশারায় আমেরিকার স্বার্থে কাজ করতে অস্বীকার করেছেন তখনই তাদের মরতে হয়েছে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন ইরানের শীর্ষ সেনা কর্তা কাসেম সোলেমানি।
একটা জিনিস আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করলাম, আমাদের ছাত্রজীবনে যেমন মার্কিন শাসকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ছাত্রযুবদের প্রতিবাদের ঢেউ উঠতো এখন তেমন কিছু ঘটলো না। অবশ্য ইরান, ইরাকে ইতিমধ্যেই সোলেমানির হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের ঝড় উঠেছে কিন্তু ভারত সহ অন্যান্য দেশে তার তেমন কোন ঢেউ এখনও দেখতে পেলাম না। মিথ্যে ও ভুলভাল কথা বলার ব্যাপারে রেকর্ড সৃষ্টি করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব ইতিমধ্যেই খুনের যুক্তি সাজাতে বলতে শুরু করেছেন – নয়াদিল্লি ও লন্ডনের জঙ্গি হামলাতে সোলেমানিই মদত দিয়েছেন কিন্তু এব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে এখনও কোন পরিষ্কার তথ্য নেই। তাই তারা এব্যাপারে এখনও কোন মন্তব্য করেননি।
আমি মোটেই পন্ডিত নই, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি এই সোলেমানিই ছিলেন একসময় আমেরিকার পরম বন্ধু। ফিলহাল তিনি তাদের কথা মত চলছিলেন না। ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সোলেমানিই ছিলেন আমেরিকার সেরা অস্ত্র। তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তিনিই ছিলেন আমেরিকার ভরসা। এখন সে প্রয়োজন মিটেছে, উল্টে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার বিরুদ্ধে জঙ্গিদের লড়াইয়ের সেনাপতি। অনেকে বলছেন, এ হল বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে জঙ্গিদের বিক্ষোভের বদলা। ইতিহাস বইয়ের ভাষায় সোলেমানির হত্যার সেটাই প্রত্যক্ষ কারণ। আমার প্রশ্ন, অন্যদেশের কোন মানুষ অন্যায় করলে তাকে সেদেশে ঢুকে এভাবে খুন করা যায়? এতে কি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষিত হয়?
আমার মতে, মতের অমিল হলেই নানা কুযুক্তির অবতারণা করে একদা তাদেরই সৃষ্ট জঙ্গি নেতা বা সেনানায়কদের খতম করে দেওয়ার যে ঔদ্ধত্য মার্কিন শাসকরা ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে চলেছেন তার বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ। সরব হওয়া উচিৎ কলকাতা সহ আমাদের দেশের যুবছাত্রদেরও। আমাদের কলেজ জীবন শুরু হওয়ার অনেক আগেই আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল কলকাতার যুবছাত্ররা। আওয়াজ উঠেছিল তোমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। নকশালপন্থী যুবছাত্রদের গানে ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিবাদ, ‘ভাগীরথী তুমি মেকং নদীর সীমানা ভাঙো।’ সেই প্রতিবাদের ধাক্কায় বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার বিমান দমদমে নামতে না পেরে ফিরে গিয়েছিল। কলকাতা কী সেই প্রতিবাদী অতীত ভুলে গেছে?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত