ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের দীর্ঘদিনের প্রাণপণ চেষ্টার ফল মিলেছিল গত সপ্তাহেই। যখন চাঁদের কক্ষপথে পা দিয়েছিল ভারতের ‘চন্দ্রযান-২’। গত মঙ্গলবারই সকাল ৯টা ২৮ মিনিটে চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ে তা। আর এবার আরও কাছ থেকে চাঁদের পিঠের ছবি তুলে পাঠাল চন্দ্রযান-২। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর তরফে সোমবার সেগুলি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে একাধিক বৃহৎ গহ্বর (ক্রেটার) চোখে পড়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, পদ্মভূষণ খেতাবজয়ী এক বাঙালি পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্রের নামেও একটি গহ্বর, যার নাম ‘মিত্র ক্রেটার।’
বাঙালি তাঁকেই ভুলেই গিয়েছিল। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সমসাময়িক, পদার্থবিদ্যার বিস্মৃতপ্রায় অধ্যাপককে আলোয় ফিরিয়ে আনল চন্দ্রযান-২-এর পাঠানো চাঁদের একটি ছবি। যাতে পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে করোলেভ, জ্যাকসন, ম্যাক এবং মিত্র- চন্দ্রপৃষ্ঠের এই চার গহ্বরকে, যাদের চাঁদের কলঙ্ক হিসেবেই চেনে দুনিয়া। শেষটির নামকরণ করা হয়েছে শিশির কুমার মিত্রের নামে। ভারতে আয়নোস্ফেরিক সায়েন্স, রেডিয়ো সায়েন্সের জনক বলা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা এই মানুষটিকেই। তবু এত দিন স্মৃতির আড়ালে ছিলেন। মৃত্যুর ৫৬ বছর পর উজ্জ্বল হলেন জ্যোৎস্নায়, সৌজন্যে চাঁদের কলঙ্ক!
প্রসঙ্গত, চাঁদে গহ্বর অসংখ্য। কোনওটি একেবারে শুরুর সময়কার, কোনওটি পরবর্তী সময়ে প্রবল গতিবেগে আছড়ে পড়া গ্রহাণুর আঘাতে তৈরি, যাদের বলা হয় ইমপ্যাক্ট ক্রেটার। নাসার হিসেব বলছে, চাঁদে এক কিলোমিটার ব্যাসের গহ্বর রয়েছে দশ লাখেরও বেশি। ২০ কিলোমিটারের বেশি ব্যাসের গহ্বর হাজার পাঁচেক। চাঁদের দূরতম প্রান্তে, উত্তর গোলার্ধের ‘মিত্র ক্রেটার’ দ্বিতীয় তালিকায় পড়ে। ইসরোর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ব্যাস ৯২ কিলোমিটার। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের গেজেটিয়ার অফ প্ল্যানেটারি নোমেনক্লেচার ১৯৭০ সালে শিশির কুমার মিত্রের নামে একটি ইমপ্যাক্ট ক্রেটারের নামকরণ করে।
চন্দ্রযান-২-এর টেরেইন ম্যাপিং ক্যামেরার পাঠানো ছবিতেই ধরা পড়েছে মিত্র ক্রেটার। চন্দ্রযান-২-এর সঙ্গে রয়েছে অরবাইটার। তার ‘পে-লোড’ এই ক্যামেরা। যে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তুলে একে একে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। এই ছবিগুলিই ৭ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযানকে চাঁদের মাটিতে মসৃণ ভাবে নামতে সাহায্য করবে। মিত্র ক্রেটারের ছবিটি ২৩ আগস্ট চাঁদের মাটি থেকে ৪,৩৭৫ কিলোমিটার উপর থেকে তোলা। যা সোমবার বিকেলে জনসমক্ষে আনে ইসরো।
বিদেশি নামের মধ্যে একটি ভারতীয় নাম, তা-ও আবার বাঙালি। এমন একজন, যাঁর নাম ভুবনখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সমগোত্রে আসে না। কিন্তু তাঁর অবদান একেবারেই কম নয়। ভারতে রেডিয়ো প্রযুক্তি, আয়নোস্ফেরিক সায়েন্সের পথিকৃৎ তিনিই। যে কথা মেঘনাথ সাহাও বারবার বলেছেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০ কিলোমিটারের পর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়ানো মহাকাশ আয়নমণ্ডল নামে পরিচিত। দূরপাল্লার রেডিয়ো যোগাযোগের জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই আয়নমণ্ডল নিয়েই আজীবন গবেষণা করে গিয়েছেন শিশির কুমার মিত্র।
এর বাইরেও তাঁর কৃতিত্ব অনেক। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ সি ভি রমন ছাড়া তিনিই একমাত্র ভারতীয় পদার্থবিদ, যিনি নোবেল কমিটির কাছে চারবার প্রাপকের নাম মনোনীত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি মেঘনাদ সাহার নাম পাঠান। ১৮৯০ সালে হুগলির কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেন শিশির কুমার। বাবা স্কুলে পড়াতেন, মা ডাক্তার। স্কুলের পড়াশোনা ভাগলপুরে। পরে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডালিস্ট তিনি। রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ করেছেন জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে। সিভি রমনের শিষ্য হিসেবে গবেষণা করেছেন অপটিক্স নিয়েও।
১৯২০ সালে স্কলারশিপ পেয়ে চলে যান ফ্রান্সে। সেখানে সুযোগ হয় নোবেলজয়ী পদার্থবিদ মারি কুরির ল্যাবে কাজ করার। তারপর শব্দতরঙ্গের প্রেমে পড়ে কাজ শুরু করেন বেতার প্রযুক্তি নিয়ে। দেশে ফেরার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে, তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়্যারলেস টেকনোলজি নিয়ে পড়ানোর ইচ্ছের কথা জানান। এরপরই দেশে ফিরে তিনি যোগ দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে। ১৯২৫ সালে ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরি, রেডিয়ো ট্রান্সমিটিং স্টেশন তৈরি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ রেডিয়ো ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠানটি তাঁরই হাতে তৈরি।
উল্লেখ্য, আগামী ২ সেপ্টেম্বর চন্দ্রযান থেকে চাঁদের কক্ষপথে আলাদা হয়ে যাবে ল্যান্ডার বিক্রম। তার পর চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে দু’টি বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি উচ্চতা যখন ১০০ ফুট হবে, তখন ধীরে ধীরে চন্দ্রপৃষ্ঠে নামতে শুরু করবে সেটি। ৭ সেপ্টেম্বর সেটি চাঁদের পিঠে পা ছোঁয়াবে বলে আশাবাদী ইসরোর বিজ্ঞানীরা।