কত বিচিত্র ও রহস্য আছে ঠাকুর পরিবারে তা আজও উদঘাটিত নয়। এই পরিবারের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছে নিজস্ব সব গল্প। যত জানা যায় মনে হয় যেন আরও কম। এই পরিবারের বিস্ময়কে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন মানুষ এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘটনা যেন এক একটা উপন্যাস। এই বিস্ময়ের আড়ালেও ঠাকুর পরিবারে আছে বহু বিস্ময়। যাঁদের কথা হয়তো অনেক মানুষের কাছে অবিদিত নয়। সেই এক বিস্ময়ের নাম হল বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক নিঃসঙ্গ নির্জন এক মানুষের ছবি ভেসে ওঠে।
সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো হন তিনি। বলতে গেলে কবির খুব ‘আদুরে’ ছিলেন তিনি। জন্ম থেকেই শারীরিক সমস্যার কারণে কিছুটা অন্তরালেই ছিলেন তিনি বরাবর। এক রুগ্ন ও পায়ে খুঁত নিয়ে ঠাকুর পরিবারের অন্দরেই বড় হতে থাকেন এই শিশুটি। সুখ-দুঃখ, টালমাটালে ভরা জীবন নিয়েই বড় হতে থাকেন তিনি। তাঁর শারীরিক অক্ষমতার জন্য তাঁকে অনেক উপহাস শুনতে হয়েছে। কিন্তু ‘বলু’ যেন নির্বিকার। নিজের মনেই কাটিয়ে দিত দিন। একের পর এক পড়াশুনার গন্ডি পেরিয়ে এগিয়ে যেতেন তিনি।
দিনে দিনে যত তিনি বড় হতে থাকেন সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগও ততই বাড়তে থাকে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের কাছে এবং ঠাকুর বাড়ীর আবহাওয়ায় সাহিত্য সম্পর্কিত আগ্রহ তিনি অনায়াসেই খুজে পেয়েছিলেন। প্রথমে ‘বালক’ পরে ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’তে তিনি লিখতেন। তাঁর জীবন ছিল এক অদ্ভুত ওঠা-নামার মধ্যে দিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেলেটির স্বপ্নপূরণ হয়নি। তাই তাঁকে বাধ্য হয়েই ঢুকতে হয় ব্যবসায়। এই ব্যাপারে তাঁর প্রধান ভরসার নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সহযোগিতায় ও উৎসাহে ‘টেগোর এন্ড কোম্পানি’ নামে শুরু করেন পাটের ব্যবসা।
বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের অঙ্কুরস্বরূপ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়বার প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন বলেন্দ্রনাথই। বিশ্বভারতী নামে যে মহীরুহটি আজ তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে অসংখ্য মানুষের মনে জ্ঞানের স্পৃহা জ্বালিয়ে চলেছে, সেই বীজ বপনের চিন্তাভাবনা এবং তাঁর নিয়ম-নির্দেশিকা খসড়া রূপায়ণ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে হয়নি। সেটি রূপায়িত হয়েছিল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মস্তিষ্ক থেকেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বলেন্দ্রনাথের দ্বারা ব্রহ্মবিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ ও বিদ্যালয়ের নিয়মাবলির খসড়া তৈরি হলেও বিদ্যালয় আরম্ভ হওয়ার আগে তিনি মারা যান মাত্র ২৯ বছর বয়সেই।
সাহিত্য সেবাতেই তাঁর জীবন সার্থকতা লাভ করে। সাহিত্যিক এবং কবি বলেই তিনি বাঙালী জীবনে ও সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। তাঁর সৃষ্টির বাহন কবিতা, ব্যক্তিগত রচনা ও আলোচনামূলক প্রবন্ধ। উপন্যাস বা নাটক তিনি লেখেননি। ছাপান্নটি গদ্য নিবন্ধ,( চিত্র ও কাব্য) দুটি কবিতাগ্রন্থ (মাধবিকা ও ‘শ্রাবনী’), কতকগুলি সনেট, ও দুটি বড় কবিতা। তাঁর প্রকাশিত রচনার পরিধি এই। এই নিঃসঙ্গ কবির জীবনের ট্যাজিডি এখন ভাবায় বাঙালিকে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত