একটা বড় হাঁড়ি, তার গায়ে একটা লাল কাপড় জড়ানো। হাঁড়ি খুলতেই একটা মনমাতানো গন্ধ। ধোঁয়া ওঠা প্লেটে সামনে হাজির সাদা এবং হলুদ রঙের ভাত, একখণ্ড আলু এবং নরম তুলতুলে রেওয়াজি মাংস কিংবা চিকেনের লেগপিস। চামচে করে মুখে তুলতেই মধুর বিস্ফোরণ। প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া, প্রেমিকের ব্যস্ততা, অফিসে বসের ঝাড় সবটা ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ‘বিরিয়ানি’।
ভাতডাল নাই পছন্দ হতে পারে, তবে বিরিয়ানি পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। আর কলকাতার বিরিয়ানি খানিকটা ‘দিল্লির লাড্ডু’র মত। একবার খেলে বারবার খাবেন, খাবেনই। মুঘল আমলে বিরিয়ানিতে ডিম না থাকলেও খাদ্যপ্রেমী বাঙালি নিজদের শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে বিরিয়ানিতে এনে ফেলেছে ডিম।
তবে বিরিয়ানিতে আলু-ডিম-মাংসের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিন বদলাচ্ছে। আদতে বিরিয়ানিতে আলু ঢুকেছিল, মাংস খাওয়ার রেস্তহীন গরিবকে কিছুমিছু সান্ত্বনা দিতে। অপর্যাপ্ত মাংস ও প্রধানত মাংসের গন্ধ দিয়ে রাঁধা ভাতে আলুটাই তখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাত। তবে ডিম-আলুবিশিষ্ট বিখ্যাত কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানি নিয়ে বাঙালির যতই আদিখ্যেতা থাক, একটা অন্য ঘরানাও ক্রমশ মাথা তুলছে এ শহরে। বিরিয়ানির পরম্পরায় কলকাতার নিজস্ব সংযোজনটুকু বজায় রেখেও কিছু নতুন শৈলী আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে এ শহরের ভোজ-সংস্কৃতিতে।
যেমনটা ঘটেছিল, বছরখানেক আগে খাস লখনউয়ে তালিমপ্রাপ্ত বিরিয়ানি-শিল্পী মনসুর মিয়াঁর হাত ধরে। আমিনাবাদ, হজরতগঞ্জের খানদানি কবাব, বিরিয়ানির ঠেকে নাড়া বাঁধা মনসুরকে মাটনের রান নিয়ে কিছু তুকতাক করতে বলেছিলেন, আউধ ১৫৯০ রেস্তোরাঁর কর্তা দু’ভাই শিলাদিত্য ও দেবাদিত্য চৌধুরী। দেশপ্রিয় পার্ক, সল্টলেকের রেস্তোরাঁয় তাই জন্মাল, মাংসের নির্যাসস্নিগ্ধ বিশেষ মাটন রান বিরিয়ানি। একটি বিরিয়ানি উৎসব উপলক্ষে তৈরি হয়েও ক্রমশ তা রেস্তোরাঁর রোজকার মেনুতে ঢুকে পড়েছে।
মার্কোপোলোর শেফ অমিতাভ চক্রবর্তীও মেনুতে বিরিয়ানি রাখলেও ডিম-আলুর জনপ্রিয় বিরিয়ানি-সংস্করণকে আমল দেননি। মেনুতে রয়েছে হায়দরাবাদি ঘরানার মাটনের সিকন্দরি দম বিরিয়ানি ও চিকেনের আওয়াধি বিরিয়ানি। অমিতাভ বলছিলেন, ‘‘আলু ছাড়াই বিরিয়ানি কিন্তু রেস্তোরাঁর জনপ্রিয়তম রান্নার একটি।’’ কলকাতায় হায়দরাবাদি বিরিয়ানির কদর রয়েছে, দক্ষিণি আমিষ রান্নার রেস্তোরাঁ ট্যামারিন্ড-এও। বছরে মেরেকেটে দু-এক বার বাড়িতে ফেরা কলকাতাকন্যা ঋতুপর্ণা দত্ত অবশ্যই টিপিক্যাল বাঙালি বিরিয়ানির জন্য মুখিয়ে থাকেন। খোদ মেটিয়াবুরুজের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের কারও কারও বাড়িতেও দেখা যায়, আলু দেওয়া সর্ষের তেলের বিরিয়ানিটাই জীবনচর্যার অঙ্গ। তবু ঋতুপর্ণাই বলছিলেন, ‘‘আমার মরাঠি বর বা ছেলেমেয়েদের জন্য আজকাল অন্য ধরনের বিরিয়ানিও খুঁজতে হয়।’’
আউধ ১৫৯০-এর মেনুতে রান বিরিয়ানি ছাড়াও এখন কোয়েলের শিকারি বাটের বিরিয়ানি, মাংসের পায়ার শাহি বিরিয়ানি থেকে শুরু করে নানা কিসিমের পোলাও-খিচড়ি। এর মধ্যে গোস্ত খিচড়ি ছাড়াও মাংসের জুসে রাঁধা ইয়াখনি গোস্ত পোলাও বা ভেটকি কিংবা চিংড়ির সুগন্ধি পোলাও। কলকাতায় বিরিয়ানির প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই আলুকে বাঙালির মনের ঘরে চিরতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে চিৎপুরের রয়্যাল হোটেলের হলুদবরণ রাজকীয় বিরিয়ানি। তারাও আলুকে আমল দেয় না। সে বিরিয়ানির সঙ্গে মাটন চাঁপ খেয়ে এক বার একটা জটিল কেসে ফেঁসে যাওয়া ফেলুদার অবধি মগজের খিল খুলে গিয়েছে। আর এক ধ্রুপদী রেস্তোরাঁ অম্বর-এও পুঁচকে পুঁচকে মাটন বল-ভরপুর মোতি পোলাওকেও বাঙালি দীর্ঘদিন বিরিয়ানি-জ্ঞানে খেয়ে এসেছে। এ-সব ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে, ভাল বিরিয়ানি-পোলাও পেলে ছক ভাঙতেও রাজি আমবাঙালি।
