ভোট আসার সবচেয়ে বড় লক্ষন কী বলুন তো? এককথায় এর উত্তর হল, গরীবদের নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। এতদিন যে নেতারা বিজনেস টাইকুন, খেতাব হারানো রাজা-গজা, উচ্চকোটির কর্পোরেট বস এবং অনুগত মাসলম্যানদের ছাড়া আর কাউকেই চিনতেন না সেই নেতাদের যখন মনে পড়বে গরীবদের কথা, তখনই বুঝতে হবে ভোট এসেছে। এবারও ঠিক সেই ঘটনাই ঘটছে। গরীবদের দুঃখে কেঁদে ভাসাচ্ছেন তথাকথিত জাতীয় দলের নেতারা। কে কত গরীব দরদী, কার বাপ ঠাকুরদা দেশের জন্য কত করেছেন তা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক তরজা শুরু হয়ে গেছে ৫৮ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা নেতার লোকজনের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় নেতা বা নেত্রী হয়ে আসা লোকজনের। দেশের গরীবরা আগে এসব ঝগড়া ঝাঁটি দেখে বেজায় ধন্ধে পড়ে যেত। এখন আর পড়ে না, একটু মুচকি হেসে একটা বিড়ি ধরায়। কেউবা অবাক হওয়ার ভান করে। আমার মনে পড়ে যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ন্যাংটো ছেলেটা দেখছে আকাশ।
নির্বাচনী বক্তৃতায় কংগ্রেস সভাপতি বলেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে দেশের সব গরীব মানুষের নূন্যতম রোজগারের গ্যারান্টি দেবেন। দেশ থেকে মুছে ফেলবেন দারিদ্র এবং ক্ষুধা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আরও দরাজ। কোন ঝামেলায় না গিয়ে ভদ্রলোকের এক কথার মত তিনি বলেছেন, দেশে আর কোনও গরীবই থাকবে না, কৃষকদের আয় ২০২২সালের মধ্যে দ্বিগুণ হবে। স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকে শুরু হওয়া দেশের সাধারণ নির্বাচনে দেশের মানুষ কিন্তু দুপক্ষের নেতাদেরই দফায় দফায় সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাদের ঘোষিত লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌছতে পারেন নি। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস দেশের সবথেকে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকলেও এখনও দলটির গরীবদরদী বলে কোন ভাবমূর্তি তৈরি হয়নি। কৃষকদের অবস্থা কোন কংগ্রেসি সরকারের আমলে খুব ভালো ছিল একথা কোন কট্টর কংগ্রেসিও বলতে পারবেন না। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বিজেপি আমলেও আমরা দেখেছি ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের ধারাবাহিক আত্মহত্যার ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না বলে তার নিজের দলের মানুষরাই তার প্রতি বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত। সংখ্যাগুরু সাধারণ কর্মী এবং আরএসএস, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মত শাখা সংগঠনগুলির সিদ্ধান্ত যদি মান্যতা পেত তাহলে এবার মোদীর প্রার্থী হওয়াই মুশকিল ছিল।
ভোটের মুখে নীরব মোদী, মেহুল চোকসীদের ছেড়ে দেশের কৃষকদের বন্ধু হতে চাইছেন মোদী। তিনি যে কত বড় কৃষক বন্ধু তা প্রমাণের জন্য মোদী এখন বলছেন, তার আমলে প্রতি মিনিটে ৪৪জন গরীব এখন দারিদ্র রেখার ওপরে উঠে আসছেন, আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে তাদের। এমন আশ্চর্য ঘটনাটি মোদীর আমলে দেশের কোন জায়গায় ঘটেছে তা দয়া করে কেউ আমাকে জানালে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। ঘটনা হল দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকরা তো বটেই, এমনকি গ্রামের সম্পন্ন ও মাঝারি কৃষককুলও তাদের প্রতি বিরক্ত। মনে রাখতে হবে এদের একটা বড় অংশ কিন্তু বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক, মোদী তাদেরকেও চটিয়েছেন।
ভোট এলে নেতাদের বাতেলার পাশাপাশি আরেকটা বিষয় বিজেপির প্রচারে আসে, তা হল বিদেশী আক্রমণ। বিদেশী বলতে বিজেপি বোঝে পাকিস্তান। নিজেদের সাচ্চা জাতীয়তাবাদী প্রমাণের জন্যই ভোটের আগে বিজেপি ও আরও কিছু �জাতীয়তাবাদী� দল পাকিস্তান বিরোধী হুমকি ছাড়ে। উদ্দেশ্য দেশের হিন্দু ভোটারদের ভোট পাওয়ার জন্য তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে অবতীর্ণ হওয়া। অন্যদিকে রাহুল বলছেন, কংগ্রেস যা বলে তা করে দেখায়। কিন্তু কংগ্রেসি আমলে মানুষ দেখেছে কংগ্রেসের ঘোষণার সঙ্গে কাজের তফাৎ রয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন কংগ্রেস নেতারা।
ভোটের বছরে জনমুখী বাজেট পেশ একটা সাধারণ ঘটনা। আমাদের দেশে সব রাজনৈতিক দলই এটা করে থাকে। প্রবল বিরোধী হয়েও এব্যাপারে বিজেপি কংগ্রেসি ঐতিহ্যই অনুসরণ করছে। গত কয়েক বছরে ফসলের উপযুক্ত দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন অসংখ্য কৃষক। বিদায় বেলায় ২০১৯সালে অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় বাজেট দেশের কৃষকদের জন্য উৎসর্গ করেছে বিজেপি সরকার। এ যেন জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে তারে তুমি দিতে এলে ফুল। অবশ্য এধরণের ড্যামেজ কন্ট্রোল মেজার ছাড়া তাদের আর কোন উপায়ও নেই। একদিকে পরিবারতন্ত্র অভিযোগ ঢাকতে কংগ্রেসকে বলতে হচ্ছে যৌথ নেতৃত্বের কথা, অন্যদিকে নিজেদের কৃষকদরদি প্রমাণ করতে বলতে হচ্ছে কৃষকদের সুদিন আনার কথা, বলতে হচ্ছে আর্থিক প্যাকেজের কথা।
ঠেকে শিখেই মানুষের এখন তথাকথিত জাতীয় দলের ওপর টান কমেছে। আঞ্চলিক শক্তি এখন জাতীয় রাজনীতির এক নতুন প্রবণতা। আগামি দিনে তারাই যে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে তা বোঝার জন্য কোন গণৎকার হতে হয় না। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলিতে আমরা দেখছি জাতীয় প্রেক্ষাপট ও আঞ্চলিক স্বার্থের এক সঠিক মেলবন্ধন। এই দলগুলি জানে রাজ্যের মানুষের চাহিদা এবং স্বার্থগুলিকে পূরণ করতে পারলেই তারা বাড়বে। তাই রাজ্যের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। আমার মনে হয় ধোঁয়াটে, মেকি জাতীয়তাবাদের থেকে এই দায়বদ্ধতা আজকের রাজনীতিতে অনেক বেশি জরুরি।
আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এতকাল চলে আসা কেন্দ্রসর্বস্বতার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলির রাজনীতি যেন এক জীবন্ত প্রতিবাদ। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করবে। আমি সামান্য মানুষ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে তৃণমূল আমলের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবক্ষেত্রেই বাংলা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দলগুলির আমলের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়েছে। এরজন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দিতেই হবে।
অর্থনীতি ত্থেকে আইনশৃঙ্খলা, গণবন্টন থেকে রাজস্ব আদায়, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, পর্যটন থেকে ক্ষুদ্র শিল্প, নগরোন্নয়ন থেকে গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণ সবক্ষেত্রেই সাফল্যের সুবাদে বাংলা এখন গোটা দেশে এক চর্চিত নাম। বছরভর কাজ করে চলেন বলেই বাংলার নেত্রীকে ভোটের মুখে বড় বড় প্রতিশ্রুতির বাণী দিতে হয় না। তিনি জানেন তার দল কাজের সুবাদেই জিতবে। কারণ, কাজটাই মানুষের চোখে পড়ে। আমার বিশ্বাস আগামি নির্বাচনে বাংলার মানুষের রায় এই সাফল্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই সামনের সারিতে উঠে এসেছে বাংলা, পথ দেখাচ্ছে সারা দেশকে। আগামি ভোটের ফলে তা আবার প্রমাণিত হবে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটার মতই বাংলার গরীব মানুষদের স্বপ্ন এবার সত্যি আকাশ ছুঁতে চাইছে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )




