এবারের ব্রিগেড আর পাঁচটা সমাবেশের মতো নয়। এবারের ব্রিগেড ঐতিহাসিক ব্রিগেড। তাই ছাপিয়ে যাবে ভিড়ের সব রেকর্ডও। প্রথম থেকেই এই দাবি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি যে একদমই ভ্রান্ত নয়, তা টের পাওয়া গেল গতকালই। কারণ ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আসা রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের মধ্যে প্রায় সকলেই গতকাল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ব্রিগেডের জমায়েতটা দেখে।
গুজরাট থেকে এসেছিলেন পাটিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক পাটেল। ভাষণের শুরুতেই ‘জনসৈলাব’ (জনতার ঢল) নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন তিনি। উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা তরুণ আরএলডি নেতা জয়ন্ত সিংহ বললেন, ‘আমরা জানতাম র্যালি হবে। কিন্তু এসে যা দেখছি, তাকে আমাদের উত্তর ভারতে র্যালা (সুবিশাল র্যালি) বলা হয়।’ উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সপা সুপ্রিমো অখিলেশ যাদবের গলাতেও বিস্ময়ের সুর, ‘যত দূর চোখ যায়, শুধু মাথা আর মাথা দেখছি।’
এখানেই শেষ নয়। ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পাওয়ার থেকে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল, লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব থেকে ‘বিহারি বাবু’ তথা বিজেপি সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা সমাবেশের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একের পর এক নেতা। এক কথায় ভিড়ের আকার গতকালের ব্রিগেড সমাবেশকে নতুন মাইলফলকে পৌঁছে দিল। পাশাপাশি যে রাজনৈতিক রামধনুটা এ দিন ব্রিগেডের মঞ্চে তৈরি হল, তাও ঐতিহাসিক। বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জম্মু-কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল প্রদেশ— দেশের কোন প্রান্ত এ দিন হাজির হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে, তা খুঁজে বার করা কঠিন। আর শুধু এক মঞ্চে হাজির হওয়াই কিন্তু নয়, ঐক্যের বার্তাও এ দিন খুব স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছে ব্রিগেড সমাবেশ। ঐক্যের তাগিদটা বিরোধী শিবিরে বছরখানেক ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। হয়তো যৌথ রণকৌশল তৈরির প্রক্রিয়াটাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কখনও অখিলেশ বা কেজরীবালের ডাকে মমতা সভা করতে যাচ্ছিলেন লখনউ বা দিল্লীতে। কখনও উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে সপা-বসপা হাত মিলিয়ে লড়াই করে ধরাশায়ী করছিল বিজেপিকে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বিরোধী ঐক্যের রূপরেখাটা খুব স্পষ্ট ভাবে উঠে আসছিল না, বিজেপি বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতার চেহারাটা ঠিক কেমন হবে, তা স্বচ্ছ ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু সম্মিলিত অ-বিজেপি শক্তির প্রথম বিস্ফোরণটা কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডেই ঘটল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতায় যে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র্যালি’ শনিবার হল, সেই র্যালি কিন্তু বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতাসূত্রের বার্তা খুব স্পষ্ট ভাবেই উপস্থাপিত করল বিপুল জনতার সামনে।
গতকাল মমতার ব্রিগেডে দাঁড়াইয়েই গোটা দেশকে বার্তা দিলেন দেশের তাবড় তাবড় নেতারা। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লার বার্তা, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা পরে স্থির করা যাবে, আগে নির্বাচনটা একসঙ্গে লড়া দরকার। পাশাপাশি লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘মন মিলুক, না মিলুক, হাত মেলা জরুরি।’ আবার কংগ্রেস নেতা তথা বাংলা থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত সাংসদ অভিষেক মনু সিংভি গতকালের মঞ্চকে তুলনা করলেন রামধনুর সঙ্গে।
অন্যদিকে, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা জেডিএস নেতা দেবেগৌড়া আরও স্পষ্ট বার্তা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কারও একার পক্ষে বিজেপিকে হারানো কঠিন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করা দেবেগৌড়ার বার্তা— জোট সরকারের কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে এবং জোট সরকার কর্মক্ষম হয় না, এমন ভাবনা দূর করতে হবে।
সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সবচেয়ে সুসংহত জোটবার্তাটা অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দিলেন। বারবার উঠতে থাকা অস্বস্তিকর রাজনৈতিক প্রশ্নটার জবাবও খুব স্পষ্ট করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। ভোটের পরে আমরা ঠিক করে নেব প্রধানমন্ত্রী কে হবে।’ বিজেপি বিরোধী জোটে এতজন অভিজ্ঞ নেতা রয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না? পাল্টা প্রশ্ন মমতার।
দেশের প্রায় সবক’টা উল্লেখযোগ্য বিজেপি বিরোধী শক্তি একমঞ্চে হাজির হয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাবে এবং সমস্বরে বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা ভোটের আগে নির্ধারণ করার প্রয়োজনই নেই, ভোটের পরেই প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে কোনও সমস্যা হবে না, আপাতত ঐক্যবদ্ধ থাকাই একমাত্র লক্ষ্য— এমন দৃশ্যপট তৈরির পুরো কৃতিত্বটাই মমতাকে দিয়েছেন উপস্থিত সকল শীর্ষনেতাই। আর বিজেপি বিরোধী প্রায় সব দলকে এক মঞ্চে এনে এত বড় প্রকাশ্য সমাবেশও এই প্রথম। এই প্রথমবারই এত বড় কোনও রাজনৈতিক সমীকরণ বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দিল। এ জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দনে ভরিয়ে দিলেন সকলে।