ছেলেবেলায় মা বাবার হাত ধরেই তাঁদের সন্তানরা পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরোয়। এরপর ধীরে ধীরে মা-বাবার বয়স বাড়ে। ছেলে মেয়েরা তাঁদের নিজেদের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সময়ের নিয়ম মেনেই, হয়তো ইচ্ছে থাকলেও পুজোর সময় বার্ধক্যে পৌঁছনো অশক্ত বাবা-মাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোনো হয়না। পুজোর দিনগুলোয় বৃদ্ধ বাবা-মা যখন ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দা থেকেই আলোর রোশনাই দেখে পুজোর আঁচ নেন, তাঁদের একমাত্র সন্তান হয়তো হাজার হাজার মাইল দূরে বিদেশের শহরে অফিসের কাজে ব্যস্ত।
তাহলে কি এই নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের প্রান্তে পৌঁছনো মানুষগুলো, পুজোর দিনগুলোতেও এভাবেই ঘরবন্দী থেকে যাবেন? তাঁরা আর মা দুর্গার মুখ দেখবেন না? এই যে শহর জুড়ে থিমের মণ্ডপ নিয়ে এতো মাতামাতি, সেগুলোও কি তাঁদের অদেখাই থেকে যাবে? না। এঁদের কথা ভাবারও লোক আছে। যেমন রিয়েলটেক নির্মাণ। প্রত্যেক বছর পঞ্চমীর দিন, কলকাতা পুলিশের ‘প্রণামের’ সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এঁরা শহরের প্রবীণ নাগরিকদের বিভিন্ন পুজা মণ্ডপ ঘুরিয়ে দেখান। এই সুযোগে এই বয়স্ক মানুষগুলো আবার তাঁদের ছেলেবেলার ঢাকের তালে ধুনচি নাচের দিন গুলোয় ফিরে যান।
রিয়েলটেক নির্মাণের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিশির গুপ্ত জানিয়েছেন, “পুজোর দিনগুলোর মধ্যে অন্তত একটা দিনও যদি এই মানুষগুলোকে একটু আনন্দ দেওয়া যায়, তাই বা কম কি। সেই কারণেই আমাদের এই ছোট প্রয়াস। এটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আমরা প্রতিবছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করি। ওঁদের সঙ্গে আমাদের কিছু মধুর স্মৃতি তৈরি হয়। সারা বছর সেই স্মৃতি আমাদের আনন্দ দেয়।”
প্রতি বছরের মতো এবছরও, পঞ্চমীর দিনে রিয়েলটেকের উদ্যোগে আর্মহার্স্ট স্ট্রিট থানায় সমবেত হবেন তাঁরা। সেখানে পতাকা উত্তোলনের পরই বেরিয়ে পড়বেন প্যান্ডাল হপিং করতে। সারা দিনের জন্য। ঠাকুর দেখা ছাড়াও তাঁদের জন্য এবছর বাউল গানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশিষ্ট কিছু মানুষও এই যাত্রায় তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তৃণমূল নেতা ও পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের মন্ত্রী সাধন পান্ডে। থাকবেন ডিসি নর্থ দেবাশিস সরকার, ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামী, মাইনরিটি ফোরামের শেখ হাবিব।
গত নয় বছরে প্রায় ৯০০০ প্রবীণ মানুষ এই উদ্যোগের শরিক হয়েছেন। যত দিন যাবে সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলেই ধারণা রিয়েল টেক কর্তৃপক্ষের। ঠাকুর দেখার সময় বয়স্ক মানুষগুলো কোনও অসুবিধায় যাতে না পড়েন তার দিকে রিয়েল টেকের কর্মীরা সর্বদা সতর্ক থাকেন। কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেই কারণে, একটি মেডিক্যাল টিমও তাঁদের সঙ্গে থাকে। হেঁটে হেঁটে প্যান্ডাল হপিং করতে গিয়ে যাতে রোদ না লাগে, সেই কারণে এসি ভলভো বাস থেকে নামার পরই তাঁদের হাতে টুপি দেওয়া হয়। সঙ্গে জলের বোতলও দেওয়া হয়। এবারও এগুলোর ব্যতিক্রম হবেনা।
রিয়েলটেকের দুই কর্ণধার শিশির গুপ্ত, শেখ নাসিরের নেতৃত্বে বয়স্ক মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর উদ্যোগ উৎসবের দিনগুলোকে আরও বৃহৎ ও উজ্জ্বল করে তোলে।বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে ঠাকুর দেখার মজাই আলাদা। আর রিয়েল টেকের উদ্যোগে বয়স্কদের এই দিনভর ঠাকুর দেখার হইচই, এখন যেন পারিবারিক বাৎসরিক গেট টুগেদারের মতোই হয়ে উঠেছে।