নতুন ছবির প্রচার ও বিশেষ স্ক্রিনিং- এর জন্য কলকাতায় এলেন নন্দিতা দাস এবং নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। তাঁদের সঙ্গে হাজির ‘মান্টো’- ও। নন্দিতা পরিচালিত সাদাত হাসান মান্টোর বায়োপিক ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবির প্রিমিয়ার হওয়ার পর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলেন পরিচালক নন্দিতা এবং নামভূমিকায় অভিনয় করা নওয়াজ। কলকাতায় বিশেষ স্ক্রিনিংয়ের আগে সেই জয়ের প্রশান্তি দেখা গেল দু’জনের মুখেই।
তবে ছবির শুটিং পর্ব খুবই কঠিন ছিল। মান্টোর বিরাট জীবনের ঘটনাবলি কয়েক ঘণ্টার ছবিতে কতটা আর তুলে ধরা যায়! তাই চিত্রনাট্যে একটা টাইমলাইন বেঁধে নিয়েছিলেন পরিচালক। নন্দিতার কথায়, ‘১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়টা মান্টোর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর ওই সময়টায় মান্টো বম্বেতে ছিলেন। তার পর দেশভাগ হলে তাঁকে লাহৌরে চলে যেতে হয়। উনি কিন্তু জানতেন না যে, এ রকম কিছু একটা হবে। আর বম্বেকে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে। লোকে যখন দেশভাগের আগে ওঁকে জিজ্ঞেস করত, উনি পাকিস্তান যাবেন কি না, উত্তরে বলতেন, বম্বে যদি পাকিস্তানে চলে যায়, তা হলে আমিও পিছন পিছন যেতে পারি!’
কিন্তু ওইটুকু ক্যানভাসে দেশভাগ এবং মান্টোর জীবনে তার রেশ তুলে ধরা যে খুব সহজ ছিলনা তাও জানালেন নন্দিতা। তাঁর কথায়, ‘ওইটুকু অংশ তুলে ধরাটা কঠিন ছিল। তবে আমি সেটা করতে পেরেছি কারণ, এডিটিং করতে আমার ভাল লাগে। বিশাল একটা কাহিনি থেকে কেটেছেঁটে মানুষকে প্রভাবিত করবে এ রকম ছোট একটা অংশ আমার ছবিতে রেখেছি। তার সঙ্গে ভাবতে হয়েছে, যাঁরা মান্টো সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাঁদের কাছে কেমন করে বিষয়টার উপস্থাপন করা যাবে।’ মান্টোর বাড়ির লোকের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন তিনি। ‘ওঁর মেয়েদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন অবশ্য ওঁরা খুব ছোট ছিলেন। তবে এক জন বৌদি আছেন, তিনি আমাকে সাফিয়ার (মান্টোর স্ত্রী) গল্প করেন। কারণ সাফিয়ার গল্প তো কোথাও পাওয়া যায় না…’ জানান নন্দিতা।
মান্টোর প্রভাব এড়াতে পারেননি নওয়াজও। তিনি বলেন, ‘মান্টোর ব্যক্তিত্ব, চিন্তা এমনই যে, একটু কিছু ওঁর সম্পর্কে জানতে বা পড়তে পারলেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য। একটা সাহস পাওয়া যায় মান্টোর লেখায়। মানুষ মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে পারে। কিন্তু ভাবনাকে অন্য মানুষদের সামনে প্রকাশ করতে পারার সাহসটা দরকারি। সেটা মান্টো জোগাতে পারেন। সব থেকে বড় যে ব্যাপার সেটা হল মান্টোর যে চিন্তাধারা বা সেনসিবিলিটি সেটা আমার চিন্তাধারা এবং সেনসিবিলিটিও বটে। আমি যদি সমাজের বিরুদ্ধে কোনও ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাই তাহলে আমার মুখ দিয়েও মান্টোর মতোই একই কথা বেরোবে। আমার মাথায় ছিল মান্টো যে সততার সঙ্গে কথা বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন, সেটা যেন আমার সংলাপের মধ্যে ধরা পড়ে। এটাই আমার কাছে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং ছিল। এখন শুধু আমি নই, যে কোনও কেউ যে সত্য কথা বলতে চায় তারাই মান্টোকে নিজে ভাববে। আমরা এমনিতেই অনেক কম্প্রোমাইজ করে বসে থাকি। আজও যদি মান্টো বেঁচে থাকতেন তাহলে একইরকম জোরের সঙ্গে কথা বলতেন যা তিনি ১০০ বছর আগে বলেছিলেন। এখনও আমাদের মধ্যে বহু মান্টো জীবিত আছেন যাঁরা একইরকম জোরের সঙ্গে কথা বলেন। সত্যকে সামনে আনেন। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সেটা ধরিয়ে দেন’। নওয়াজের মতে এ এক বিশাল প্রাপ্তি। যার মূল্য অর্থ দিয়ে বিচার করা যায়না। এ কারণেই তিনি ছবির পারিশ্রমিক হিসেবে মাত্র এক টাকা নিয়েছেন, জানান নওয়াজ।
ছবির পরিচালক নন্দিতার বিষয়ে বলতে গিয়ে নওয়াজ বলেন, ‘নন্দিতা প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে রিসার্চ করেছে এই ছবি নিয়ে। যখন ফিল্মটা শুরু করেছিলাম তার আগে পাঁচ-ছয় দিন ওয়ার্কশপ করেছিলাম। ১৯৪০-শের দশক, তখনকার সংলাপ, তখনকার ‘মাহোল’ তৈরির ক্ষেত্রে নন্দিতা প্রায় লেডি মান্টো হয়ে গিয়েছিল! আমাদের, অভিনেতাদের কাছে খুব সোজা হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। কারণ ও সবার অভ্যেস, বিহেভিয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মুখস্ত করে নিয়েছিল। আমরা মান্টোর মেয়েদের সঙ্গে পাকিস্তানে দেখাও করেছিলাম।’
বাংলা ছবি ও টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গে নওয়াজ বলেন, ‘আমি অন্য সমস্ত ছবির সঙ্গে বাঙালি ছবি দেখে বড় হয়েছি। আমি যা দেখেছি, যে সমস্ত অভিনেতা, পরিচালক – তারা দুনিয়ার সব থেকে সমৃদ্ধ সিনেমার অন্তর্গত। কিন্তু আজ যখন আমি বাংলা সিনেমা দেখি, তখন দেখি সমস্ত হিরোরা বলিউডকে নকল করছে। ওই দু’হাত ছড়িয়ে গান গাওয়া, এক বিশেষ ভঙ্গীতে কথা বলা। ভাবুন, এই সিনেমাকে এক সময় স্বর্ণযুগের সিনেমা বলা হত। সারা পৃথিবী এই বাংলা ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিত হত। তার এখন কী দশা! আমি এটা এই জন্য বললাম যে আমি নিজে সব সময় চেষ্টা করি বলিউডের হিরোর খোলস থেকে বোরিয়ে এসে নতুন কিছু করার। আমি তিনটে ছবিতে গ্যাংস্টারের চরিত্র করেছি, তিনটে তিনরকমভাবে করেছি। কিন্তু আজ যদি তিনটে পর পর বলিউডি হিরোর চরিত্র করতাম তাহলে এ প্রশ্নটা উঠত না।’
নন্দিতা দাস পরিচালিত ‘মান্টো’ ছবিটি মুক্তি পাবে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর। তবে ‘মান্টো’-কে স্রেফ ছবি বলতে নারাজ নন্দিতা। তাঁর কাছে মান্টো একটা আইডিয়া। যা তিনি বহুদিন ধরেই দেখাতে চেয়েছিলেন পর্দায়।