২৮শে জুন বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। নিউ ইয়র্ক শহরে স্টোনওয়াল ইন বলে একটি ক্লাবে সমকামী মানুষের আনাগোনা ছিল। ১৯৬৯ সালের ২৮শে জুনেও সেখানে চলছিল রোজকার মত পার্টি। হঠাৎ সেখানে পুলিশের রেডে আচমকাই হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে উত্তাল হয় সারা দেশ। ‘স্ট্রেট’ এবং ‘গে’ – এই বিভেদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে নাগরিক সমাজ, যার আঁচ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে এবং সৃষ্টি হয় এক নবজাগরণের। শুরু হয় ‘প্রাইড’ উৎসব।
ভারতে প্রথম প্রাইড ওয়াক হয় নব্বইয়ের দশকে। আমাদের প্রিয় শহর এই তিলোত্তমা কলকাতায়। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে বাংলা পথ দেখিয়ে আসছে সারা দেশকে। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের সূচনাও এই শহরে। আমরা জানি ২রা জুলাই এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ২০০৯ সালে এই দিনেই আইপিসি সেকশন ৩৭৭কে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সমকামী সম্পর্ক কে বৈধতা দিয়েছিল দিল্লি হয় কোর্ট। কিন্তু অনেকেই জানেন না, ২রা জুলাই ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম প্রাইড ওয়াক অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার বুকে।
হালের আড়ম্বর, চাকচিক্য গ্ল্যামার হয়তো ১৯৯৯ এর সেই প্রাইড ওয়াকে ছিল না, কিন্তু সেই ঘটনার মাধ্যমে সেদিনকার অংশগ্রহণকারীরা একটি বার্তা দিয়েছিলেন। মানবাধিকার এবং সমতার জন্য প্রত্যয়ের সাথে সূচনা হয়েছিল এক লড়াইয়ের। আর সেই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিল আমাদের প্রিয় শহর।
কিভাবে এই বিপ্লবের সূচনা হল? কৃতিত্ব ইন্টারনেটের। বিভিন্ন ই-ফোরামের মাধ্যমে অনেক এলজিবিটি গ্রুপ তৈরী হয়েছিল, যার মধ্যে এলজিবিটি ইন্ডিয়া ছিল একটি। এই গ্রুপের এক সদস্য ওয়াইস খান উদ্যোগ নেন ভারতেও একটি প্রাইড ওয়াকের আয়োজন করার। কথা বলেন বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। বোম্বে, দিল্লি না কলকাতা – কোন শহরে অনুষ্ঠিত হবে এই প্রাইড ওয়াক? বিপ্লবের এক অভূতপূর্ব ঐতিহ্যর জোরে অন্য শহরগুলিকে টেক্কা দিল কলকাতা। ওয়াইস খানের মতে কলকাতার মজ্জায় মজ্জায় লেখা রয়েছে প্রতিবাদ। মত প্রকাশের অধিকার থেকে শুরু করে ব্যক্তি স্বাধীনতা – সব ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আমাদের প্রিয় শহর। তাই অনায়াসেই বেছে নেওয়া হয় তিলোত্তমাকে।
২রা জুলাই ১৯৯৯ – সেই ঐতিহাসিক দিনে বিশেষ টিশার্ট পরে রাস্তায় নেমেছিলেন ১৫ জন যুবা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলকাতায় পা মেলাতে এসেছিলেন অশোক রাও কবি, নিতিন কারানি, পবন ঢল, ওয়াইস খান, রফিক-উল-হক রা। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল যায় উত্তর কলকাতার দিকে, অন্যরা দক্ষিণে। পথচলতি মানুষকে বোঝান তাদের উদ্দেশ্য।
১৯৯৯ এর পর কলকাতায় দ্বিতীয় প্রাইড ওয়াকটি হয় ২০০৩ সালে। প্রায় ৫০ জন পার্ক সার্কাস ময়দান থেকে হাঁটেন জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন অবধি। পরের বছর অংশগ্রহণ করেন ২০০ জনেরও বেশি মানুষ। অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়াতে ২০০৫ সালে এই ‘প্রাইড’ সপ্তাহব্যাপী উৎসবের আকার নেয়। মার্কিন সেন্টারে আয়োজিত হয় সেমিনার, অনুষ্ঠিত হয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালও। জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড ক্যাকটাসের তরফে প্রকাশ করা হয় ‘পক্ষীরাজ’ গানটি।
যত বছর গড়ায়, প্রাইড ওয়াকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বেড়েই চলে। এখন তো এটাকে ‘কলকাতা রেইনবো প্রাইড ফেস্টিভ্যাল’ নাম দেওয়া হয়েছে। কলকাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০০৮ সালে দিল্লি, বোম্বে, বেঙ্গালুরুতেও চালু হয় প্রাইড উৎসব।