বনপথে চলছে আপনার গাড়ি। পথের দুপাশে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, জানলার পাশ দিয়ে ত্রস্ত পায়ে মাঝেমধ্যেই ছুটে যাচ্ছে হরিণ, কখনও বা পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে লেপার্ড। কোন জায়গায় আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে মেছো বিড়াল কিংবা শেয়ালের সঙ্গে। আর টানা পাখির ডাক তো চলছেই। না, এ কোন ওয়াইল্ড লাইফ মুভির দৃশ্য নয় কিংবা আপনি মাসাইমারা বা অ্যামাজনের জঙ্গলেও পৌঁছে যান নি,এ দৃশ্য ঘরের কাছেই বেঙ্গল সাফারি পার্কের। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রেমের সঙ্গে উদ্ভাবনী ভাবনা মিশলে কি হতে পারে তার এক চমৎকার উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের এই প্রথম সাফারি পার্ক। রাজ্যবাসীকে এই পার্ক উপহার দিয়েছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ভাবনা ও দূরদর্শিতাই পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রের মুকুটে এই নতুন পালকটি যোগ করেছে।
সুখবর কিন্তু এখানেই শেষ হচ্ছে না, অরণ্যের সংসারে এসেছে আরও তিন নতুন সদস্য। সাফারি পার্কের বাঘিনী শীলা তিনটি শাবক প্রসব করেছে। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের কোন সাফারি পার্কে বাঘ জন্মালো। বাঘ বাড়লো রাজ্যে। রাজ্যের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে এর থেকে ভাল খবর আর হয় না। সত্যিই জঙ্গল যেন হাসছে। শাবক তিনটি সারাক্ষণই বাঘিনীর স্তনে মুখ দিয়ে দুধ খাচ্ছে। কখনও বা দুধ খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ছে তারা। এ এক দুর্লভ দৃশ্য, যা শুধু দুচোখ ভরে দেখতে হয়। যার সাক্ষী হতে পেরে আমার মন ভাল হয়ে গেল। সাফারি পার্কে গিয়ে দেখলাম শীলাকে এখন রাখা হয়েছে শাবক তিনটির বাবা স্নেহাশিসের পাশের খাঁচায়। তিনটি শাবকের একটির রঙ সাদা। এই রহস্য ফাঁস করছি পরে।
এবার শীলা আর স্নেহাশিসের সংসারের কথা বলে নেওয়া যাক। এদের আনা হয়েছিল ওড়িশার নন্দন কানন থেকে। একটি শাবকের রঙ সাদা কারণ, ওদের বাবা স্নেহাশিসের মা নেহার গায়ের রঙ ছিল সাদা। আবার বাঘিনী শীলার ঠাকুমা শ্রেয়াও ছিল সাদা বাঘিনী। যাই হোক, নবজাতকদের নিয়ে এখন সাফারি পার্কের কর্মীদের ব্যস্ততা ও সতর্কতা তুঙ্গে। চব্বিশ ঘন্টা সিসিটিভিতে পালা করে নজরদারিতে ব্যস্ত রয়েছেন ছ জন কর্মী। নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া আর কাউকেই এদের ধারেকাছে আসতে দিচ্ছেন না তারা। ছ মাস পর দিদি এই শাবক তিনটির নামকরণ করবেন। সাফারি পার্কে আসা দর্শনার্থীরা এরপরই এদের দেখতে পাবেন।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর পর্বের মত এই সাফারি পার্কেরও একটা জন্ম বৃত্তান্ত আছে। আমি তার সাক্ষী। শিলিগুড়ি থেকে নয় কিলোমিটার দূরে শালুগোড়া পাঁচ মাইল এলাকায় এই সাফারি পার্কটি আদতে দিদির ভাবনার ফসল। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর দার্জিলিং সফরের সময় কালিম্পং যাওয়ার পথে সেবক রোড পেরিয়েই দিদি এই জায়গাটি দেখেন। চমৎকার পরিবেশ, পথের দুপাশে ঘন শাল গাছের জঙ্গল,তখন জায়গাটার নাম ছিল সরিয়া পার্ক। সরিয়া মানে শাল গাছ। তখন জায়গাটা দেখাশোনা করত বন দপ্তর। মাথায় ভাবনা এলেই তার থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সময় নেন না। তিনি বর্তমান পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবকে নির্দেশ দিলেন, জঙ্গলটা এভাবে ফেলে না রেখে এখানে একটা সাফারি পার্ক করতে হবে। কারণ, রাজ্যে কোন সাফারি পার্ক নেই। এখানে সাফারি পার্ক করলে জায়গাটার পর্যটন আকর্ষণ আরও বাড়বে। ২০১৪ সালে ২৯৭ হেক্টর অর্থাৎ প্রায় আড়াই একর জমির ওপর এই সাফারি পার্কের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।
আর এখন তো বেঙ্গল সাফারি পার্ক বিশ্ববাসীর কাছেও এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন বিন্দু হয়ে উঠছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, চিন, কোরিয়া সহ নানা দেশের পর্যটন বিশেষজ্ঞরা এই সাফারি পার্কের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। শীলা, স্নেহাশিস ও বিভান এই তিনটি বাঘ ; ঊর্মিলা আর লক্ষ্মী নামে দুটো হাতি এবং ধ্রুব ও জেনিফার নামে দুটো ভাল্লুক পর্যটকদের কাছে এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া জঙ্গলে অন্যান্য জন্তুরা তো রয়েইছে। পার্ক খোলা থাকে সকাল ন-টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। গোটা সাফারি পার্ক ঘোরার মাথাপিছু প্রবেশ মূল্য ১৫০ টাকা। তবে হাতির পিঠে ঘুরলে লাগবে মাথাপিছু ৩০০ টাকা। প্রথমে ভাবা হয়েছিল টাকাটা একটু বেশি হয়ে গেছে কিন্তু মানুষের চাহিদা সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করেছে। সাফারি পার্কে এখন অগ্রিম অনলাইন বুকিং ছাড়া ঢোকাই যায় না। শুধু ঢোকাই নয়, খাবার, পার্কিং, স্যুভেনির সমেত সবকিছুই এখানে অনলাইন বুক করা যায়।
দিদির উদ্ভাবনী ভাবনা ছড়িয়ে আছে এই পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণেও। একসময় যারা এখানে গাছ কাটতো কিংবা ভিড়ে যেত চোরাশিকারিদের দলে এখন তারাই এই সাফারি পার্কের দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত।