সল্টলেকে ইই ব্লকে আমি যেখানে থাকি সেখানে সবুজ যে কম তা নয়, বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখি নিকো পার্কের উল্টো দিকে খালের পাশ দিয়ে যে পার্ক তাতে সারি সারি গাছ, কিন্তু সবই কেমন যেন বেশ সাজানো গোছানো। চারপাশে ছায়া আর মায়া ছড়িয়ে বেড়ে ওঠা বড় গাছ শহরে কেমন যেন অনুপস্থিত। আমি গ্রামের ছেলে, আমার কাছে গাছ মানে তার ডালে বসে থাকা পাখির ডাক, তার ছায়ায় দুদণ্ড জিরিয়ে নেওয়া মানুষ কিংবা কোন ডানপিটে ছেলের দোল খাওয়া। এসব কিছু না থাকলে গাছ ব্যাপারটা আমার কাছে একটা গোটা চেহারা পায় না। পরিবেশ দিবসের দিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব সাতসতেরো ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, বিউটিফিকেশনের নামে শুধুই বাধ্য স্টুডেন্টদের মত একবগ্গা গাছপালার বদলে শহরে বড় গাছের সংখ্যা বাড়ালে পরিবেশ ও মানুষ দুইয়েরই সুবিধা হয়। ইদানিং পরিবেশবিদরাও একথা বলছেন।
বট, অশ্বথ, বেল, নিম, পাকুড়, কাঠ চাঁপার মত বড় গাছ শহরে আজকাল প্রায় আর দেখাই যায় না। অনেকে বড় গাছ লাগানোর বিপক্ষে যুক্তি দেন, এতে জায়গা বেশি লাগে। কিন্তু দেখেছি জায়গা থাকতেও শহরের বৃক্ষ সংসারে বট, অশ্বথের মতো বড় ভাইরা জায়গা পান না। বৃক্ষপ্রেমীদের এনিয়ে বড়ই দুঃখ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়লো দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভাঙড়ের একটু আগে শিখরপুর নার্সারির সুভাষ মুখার্জির কথা। তিনি আমাকে চমৎকার ভাবে গাছের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। আমার গড়গড় করে মনে পড়ে গেল তার বলা সেই কথাগুলো- একটা গাছ তো শুধুই একটা গাছ নয়, তাকে ঘিরেই বাঁচে একটা জীবনচক্র। একটা চেরি গাছে ফল হয়, সেই ফল খেতে পাখি আসে। ফল খাওয়ার পর সে গাছের ডালে বিষ্ঠা ত্যাগ করে আবার তা খেতে আসে একটা বিশেষ প্রজাতির বড় পিঁপড়ে, এরপর সেই পিঁপড়ে খেতে আসে আর এক প্রজাতির পাখি। সুভাষ বলেছিলেন, পরিবেশের স্বার্থেই এই জৈব শৃঙ্খলাটাকে বাঁচিয়ে রাখা খুব দরকার। ছোট গাছের এত সব ব্যাপারই নেই। একটা বড় গাছে আপনার চার পুরুষ উপকৃত হবে।
সুভাষ বাবুর কথা মনে পড়তেই ওকে ফোন লাগালাম। ফোন ধরেই তিনি বললেন, ভালদিনে ফোন করেছেন। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। সারাদিনে নার্সারিতে ১৩০টা নিম গাছের চারা বিক্রি হয়েছে। লোকের ভাবনা চিন্তা কিন্তু বদলাচ্ছে। ওকে বললাম, অন্য লোকের কথা জানিনা আমি কিন্তু আপনার কথায় ইনফ্লুয়েন্সড। আমার বাড়ির সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানে আমি দশটা চেরি গাছ লাগাবো বলে ঠিক করেছি। তাতে পাখি বসবে, সেই পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবে আমার। খুব বেশি চাওয়া হল? সুভাষ বাবু হেসে বললেন, এতো ডি এল রায়ের কবিতা হয়ে গেল মশাই, সেই যে, ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জেগে’ আমি হেসে ফেললাম।
শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য ছোট গাছ লাগানোর পাশাপাশি বড় গাছও লাগানো দরকার। এতে ভূমিক্ষয় কম হবে, ঝড়ের দাপটে গাছপালা ভাঙার সংখ্যা কমবে, বাঁচবে জৈব শৃঙ্খলা, কমবে বায়ু দূষণ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ির ধোঁয়া থেকে যে বায়ু দূষণ হয় তা রোধ করতে বড় গাছগুলো একটা বড় ভূমিকা নেয়। গাড়ির তেলের ধোঁয়ায় সীসে থাকে, তা বড় গাছগুলো টেনে নেয়।
পরিবেশ দিবস শুরু ও শেষ হল নানা প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণা দিয়ে। সেমিনার, পদযাত্রা, আলোচনা সভা, প্রদর্শনী সব জায়গাতেই একই ছবি। কিন্তু এর পাশাপাশি আপনার আমারও কিছু দায় থেকে যায়। কারণ পরিবেশ বাঁচানোর দায়িত্ব শুধুই সরকার বা এন জি ও দের! এই বর্ষাতেই একটা জরুরি কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। আসুন, মানুষের কাছে গাছের যা একটু যত্নআত্তি পাওনা হয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে বাড়ির আশেপাশে বা অন্য যে কোন জায়গায় আমরা সবাই ছোট, বড় যাই হোক, একটা দুটো গাছ লাগাই। আপনি যেমন বাড়িতে কুকুর বা অন্য কোন পোষ্যকে পালন করছেন তেমন ভাবেই বড় করুন একটা গাছকে। গাছও তো বড় করেছে মানুষকে। একটু ছায়া আর মায়ার ভরসাতেই তো অরণ্যের পাশে ঘর বেঁধেছিল মানুষ, গাছপালাই তাকে লালনপালন করেছিল। এবার আমাদের গাছকে তা ফিরিয়ে দেওয়ার পালা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)