বঙ্গীয় বামদের দ্বন্দ্বমূলক ধান্দাবাদ সত্যিই বোঝা দায়! ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপিকে হঠানোর যে বিপুল তোড়জোড় শুরু করেছিলেন তা আচমকাই কেমন যেন ভেস্তে গেল। দুর্জনেরা বলছেন, এটা এমনি এমনি ঘটেনি বরং এটাই ছিল সিপিএমের আসল গেমপ্ল্যান। কারণ, নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মত সিপিএম মনেপ্রাণে চাইছে রাজ্যে বিজেপি আসুক। তবেই তৃণমূলকে টাইট দেওয়া যাবে। আমার মনে হয় কথাটা অনেকাংশেই ঠিক। কংগ্রেস, সিপিএম নির্বাচনী আসন সমঝোতায় আলোচনার শুরুর থেকেই ভেস্তে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পর্বের দিকে নজর রাখলে একথা পরিষ্কার হবে।
অন্যদিকে বাংলায় কংগ্রেসের রাজনীতিও আবর্তিত হয় মমতা বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে, বিজেপি বিরোধিতা আসে পরে। আর বিজেপিও জানে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করলে বাংলা জয় করা যাবে না। তিনটি দলেরই স্থানীয় নেতাদের প্রতিহিংসা, উচ্চাশা এবং নির্বুদ্ধিতা পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে। আসন সংখ্যা যাই হোক না কেন প্রথম থেকেই কংগ্রেসকে এলেবেলের মত ট্রিট করেছে সিপিএম। ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি-র মত শরিকরা আসন ছাড়তে চাইছে না বলে কমিয়ে এনেছে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা। কংগ্রেস চেয়ে বসেছে যেখানে তাদের শক্তি নেই এমন আসন। আর বিজেপি নির্বাচন যে একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তা ভুলে গিয়ে ভরসা করছে আধা সামরিক বাহিনীর ওপর। মানুষ এই তিনরকম মনোভাবের ওপরই বিরক্ত। ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটবে।
মানুষ পরিষ্কার লক্ষ্য করছেন বিজেপিকে হঠানো নয়, সিপিএম ও কংগ্রেস এই দুটো দলের কাছে দেশের স্বার্থের তুলনায় দলের স্বার্থই বড়। রাজ্য সিপিএম প্রথম থেকেই বিজেপিকে হঠাতে মহাজোটের বিরুদ্ধে। বাংলায় তৃণমূল আয়োজিত ইউনাইটেড ইন্ডিয়া সমাবেশে অংশগ্রহণ করেনি তারা। যদিও দিল্লিতে বিজেপি বিরোধী মহাজোটের সমাবেশে ইয়েচুরিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। কেনই বা এখানে করলেন না আর কেনই বা দিল্লিতে করলেন তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা এখনও আমরা সিপিএমের কাছ থেকে পাইনি। বিমান- সূর্যকান্তদের সংকীর্ণ রাজনীতি দেশের রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষিতটাকেই ঝাপসা করে দিল।
অথচ প্রথম থেকেই স্থির হয়েছিল বিজেপিকে রুখতে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়া হবে, তাহলে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হবে না। বিরোধী সব দল এতে একমত হয়েছিল। কার্যত হল ঠিক উল্টো। রাজ্যের প্রধান দুটি বিরোধী দল, যাদের অতীত গৌরবের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই তারাই নিজেদের কাল্পনিক শক্তির বড়াই করে আসন নিয়ে এমন ঝগড়াঝাঁটি লাগিয়ে দিলেন যাতে বিজেপি বিরোধী লড়াইটাই পিছনে চলে গেল। এতে বিজেপি ছাড়া আর কারো লাভ হলনা। দুটি দলের কেউই তাদের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বিজেপির বিরুদ্ধে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা মাথায় রাখলেন না। কথাটা শুধুমাত্র একটা স্লোগান হয়েই রইলো। এই দ্বিচারিতার শাস্তি তারা ভোটের বাক্সেই পাবেন।
দুর্জনেরা বলেন সিপিএম এই জোটটা চাইছিল না কারন, তারা জানে বিজেপি এলে তাদের অপশাসন ও জনবিরোধী নীতির ফলে অচিরেই মানুষের ঐ দলটি সম্পর্কে মোহভঙ্গ হবে। বিজেপি ও অ-বিজেপি দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যাবে মানুষ। সাংগঠনিক শক্তি বেশি হওয়ার সুবাদে মানুষ তাদের কাছে আসতে বাধ্য হবে। মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই আবার ক্ষমতায় ফিরবেন তারা। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর এই রাজনীতিতে মানুষের কোন জায়গা নেই। বিজেপি ক্ষমতায় এলে উন্নয়নের রাস্তায় জোরকদমে চলতে শুরু করা আমাদের রাজ্যটি যে আবার পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করবে তা নিয়ে এদের কোন মাথাব্যাথা নেই।
এরা এটাও বুঝতে পারছেন না, বিজেপি নামক আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী দলটির ক্ষমতায় থাকা আর না থাকা অবস্থার মধ্যে একটা আকাশ-পাতাল ফারাক আছে। ক্ষমতায় থাকলে তারা হিংস্র দানবের মত, তখন তার মোকাবিলা করা কঠিন। রাষ্ট্রের বা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন ও পরস্পরের প্রতি হিংসা এবং সন্দেহের পরিবেশ অনেক সহজ হয়। তখন উন্নয়ন বা স্বাধীন মতপ্রকাশের কোন পরিসরই থাকে না। আজ যারা নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করার জমিটাই নষ্ট করে দিলেন, তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই এর ফলে বিপন্ন হবে। কারণ, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ প্রথম আঘাত হানে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর।
সবাই বলছেন বাংলায় এবার চতুর্মুখী লড়াই। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, জোট ভেঙে যাওয়ার ফলে লড়াইটা আসলে দ্বিমুখী। বাংলায় বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস সবারই সাধারণ শত্রু কিন্তু এক। তা হল আমাদের দিদির নেতৃত্বে পরিচালিত তৃণমূল কংগ্রেস। তিনটি দলই জানে রাজ্যে তৃণমূলকে উৎখাত না করা গেলে তারা মুছে যাবে। তৃণমূল বিরোধিতা বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেসের পতাকাকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এমন বিচিত্র পরিস্থিতি দেশের অন্য কোন রাজ্যে তৈরি হয়নি। ভোট যুদ্ধেও বাংলা সবার থেকে আলাদা হয়ে রইলো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত