বর্তমান সময়ে বাঙালির জীবনে ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ একটি ভুলে যাওয়া নাম। তিনি শুধুমাত্র হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নন, তিনি ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে বেশিরভাগ মানুষেরই খুব বেশীতে বেশি হলে স্কুল জীবনে পড়া বাংলা সাহিত্যের স্মৃতির সুতোটুকু ধরে মনে ও মুখে প্রশ্ন আসে – ‘‘ইনি কি সেই যিনি চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন?’’ কিন্তু ‘বাঙালির সাহিত্য চর্চায়’ তাঁর ‘জীবন ও অবদান’ যে শুধুমাত্র ‘চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার’ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ‘বাঙালি কে?’ যে বাংলা ভাষায় কথা বলে সেই বাঙালি। বিশ্বের যে কোনও দেশে সে থাকতে পারে। তবে তাঁর সাজের কাজের ভাবনার ভালবাসার মধ্যে যেন বাংলার একটু ছোঁয়া থাকে। সে বাংলা ভাষা বাঁচে কেমন করে? ভাষা বাঁচে ব্যবহারে। ভাষা তো আর বাহারি ঠুনকো গয়না নয় যে তাকে আতু-পুতু করে তুলোর আরামে বন্দি করে রাখতে হবে! ভাষা হচ্ছে শ্রমিক মানুষের মতো। তার পায়ে লাগবে ধুলো, তার গায়ে বইবে ঘাম, সে ইচ্ছে হলে একলহমায় ভাড়া বেয়ে উঠবে সাতমহলায়,আবার নামবে টালির ঘরে। যেখানে খুশি যেতে পারে যে-ভাষা, যেখানে খুশি কাজে লাগতে পারে যে-ভাষা সে ভাষার তত বোল-বোলাও। এই যে ইংরেজি ভাষার আজকাল এতো রমরমা তার কারণ কী? কারণ, সে ভাষাকে যা-ইচ্ছে-তাই কাজে লাগানোর কলকব্জা দ্রুত তৈরি করে ফেলা হচ্ছে। আগে তাও ‘রাণীর ইংরেজি’ বলে আভিজাত্যের বালাই ছিল। এখন ইংরেজি হরেক-রকম। সাহিত্যের অলংকৃত ইংরেজির দিন গিয়েছে, কাজের ইংরেজির পালে হু-হু করে হাওয়া লাগছে, নানা দেশে নানা-রকম ইংরেজির চল।সব মিলিয়ে ব্যবহারে ব্যবহারে ইংরেজি তার রাজ্যপাট বিস্তার করেই চলেছে। ব্যবহারের খাল-বিল নদী-নালা দিয়ে ভাষার নৌকা বাইতে পারলেই যে বাঙালির পোয়াবারো এই সত্যটা ঊনিশ শতকের বাঙালি বেশ বুঝেছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘নূতন কথা গড়া’ নামে এক প্রবন্ধে সে-কথা ব্যাখ্যা-বিস্তার করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমরা তখন নতুন-নতুন বিষয়-আশয় ভাব-ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছি। বাংলা ভাষায় তা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত শব্দ চাই। শব্দ যদি থাকে তো ভাল, না থাকলে শব্দ গড়ে নিতে হবে, এ-ই শাস্ত্রী মশাইয়ের অভিমত। ‘সংস্কৃত’ থেকে শব্দ নেওয়া যেতে পারে, ‘দিশি শব্দকে’ কাজে লাগানো যেতে পারে অথবা যে দেশের ভাব সে দেশের শব্দ ধার করা চাই। মোদ্দাকথা হল, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানা কাজে লাগানোর জন্য নিত্য মুখের ভাষাকে ও লেখার ভাষাকে গড়ে নিতে হবে। এই নানা কাজ বড় হতে পারে, আবার ছোটও হতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। বড়-ছোট সমান গুরুত্বপূর্ণ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাংলা পড়লে অবাক হতে হয় – কী অনায়াস সহজ প্রকাশভঙ্গি, চলিত এমনকি দেশজ শব্দের ব্যবহারে ভরা! এ যুগে বাংলা শব্দের ব্যবহার বিষয়ে পণ্ডিতমহলে এবং সমাজমাধ্যমেও নানা চর্চা ও তর্ক, তাঁদের সকলের হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা ‘নূতন কথা গড়া’ নামে প্রবন্ধটি অবশ্যই পড়া উচিত। এই প্রবন্ধ থেকে শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে শাস্ত্রীমশাইয়ের দেওয়া একটা-দুটো উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। ‘ভঙ্গপ্রবণ’, ‘ভঙ্গুর’ ও ‘ঠুনকো’, এই তিনটে শব্দ পাশাপাশি এনে তিনি শেষে বলছেন, ‘ভঙ্গপ্রবণ’ শব্দের ভাব ‘ভঙ্গুর’-এ তত নেই, যতটা আছে তথাকথিত ‘ইতর ভাষা’ ‘ঠুনকো’ শব্দের মধ্যে। ‘অবজার্ভেটরি’ শব্দের বাংলা তাঁর সময়ের লেখকরা করেছেন ‘পর্যবেক্ষণিকা’, কিন্তু তিনি বলছেন ‘মানমন্দির’-এর কথা। এমনকি গাড়োয়ানরা জায়গাটাকে ‘তারা ঘর’ বলে ডাকে, এই শব্দবন্ধ তাঁর কাছে স্পষ্টতর। তাঁর নিদান ছিল, “যাহা সকলে বুঝে – তাহাই চালাও; যাহা চলতি নয়, তাহাকে আনিও না।” “যাহা চলতি, তাহা ইংরেজীই হউক, পারসীকই হউক, সংস্কৃতই হউক – চলুক।” তিনি নিজের শেষ জীবনে নিজের লেখায় সাধারণ সংস্কৃত শব্দও বদলে দিতেন, ‘সহস্র’-কে ‘হাজার’ করে দিতেন। সংস্কৃত বিভক্তি প্রত্যয় বাংলায় ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না।
‘বিচিত্র বিষয়ে বহু পুঁথি সংগ্রাহক’ ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’-র সমাধানেও এগিয়ে এসেছিলেন। ‘দীনেশচন্দ্র সেন’ ‘এক জন চণ্ডীদাসের কথা’ বলেছিলেন, কিন্তু হরপ্রসাদ মনে করতেন, ‘তিন জন চণ্ডীদাস’ ছিলেন – ‘চৈতন্য-পূর্ব বড়ু চণ্ডীদাস’, ‘চৈতন্য-পূর্ব পদাবলির চণ্ডীদাস’ এবং ‘চৈতন্য-পরবর্তী দীন চণ্ডীদাস’। আবার ‘কাশীরাম-বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘কাশীরাম দাস’ নিজে তাঁর লেখা ‘মহাভারতের’ মাত্র ‘চারটি পর্ব’ রচনা করেছিলেন (কবির ভাই ‘গদাধর দাস’ অবশ্য এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন, কাশীরাম সবটাই রচনা করেছিলেন)। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ‘জয়গোপাল গোস্বামী’র ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’ বিষয়ে পণ্ডিতমহলে আলোড়ন উঠেছিল। ‘দীনেশচন্দ্র সেন’ প্রমুখ সেটিকে ‘বাংলায় লেখা প্রথম চৈতন্য-জীবনীগ্রন্থ’ বলে মনে করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কিন্তু সেই বিষয়ে ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’-র প্রামাণ্যতা গ্রহণ করেননি। পরবর্তী কালে ‘সুকুমার সেন’, ‘অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ও এটিকে নকল বলে মনে করেছিলেন। ‘ভারতমহিলা’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে শাস্ত্রীমহাশয় নিজে কী বলেছিলেন, তা দেখা যেতে পারে। ‘আর্যদর্শন মাসিক’ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য প্রথমে তিনি ‘যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাভূষণের’ কাছে গিয়েছিলেন। ‘বিদ্যাভূষণ’ তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি বাপু যে সকল ‘ভিউ’ দিয়াছ, আমার সঙ্গে তা মেলে না। আমূল পরিবর্তন না করিলে আমার কাগজে উহা স্থান দিতে পারি না।” হরপ্রসাদের উত্তর ছিল, তাঁর নিজের কোনও ‘ভিউ’ নয়, পুরাণ পুঁথিতে তিনি যা পেয়েছেন, তিনি তা-ই সংগ্রহ করে লিখেছেন (‘বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়ায়’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ, বঙ্কিম সংখ্যা, ১৪০২)। ফলস্বরূপ ‘আর্যদর্শন’-এ ‘ভারতমহিলা’-র ঠাঁই হয়নি। পরে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় সেই প্রবন্ধের ‘প্রথম তিন পরিচ্ছেদ’ ছাপা হয়েছিল, ‘বাকি পরিচ্ছেদ’ চলবে কি না জানতে চাইলে ‘সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র’ হরপ্রসাদকে বলেছিলেন, “যাহা ছাপাইয়াছি সে রূপা, এসব কাঁচা সোনা।” ‘লখনউ’ থাকাকালীন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার জন্য হরপ্রসাদ লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধ ‘বঙ্গীয় যুবক ও তিন কবি’, তা পড়েও খুশি হয়েছিলেন ‘বঙ্কিম’। হরপ্রসাদ ‘লখনউয়ের ক্যানিং কলেজে’ ‘সংস্কৃত’ পড়াতে গিয়েছিলেন ‘বিদ্যাসাগরের’ আশীর্বাদ নিয়ে। তাঁর মানসিক চরিত্র গঠনে এই মানুষটির গভীর প্রভাব ছিল। সে জন্যই হয়তো ‘সাহসী ও প্রখর যুক্তিবাদী হরপ্রসাদ’ অনেক পরে তাঁর ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “বাঙালী এখন কেবল এ-কেলে ‘গণিকাতন্ত্রের’ উপন্যাস পড়িতেছেন। একবার সে-কেলে সহজিয়াতন্ত্রের একখানি বই পড়িয়া মুখটা বদলাইয়া লউন না কেন?” সেই উপন্যাস ‘হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতির বিচিত্র নিদর্শনের অপূর্ব সমাহার’ দেখতে পাওয়া যায়।
‘মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য বিষয়ে’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাবনা আমাদের অবাক করে। তিনি ‘মুক্তি’, ‘পরমাত্মায় মিশে যাওয়া’, এ সবের ধারেকাছেও কোনদিন যাননি, ‘মানুষকে দয়া’, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার ধারণা’ও তাঁর ছিল না। আমরা সকলেই মানুষের কাছে নানা ভাবে ‘ঋণী’। আমাদের ‘জীবনের উদ্দেশ্য’ সে ‘ঋণ’ শোধ করা। ‘সমাজের জন্যে’, ‘মানুষের মঙ্গলের জন্যে’ কাজ করার কারণ হিসেবে আমাদের ‘দায়বদ্ধতার’ যে তার তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন, তা অনন্যসাধারণ। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে হরপ্রসাদ লিখেছিলেন, “মনুষ্যজীবনের দেনা যে যাহার নিকট হইতে লইয়াছি তাহাকেই শোধ দিতে হইবে তাহা নহে। লইলাম সমাজের নিকট দিলাম সমাজকে; পিতামাতার খাইয়া মানুষ হইলাম, মানুষ করিলাম সন্তানকে। দাতার খাইয়া মানুষ হইলাম, দিলাম অনাথকে। দরিদ্রালয় হইতে মানুষ হইলাম, স্থাপন করিলাম বিদ্যালয়। গুরুর নিকট উপদেশ পাইলাম, শিক্ষা দিলাম ছাত্রকে। গ্রন্থকারের নিকট উপদেশ পাইলাম, নিজে গ্রন্থ পাঠ করিয়া রচনা করিয়া তাহার ঋণ শোধ দিলাম। কিন্তু সর্বত্র চেষ্টা করা উচিত যাহা পাইয়াছি তাহার অধিক দেওয়া। … অনেকে মনে করেন বিদ্যা জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মোন্নতি জীবনের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিদ্যা যদি খরচ না হইয়া শুদ্ধ পেটে গজগজ করে তবে বিদ্যায় কাজ কী? যদি সেই বিদ্যা দ্বারা তুমি আপন দেনা শোধ দিয়া সমাজকে কিছু ঋণ দিয়া যাইতে পারো তবে তো জানি তোমার জীবন সার্থক। … বিদ্যা যশ ধন মান পরোপকার এ সকল অতি উৎকৃষ্ট পদার্থ হইলেও ইহার কোনটিই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। নিজের শরীর ও মনের উন্নতি হইয়া নিজের কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া তাহার পর বিদ্যা দ্বারা হউক, ধন দ্বারা হউক, পরিশ্রম দ্বারা হউক সমাজকে কিঞ্চিৎ ঋণী করিয়া যাইতে পারিলে জীবনের উদ্দেশ্য সফল হইল। নচেৎ শুদ্ধ বিদ্যা লইয়া, ধন লইয়া, শক্তি লইয়া, স্বাস্থ্য লইয়া ধুইয়া খাইলে কিছুই হইবে না।”
বাঙালির জীবনে খুব বড় পণ্ডিতও যে অনালোচিত, বিস্মৃত হতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রয়াণ হয়েছিল ১৯৩১ সালের ১৭ই নভেম্বর। তার ত্রিশ বছরের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখালিখিতে এই মন্তব্য পাওয়া যায় যে, তাঁকে নিয়ে বড় একটা কথা বলেন না কেউ। এ দুর্ভাগ্য বাঙালির, তবে এটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে ‘‘বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি’’, একদা এই কথা বলে গিয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নিজেই! তাঁর স্মৃতিধন্য ‘নৈহাটি’তে ‘সত্যজিৎ চৌধুরী’ গড়ে তুলেছিলেন ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গবেষণা কেন্দ্র’, সে তো মনস্বী মানুষের ব্যতিক্রমী কৃতি। কিন্তু ‘সাধারণ বাঙালি’ তাঁকে ভুলে গিয়ে তাঁর উক্তির ‘মান রেখেছে’, এটাই হয়তো হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘দূরদর্শিতার প্রমাণ’, বা সবচেয়ে বড় ‘আয়রনি’। সত্যিকারের ‘মহামহোপাধ্যায়’রা সেই কবে থেকে যে ‘বাঙালির স্মৃতিজীবন’ থেকে মুছে গিয়েছেন! ‘উপাধি’ হিসেবে এক ‘বিদ্যাসাগর’ চিরজীবী হয়ে আছেন ‘ঈশ্বরচন্দ্রের সহশব্দ’ হয়ে, কিন্তু একদা ‘বিদ্যাসাগরের বাড়ির ছাত্রাবাসে থেকেই কিছু দিন পড়াশোনা করা’, ‘উত্তরকালে মস্ত সংস্কৃতজ্ঞ’, ‘পুরাতত্ত্ববিদ’ ও ‘ভারতবিদ্যাবেত্তা’ হরপ্রসাদের ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি তাঁকে মনে রাখার পথে বাঙালির বিশেষ কাজে লাগেনি বলেই মনে হয়। অথচ সে কালে ‘ব্রিটিশ সরকার’ তাঁর পরামর্শেই ঠিক করত, কাকে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দেওয়া হবে!
শৈশবে তাঁর নাম ছিল ‘শরৎনাথ’। ‘নৈহাটির বিখ্যাত ভট্টাচার্য বংশে’ তাঁর জন্ম হয়েছিল ৬ই ডিসেম্বর ১৮৫৩ সালে। তাঁর পিতা হলেন ‘রামকমল ভট্টাচার্য ন্যায়রত্ন’, যিনি পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের মতে বাংলার সবচেয়ে বড় পণ্ডিতদের এক জন; আর তাঁর দাদা ছিলেন ‘নন্দকুমার ন্যায়চুঞ্চু’। একসময় ‘ভাটপাড়া-নৈহাটির পণ্ডিত-পরম্পরা’ ভারত জুড়ে বিখ্যাত ছিল। হরপ্রসাদ বিভিন্ন প্রসঙ্গে নিজেই বলেছিলেন, তাঁদের পরিবারে ‘সংস্কৃত শিক্ষা ও বিবিধ শাস্ত্র-সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি’ লাভ করে কত জন যে পণ্ডিত হয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। বাল্যেই পিতৃহারা ছেলেটিকে ‘দাদা নন্দকুমার’ মানুষ করছিলেন, কিন্তু অকালমৃত্যু হয়েছিল তাঁরও। বড় হয়ে, একটা সময়ে কলকাতার ‘সংস্কৃত কলেজে’ ভর্তি হয়েছিলেন হরপ্রসাদ। তবে তখন আর তিনি ‘শরৎনাথ’ ছিলেন না। কঠিন অসুখে পড়ে প্রাণসংশয় হয়েছিল ছোট ছেলেটির, ‘হরের প্রসাদে’ নবজীবন লাভ করেছিলেন, তাই তাঁর নাম বদলে হয়েছিল ‘হরপ্রসাদ’। ‘বিদ্যাসাগরের বাড়ির ছাত্রাবাসে’ যে কিছু দিন ছিলেন, কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি সে কথা স্মরণ করেছিলেন পরে। ‘সংস্কৃত কলেজ’ থেকে তিনি পাশ করেছিলেন ‘এনট্রান্স’, ‘এফএ’, হয়েছিলেন ‘সংস্কৃতে স্নাতক’। ‘এমএ’ পাশ করে হয়েছিলেন ‘শাস্ত্রী’। সেটা ছিল ১৮৭৭ সাল। মনে রাখা দরকার, তিনি ‘টোলে’ও পড়েছিলেন, আবার বড় হয়ে উঠতে উঠতে ঊনিশ শতকের নবজাগরিত বঙ্গে ‘ইংরেজি তথা আধুনিক ও বিজ্ঞানস্পৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার নির্যাস’ও টেনে নিয়েছিলেন নিজের মধ্যে। বর্তমান সময়ে ‘সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্য-শাস্ত্র’ ইত্যাদির প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা যুগপৎ ‘ঔদ্ধত্য ও উপেক্ষা’ প্রকাশ করে ফেলি নিজেদের হাবেভাবে, যেন ‘মনু’-র বাইরে ‘সংস্কৃত’ নেই, বা ‘সংস্কৃত’ যা কিছুই অতীতে ছিল সেগুলো সবই ছিল ‘রামগোঁড়া’ ও ‘রামগরুড়’। হরপ্রসাদের ‘সরস জীবন ও পাণ্ডিত্য’ আমাদের এই ভুল ধারণার গালে জোর থাপ্পড় কষায়। ‘বিষয়ের জ্ঞান’ তাঁর ‘পূর্ণ অধিগত’ ছিল, তার ‘প্রসার ও প্রয়োগে’ তিনি কার্পণ্য করেননি। এর ‘সাক্ষ্য’ তাঁর পরবর্তী জীবনের দুই কর্মক্ষেত্র, কলকাতার দুই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান – ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’।
তাঁর জীবনের শুরুটা হয়েছিল ‘সাহিত্য’ দিয়েই। সে পথে তাঁর গুরু ছিলেন স্বয়ং ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’। ১৯২৩ সালে ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ’কে লেখা একটা চিঠিতে হরপ্রসাদ নিজেকে উল্লেখ করেছিলেন বঙ্কিমের ‘বঙ্গদর্শনের সহযোগীদের শেষ সদস্য’ বলে। ‘নৈহাটি’তে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’কে ঘিরে থাকত একটা ‘সাহিত্যবৃত্ত’, তরুণ হরপ্রসাদ ছিলেন তার ‘বঙ্কিমবিমুগ্ধ’ লিখিয়ে। ‘ভারতমহিলা’ প্রবন্ধ লিখে ‘হোলকার মহারাজার ঘোষিত পুরস্কার’ পেয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজের তরুণ ছাত্র হরপ্রসাদ, ‘বঙ্কিম’ সেটা ছেপেছিলেন নিজের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। সেই সময়ে যে কোন উঠতি লেখকের কাছে ‘বঙ্কিমের সান্নিধ্য’ আর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নিজের লেখা ছাপা হওয়া ছিল ‘স্বর্গসিঁড়ি’, হরপ্রসাদ তাতে তরতরিয়ে উঠেছিলেন কারণ ‘বঙ্কিম’ যথেষ্ট স্নেহ করতেন তাঁকে। শুধু ‘বঙ্কিমবাবু যদি পড়েন’ আর পড়ে ‘ভাল হয়েছে’ বলেন, সেই আশাতেই একের পর এক প্রবন্ধ লিখতেন তিনি, ছাপা হোক কি না হোক তাতে ক্ষতি ছিল না। এর পরে পরে হরপ্রসাদ লিখেছিলেন ‘বাল্মীকির জয়’ (আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে লেখাকে বলেছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম গদ্যকাব্য), হরপ্রসাদের সেই লেখা ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় শুধু প্রকাশই করেননি ‘বঙ্কিম’, এর জন্য ‘পত্রিকার নিয়ম’ও ভেঙেছিলেন তিনি। নিময়টি ছিল, যে লেখা ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বেরিয়েছে, তার ‘সাহিত্য-সমালোচনা’ আর সেই পত্রিকায় বেরোবে না। কিন্তু ‘বঙ্কিম’ নিজে হরপ্রসাদের লেখা ‘বাল্মীকির জয়’ প্রবন্ধের দীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন ‘বঙ্গদর্শন’-এ। হরপ্রসাদের লেখাকে বলেছিলেন ‘উজ্জ্বলতম রত্ন’। আবার কখনও ‘নিজের সাহিত্যগুরু’র কাছে রামবকুনিও খেয়েছিলেন হরপ্রসাদ। তখন ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হচ্ছিল ‘বঙ্কিম ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়’, হরপ্রসাদের উপন্যাস ‘কাঞ্চনমালা’ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে। উপন্যাসটি ছিল ‘বৌদ্ধধর্মের সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-আশ্রয়ী উপন্যাস’, ‘উপন্যাসের মূল চরিত্র’ ছিলেন ‘অশোক-পুত্র কুণাল’, তাঁর ‘বিমাতা তিষ্যরক্ষা’, ‘স্ত্রী কাঞ্চনমালা’। ‘তিষ্যরক্ষা’ ‘কুণাল’কে কামনা করেন, ‘উপেক্ষিত হয়ে’ মহাক্রোধে কুণালের দুই চোখ উপড়ে পায়ে পিষতে চান। সেই উপন্যাস পড়ে খেপে গিয়েছিলেন বঙ্কিম। তখন একটু একটু করে ‘বাংলা ও বাঙালির সাহিত্যরুচি’ ‘শালীন’ করে তুলছিলেন তিনি, ‘হরপ্রসাদের প্লট’, ‘চরিত্র ও তাঁদের মূল্যবোধ’ সেই রুচিতে ‘বিষম বাগড়া’ বাধিয়েছিল। সেই সময়ে ‘গুরু-শিষ্যের মতান্তরের উল্লেখ’ হরপ্রসাদের লেখাতেই পাওয়া যায়। তবে সেই মতান্তরের শেষ ‘তিক্ততায়’ হয়নি, হয়েছিল বাংলা উপন্যাস লেখায় হরপ্রসাদের আপাত-ইতিতে। ‘কাঞ্চনমালা’ বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশের বত্রিশ বছর পরে। এরপরে হরপ্রসাদ আর একটিমাত্র উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় ‘বেণের মেয়ে’, সেটা অনেক পরের ঘটনা, ১৯১৯ সালের। নিজের ‘সাহিত্যগুরু’ ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, “… বাংলাদেশের ইতিহাস লিখবার একজন লোকের আগ্রহ ছিল, তিনি বঙ্কিমবাবু; তিনি আমার প্রতিবেশী, তাঁর সঙ্গে সৌহার্দ্য ছিল। … তাঁর আগ্রহ ছিল এবং মালমসল্লা খোঁজার ভার আমার উপর ছিল। কাঁটালপাড়ায় তাঁর বাড়িতে যেতাম, আলোচনা হত। মোটের উপর সাতটা প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল।” বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনের সহযোগীদের শেষ সদস্য’ হরপ্রসাদের সঙ্গে ‘সাহিত্যসম্রাটের’ প্রথম সাক্ষাৎকারের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে তাঁকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন ‘রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’। হরপ্রসাদ লিখেছিলেন, “তাঁহারা চারি ভাই শ্যামাচরণবাবুর বাড়িতে বসিয়া গল্প করিতেছেন। তারের বেড়া ডিঙাইলেই শ্যামাচরণবাবুর বাড়ির দরজা। রাজকৃষ্ণবাবু বাড়ি ঢুকিলেন, তাঁহার সঙ্গে আমারও এই প্রথম প্রবেশ। রাজকৃষ্ণবাবুকে তাঁহারা খুব আদর-অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন, আমিও বসিলাম।” ‘বঙ্কিমের চার ভাইয়ের নাম’ হরপ্রসাদের জানা ছিল, তিনি অনুমানক্রমে কোন জন কে চিনে নিয়েছিলেন। এক সময় ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ রাজকৃষ্ণের কাছে ‘হরপ্রসাদের পরিচয়’ জানতে চাইলে ‘রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’ তাঁকে বলেছিলেন, “বাড়ি নৈহাটি, সংস্কৃত কলেজে পড়ে, এবার বি এ পাশ করিয়াছে।” শুনে হরপ্রসাদকে ‘বঙ্কিমের’ প্রশ্ন ছিল, “আমাদের এখানে আসো না কেন?” হরপ্রসাদ মৃদুস্বরে তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘সঞ্জীববাবু’র ভয়ে, ‘কামিনী গাছের ফুল’ ছিঁড়লে তিনি নাকি মারেন। তাঁর উত্তর শুনে সকলে হোহো করে হেসে উঠেছিলেন।
মাত্র দুটো উপন্যাসের লেখক ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাংলা ভাষা’ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন ‘সুকুমার সেন’। তিনি বঙ্কিম-ভক্তদের প্রতি ‘ছদ্মভয়’ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘‘… মোটামুটিভাবে হরপ্রসাদ বঙ্কিমচন্দ্রের অপেক্ষাও ভালো – অর্থাৎ সহজ সরল সতেজ ও তীক্ষ্ণ – বাংলা লিখিতেন।’’ তবু যে তিনি আর বাংলা সাহিত্যে থাকেন নি, স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন ‘জ্ঞানচর্চার বহুধাবিস্তৃত কিন্তু অনালোকিত জগতে’, তাতে শেষমেশ লাভ হয়েছিল বাংলা ও বাঙালিরই। ‘সাহিত্যের পাড়’ ভেঙেছিল বটে, কিন্তু গড়ে উঠেছিল ‘ভাষা-ইতিহাস-ধর্ম-সমাজ-পুরাতত্ত্ব-প্রত্নতত্ত্বের সমাহারে ভারতবিদ্যা তথা প্রাচ্যবিদ্যার এক উর্বর পরিসর’। জীবনের এই অধ্যায়ে হরপ্রসাদের ‘গুরু’ ছিলেন – ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’। ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁস’-এর অন্যতম ‘প্রতিনিধি’ এই মানুষটি সম্পর্কে আজকের বাঙালি বেশি জানে না। এটুকু বললে খানিক ধারণা হতে পারে – বর্তমানে দেশ-রাজ্য-অঞ্চল নির্বিশেষে ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ নিয়ে যে অজস্র গবেষণা, ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’ ছিলেন সে ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ‘প্রথম ভারতীয় সংস্কৃতি-ইতিহাসবিদ’, লিখতেন ইংরেজিতে। ১৮৮৫ সালে ‘এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সভাপতি’ ছিলেন তিনি। তাঁর ‘সহকারী’ হিসেবে কাজ করে ‘সংস্কৃত প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ও পুরাতত্ত্ব চর্চার কর্মপদ্ধতি’ আয়ত্ত করেছিলেন তরুণ হরপ্রসাদ। ‘এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকল্পে’ ‘নেপালের সংস্কৃত বৌদ্ধ পুঁথির বিবরণমূলক ক্যাটালগ’ তৈরির কাজ করছিলেন ‘রাজেন্দ্রলাল’, আর তাঁর ‘সহকারী’ হরপ্রসাদের কাজ ছিল ‘পুঁথির ইংরেজি সারসংক্ষেপ তৈরি করা’। ‘রাজেন্দ্রলালের’ যুবা সহকারীর ইংরেজি গোড়ায় পছন্দ হয়নি, কিন্তু প্রকাশিত বইয়ের মুখবন্ধে দেখা গিয়েছিল, ‘রাজেন্দ্রলাল’ সমূহ প্রশংসা করেছিলেন হরপ্রসাদের। এভাবেই শুরু হয়েছিল। ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’র মৃত্যু হয়েছিল ১৮৯১ সালে। পরের বছরেই হরপ্রসাদ ‘এশিয়াটিক সোসাইটির ভাষাতত্ত্ব কমিটির সম্পাদক’ হয়েছিলেন, ‘প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ও প্রকাশের মহাদায়িত্ব’ এসে পড়েছিল তাঁর কাঁধে। সে পথে বহুদূর হেঁটেছিলেন তিনি। আবার ‘পথ ও পথিক’, ক্রমে দুটোই পাল্টেছিল। ‘সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের পণ্ডিত’ মাত্রেই যে ‘ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চায়’ নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারবেন তা নয়। শুধুমাত্র ‘পাণ্ডিত্যেই’ হবে না, চাই ‘সংস্কারমুক্ত বিচারশক্তি’ – ‘রাজেন্দ্রলাল’ এটাই শিখিয়েছিলেন হরপ্রসাদকে। হরপ্রসাদ সে পথেই এগিয়েছিলেন, পথও তৈরি করে নিয়েছিলেন। ‘পুরাতত্ত্বের’ ব্যাপারটাই এমন, এক কালের শিক্ষা অন্য যুগে ‘তামাদি’ বা ‘ভুল’ প্রমাণিত হয়, সেটা স্বাভাবিকও। ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ ছিলেন হরপ্রসাদের ছাত্র, টা বলে তাঁর বা ‘রমেশচন্দ্র মজুমদারের’ ‘পাথুরে প্রমাণ ঘরানাকে’ হরপ্রসাদ কোনদিন ‘তর্কাতীত’ মনে করেননি। তা বলে ছাত্রকে ঠেলে সরিয়েও দেননি। ‘রাখালদাসের’ ‘পাষাণের কথা’-র ভূমিকা তিনিই লিখেছিলেন। ‘অধীত বিদ্যা’র সঙ্গে ‘প্রজ্ঞা ও বিশ্বাসের মিশেলে’ তৈরি হয়েছিল শাস্ত্রী মশাইয়ের ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি বোঝার সিদ্ধান্ত’। সেই স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তের অনেকাংশ একুশ শতকে কার্যকারিতা হারিয়ে থাকতে পারে, তাতে তাঁর মহত্ত্ব খর্ব হয় না। একটা সময়ে হরপ্রসাদের টেবিল দেখিয়ে ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ বলতেন, “এই টেবিল থেকে আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি লোক ডক্টরেট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছি।” ‘তিব্বত ও তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম’ নিয়ে হরপ্রসাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসতেন ‘শরৎচন্দ্র দাস’, তাঁর সঙ্গে ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতির’ আলোচনায় বসতেন ‘স্যর যদুনাথ সরকার’, ‘মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্ন’। ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্রের’ পরে ‘সংস্কৃত প্রাচীন পুঁথির জ্ঞান’ বাংলায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাড়া আর কারও নেই – এটাই ছিল তখনকার বিশ্বাস।
‘নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে’ ‘চর্যাপদের পুঁথি’ ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এ তথ্য কারও কারও জানা। এই আবিষ্কারের বাইরে সমগ্র হরপ্রসাদকে চেনেন-জানেন কম মানুষই। ‘চর্যাপদ’ এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রাচীন এই গ্রন্থকে উদ্ধার করে হরপ্রসাদ আসলে ‘বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বকে’ ‘ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠা’ দিয়েছেন। তবে শুধুই কি ‘চর্যাপদ’? ‘সন্ধ্যাকর নন্দী’র ‘রামচরিত’ – যা একই সঙ্গে ‘সীতাপতি রাম ও সমসাময়িক পাল রাজা রামপালের প্রশস্তি-কাব্য’ – তারও ‘সন্ধান’, ‘সম্পাদনা’ ও ‘প্রকাশ’ শাস্ত্রী মশাইয়ের হাত ধরেই হয়েছিল। ‘মৈথিলী ভাষার’ প্রাচীন পুঁথি ‘বর্ণরত্নাকর’, ‘রামাই পণ্ডিতের’ ‘শূন্যপুরাণ’, ‘মানিক গঙ্গোপাধ্যায়ের’ ‘ধর্মমঙ্গল’ ‘সংগ্রহ ও প্রকাশ’, ‘কাশীরাম দাসের মহাভারতের’ ‘আদি পর্ব্ব’ ‘সম্পাদনা’, আরও কত রত্নরাজি রয়েছে তাঁর মুকুটে! ‘উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারত’, ‘নেপাল’ – যেখানেই তিনি গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই দিনের আলোয় এসেছিল অজ্ঞাতপূর্ব বহু তথ্য। বহু ‘শিলালিপি’, ‘তাম্রশাসন অনুসন্ধান ও পাঠোদ্ধার’ করেছিলেন তিনি। ‘বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাস’ ও ‘সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যের সুপ্রতিষ্ঠা’ হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। বাংলার জনসমাজে বহু স্তরে নানা আচার-অনুষ্ঠানে কী করে মিশে আছে ‘বৌদ্ধধর্মের নির্যাস’, তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘ডিসকভারি অব লিভিং বুদ্ধিজ়ম ইন বেঙ্গল’- এর মতো বইয়ে। ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কীর্তি’ ‘নোটিসেস অব স্যানস্ক্রিট ম্যানাস্ক্রিপ্টস’-এর মতো বিরাট কাজ, হরপ্রসাদই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ থেকে ১২০ বছর আগে শাস্ত্রী মশাই শুরু করেছিলেন ‘নোটিসেস’-এর ‘নিউ সিরিজ’, সেখানে ‘হরপ্রসাদ-আলোচিত হাতে লেখা পুঁথির সংখ্যা’ চোদ্দোশোরও বেশি! ‘ভারতবিদ্যার’ কোনও ‘হল অব ফেম’ নেই, নইলে ‘অজস্র দুষ্প্রাপ্য পুঁথির খোঁজ ও আবিষ্কারের জন্য’ই হরপ্রসাদের সেখানে চিরস্থায়ী ঠাঁই হত। যে ভাবে তিনি এই সব মণিমুক্তোর ‘প্রকাশনা’, ‘সম্পাদনা’, ‘বিবরণ ও মতামত’ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, তার গুরুত্ব বুঝতে পারা সাধারণের পক্ষে মুশকিল। তিনি দিয়ে গিয়েছেন বিপুল এক আকর, সেখানে ‘সংস্কৃত, বাংলা ও অন্য ভাষার’ও ‘সাহিত্যের ইতিহাস রচনার অমূল্য উপাদানের’ ছড়াছড়ি।
তিনি একে মস্ত পণ্ডিত, তায় ‘সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ’, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত ও বাংলার প্রধান’, ‘এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি’র মতো ‘পদাধিকারী’, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ সঙ্গী, অভিভাবক ছিলেন। ‘মহামহোপাধ্যায়’ আর ‘শাস্ত্রী’ উপাধি তো তাঁর ছিলই, তিনি আবার ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি’র ‘ডি লিট’, ব্রিটিশ সরকারের ‘কম্প্যানিয়ন অব দি (অর্ডার অব দি) ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ (‘সিআইই’) খেতাবধারীও ছিলেন। তাঁর বাড়ির লাইব্রেরিতে ছিল ‘বেদ’, ‘পুরাণ’, ‘তন্ত্র’, ‘ইতিহাস’, ‘কাব্য’, ‘অলঙ্কার’ – আরও কত বিষয়ের বাঘা বাঘা বই, দেশ-বিদেশের তাবড় গ্রন্থাগারের ‘ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ’। এই মানুষ কি ‘রাশভারী’ না হয়ে পারেন? কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ‘ব্যক্তি হরপ্রসাদ’ ছিলেন ‘সহজ আলাপী মানুষ’, এবং ‘রোম্যান্টিক’ও। তাঁর ‘প্রিয় কবি কালিদাসের’ মন বুঝতে তিনি পর পর তিন বছর ‘রামটেক’ গিয়েছিলেন ভরা বর্ষায়। ‘সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ’ থাকাকালীন এক বার নাটক করিয়েছিলেন, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’। ঐতিহাসিক নাটকের সময়কালটা ঠিক করে ধরতে পোশাক ও অলঙ্কারের নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন নিজে! শাস্ত্রী মশাই ‘ভোজনরসিক’ ছিলেন। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসতেন, তাঁর ‘স্মৃতিকথায়’ ‘গুণমুগ্ধদের বয়ানে’ ‘সরস্বতীপুজো বা বাড়িতে বিয়ে-উপনয়নের মতো উৎসব-অনুষ্ঠানে’ বিস্তর খাওয়াদাওয়ার জবরদস্ত হাজিরা পাওয়া যায়। তিনি ‘নৈহাটির গজা’ খেতে ভালবাসতেন। যে জায়গার যে মিষ্টি ‘নামকরা’ যেমন – ‘বর্ধমানের মিহিদানা-সীতাভোগ’, ‘পেনেটির গুঁপো সন্দেশ’, ‘জয়নগরের মোয়া’, ‘জনাইয়ের মনোহরা’ – সেগুলোর বরাত দিতেন। এমনকি তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে সন্দেশ রাখা থাকত, খেতেন মাঝেমধ্যে। জানা যায়, এক বার কেউ একটা কাজ করে দেওয়ার অনুরোধ করার পরে, প্রৌঢ় হরপ্রসাদ তরুণ সহকারীর সাহায্য নিয়ে সেটা করে দিয়েছিলেন। অর্থের ব্যাপার ছিল না, কিন্তু তা বলে কি তাঁর ‘ছোকরা সহকারীর’ কাজের দাম নেই? তিনি সেই ব্যক্তিকে ‘সের দুই সন্দেশ’ পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য! – এমনটাও হয়! হরপ্রসাদের কাছে হত। তিনি ‘একাদশী থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা’য় খেতেন ‘সাবুর খিচুড়ি’, ‘পানিফলের লুচি-রুটি’। ‘বৈশাখ মাসে’ খাবার পাতে ‘নিমফুলভাজা’ ছিল তাঁর খুব পছন্দের। তিনি বলতেন, ‘‘সম্রাট অশোকও নিমফুলভাজা খেতেন!’’ তিনি ‘সুরসিক’ও ছিলেন। ‘বাংলার জনসমাজ ও লৌকিক জীবন’কে তার প্রাচীন শিকড়সুদ্ধ জানতেন বলেই হয়তো, তাঁর ‘রোজকার কথাবার্তা-রসিকতায়’ মিশে থাকত ‘জনজীবনের লব্জ’, ‘প্রবাদ’, ‘ছড়া’, ‘গানের বোল’, এমনকি ‘আদিরসের ছোঁয়া’ও। এমনকি বার্ধক্যেও সেই ‘রসবোধ’ তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁর ‘যুবক সহকারীদের’ অনেকে তাঁর কাজের প্রয়োজনে বাড়িতেই থাকতেন-খেতেন। এক দিন কাজে নতুন যোগ-দেওয়া এক সহকারীর জন্য তিনি নিজের ভৃত্য ‘রামলাল’কে পাঠিয়েছিলেন, ‘শিঙাড়া-রসগোল্লা’ আনাতে। পরের দিনও একই নির্দেশ দেওয়ার পরে তাঁর সেই সহকারী বলেছিলেন, ‘‘ও সব কী দরকার, রোজ রোজ কেউ ও সব খায় না কি? অল্প মুড়িমুড়কি আনালেই হবে।’’ শুনে শাস্ত্রী মশাইয়ের সহাস্য উত্তর ছিল, ‘‘তুমি তো বেশ চালাক দেখছি! শিঙাড়া-রসগোল্লা তো দু’-এক দিন খাইয়েই বাদ দিতাম, এখন সামান্য মুড়িমুড়কি আটকাই কী করে?’’ আরেকবার তাঁর এক সহকারী ‘বাথরুম’ যাওয়ার মুখে হরপ্রসাদ ও জনৈক অতিথির কথা শুনছিলেন, শাস্ত্রী মশাই হঠাৎ তাঁর উদ্দেশে বলে উঠেছিলেন, “যাও না হে কর্তা! বৃন্দাবনটা সেরে এসো না!” ‘হঠাৎ বৃন্দাবন বললেন কেন’ প্রশ্নে পরে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে তাঁর উত্তর ছিল, “ঐ ভদ্রলোকের সামনে পাইখানা যাও বল্লেই বুঝি ভাল হত?”
‘সুদীর্ঘ ব্রাহ্মণ্য-পরম্পরার স্রোত’ ছিল তাঁর বংশে, কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে ‘গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী’ বলা যাবে না। তাঁর রক্তে ‘টোল’ও ছিল, ‘ইংরেজি শিক্ষা’ও ছিল! ‘সংস্কৃতের সনিষ্ঠ পাঠ’ ছিল, আবার ‘ইতিহাস-পুরাতত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত বোধ’ও ছিল! এক দিকে তিনি ‘একাদশীর উপবাস’ করতেন, সেদিন ‘অন্ন’ খেতেন না। ‘মদ’ স্পর্শ করতেন না – ঊনিশ শতকীয় ‘বাবু কালচারের স্রোতে’ ভেসে নয়, অসুস্থ হলে ‘ডাক্তারি পরামর্শে’ও নয়। একটা চিঠিতে তিনি নিজের ‘বিহার-প্রবাসী’ ছেলেকে লিখেছিলেন, সে যেন ‘পাখিটাকি’ না খায়। ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি’তে তিনি নিজের অফিসঘরে তেষ্টা পেলে গ্লাসে জল খেতেন না, ‘ডাব’ এনে দিতে বলতেন। ‘বৈদিক মন্ত্রে’ তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি ‘আহ্নিক ও গায়ত্রীজপ’ করতেন। তাঁর পূজাপাঠ বলতে ছিল ঐটুকুই। ‘পুজোপাঠের বাহুল্য’ তাঁর ছিল না। তিনি ‘উপনয়নে’ বিশ্বাস করতেন, তবে ‘দীক্ষায়’ নয়। তিনি বলতেন, ‘‘দীক্ষা এসেছে বৌদ্ধধর্ম থেকে, ওর দরকার নেই।’’ তাঁর ‘নীতিনিষ্ঠা’ ‘মানবিক নৈতিকতার পথে’ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। যে যখনই ‘অর্থী’ হয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে, তাঁর পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন – তা সে ‘অর্থসাহায্য’ই হোক বা ‘চাকরির শংসাপত্র’। তিনি ঢাকায় ‘জগন্নাথ হল’, ‘মুসলিম হলের ছাত্রদের’ সাহায্য করেছিলেন। ‘বঙ্গভঙ্গ থেকে অসহযোগ’, কোনও ‘রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে’ সংস্রব রাখেননি কখনও। তবে তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইয়ে একটা পরিচ্ছেদের নাম ছিল ‘ভারতে ইংরাজ শাসনের সুফল’, নিজের ‘জীবনের উপান্তে’ এসে তিনি তাঁর সহকারীকে বলেছিলেন, ‘‘এই বৃদ্ধ বয়সে আর মিথ্যে কথা লিখতে পারবেন না, পারলে ‘সুফল’ শব্দটা কেটে ‘কুফল’ করে দিন।’’ শেষে তাঁর নির্দেশে অধ্যায়টার নাম হয়েছিল ‘ভারতে ইংরাজ রাজত্বের ফল’।
‘বিজ্ঞজনেরা’ বলেন, হরপ্রসাদের সূত্রে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ মতো প্রতিষ্ঠান যেমন লাভবান হয়েছিল, তেমনটা হতে পারত ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’ও। হয়নি, তার কারণ ‘স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বনিবনার অভাব’। এই বিষয়ে নানা ‘গল্পগাছা’ চালু আছে। সেগুলোর একটা হল, ‘স্যর আশুতোষ’ তাঁর বিধবা মেয়ে ‘কমলা’র ফের বিয়ে দেওয়ায় হরপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়েছিল। খটাখটি ছিল কাজ নিয়েও। ‘প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চপদে নির্বাচন’ নিয়েও দু’জনের মধ্যে ‘দ্বৈরথ’ হয়েছিল। তবে সেটা ‘মতান্তর’ই ছিল, ‘মনান্তর’ ছিল না, তা হরপ্রসাদ নিজেই বলে গিয়েছিল। ‘স্বার্থান্বেষী স্তাবকেরা’ ‘স্যর আশুতোষ’কে ভুল বুঝিয়েছিল। আসল ছবিটা হল, ‘হরপ্রসাদের পাঠানো সন্দেশের’ ভক্ত ছিলেন ‘স্যর আশুতোষ’। হরপ্রসাদের দেরি হলে বা তিনি ক’দিন না এলে ‘স্যর আশুতোষ’ চিঠিতে সেটা জানাতেন। আর সবচেয়ে বড় ‘হরপ্রসাদি প্রমাণ’ হল – ‘স্যর আশুতোষের পুত্রদের’ সকলের নামের সঙ্গে জুড়ে আছে ‘প্রসাদ’ আর ‘হরপ্রসাদের ছেলেদের’ নামের সঙ্গে জুড়ে আছে – ‘তোষ’!
(তথ্যসূত্র:
১- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহিত্যকর্ম, শিপ্রা রক্ষিত দস্তিদার, বাংলা একাডেমি।
২- Haraprasad Shastri: A Study on Creative Works and Literary Criticism, Dr. Alok Saha, Noihrita Cafe.
৩- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত