মান্না দে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ‘জীবনের জলসাঘরে’তে বলেছিলেন – ‘‘আমি ছোট থেকেই খুব নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। নিয়মের বাইরে আমি কোন কিছুই করি না।’’ কি রকম ছিল তাঁর নিয়ম? ছোটবেলা থেকেই খুব সকালে ঘুম ভেঙে উঠে পড়া ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যেস। মুম্বাইতে থাকার সময়ে তিনি প্রথম প্রথম মর্নিং ওয়াকে বেরোতেন – কখনও জুহু বিচের ধারে, কখনও বা তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়ির সামনে সবুজ পার্কে। এক একদিন তাঁর বেশ ভালোই হাঁটা হত, কিন্তু এক একদিন আবার বেশ মুশকিলে পড়তেন। কারণ চেনা কারও না কারও সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যেত রাস্তায়। মাঝে মাঝে তাঁর দেখা হত ‘অমিতাভ বচ্চনের পিতা হরিবন্স রাই বচ্চনের’ সাথে, আবার কখনও তাঁর দেখা হত ‘মেহমুদের’ সাথে। তারপর – কেমন আছেন থেকে শুরু হয়ে কথা গড়াতে গড়াতে চলে যেত নানা দিকে। সময় এগিয়ে যেত – তাঁর আর হাঁটা হত না। তাই পরের দিকে মান্না দে আর বাড়ির বাইরে না গিয়ে, তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়ি ‘আনন্দন’-এর ছাদেই হাঁটতেন। এটা ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। তারপরে বাথরুম সেরে, চা খেয়ে তিনি রেওয়াজ করতে বসতেন – দুই-তিন ঘণ্টার জন্য। রেওয়াজের অভ্যাসটা এমনভাবে তাঁর রক্তের মধ্যে, মাথার মধ্যে এবং জীবনযাত্রার মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে – তিনি যে অবস্থাতে যে দেশেই থাকুন না কেন – রেওয়াজ তিনি করতেনই। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন – ‘‘রেওয়াজ না করে আমি থাকতে পারি না। গানই আমার অক্সিজেন। গান ছাড়া আমি থাকব কি ভাবে?’’ অবশ্য এই রেওয়াজ করার সময় তিনি কোন আধুনিক গান গাইতেন না। তিনি নানা রকমের রাগ-রাগিণীর চর্চা করতেন। মন দিয়ে সরগরম করতেন, পাল্টা করতেন। স্কেলের ‘উদারা’ থেকে শুরু করে তিনি আস্তে আস্তে উঠতেন – ‘মুদারা’ এবং ‘তারায়’। সকাল বেলা ছিল তাঁর সাধনার সময়। এই সময় তাঁর সঙ্গীত সাধনা দিয়ে তিনি করতেন ঈশ্বরের বন্দনা – তাঁর স্তুতি, তাঁর ভজনা, তাঁর পূজা। সাত সুরের বাইরে তখন অন্য কোনও অসীম সুরে তাঁর মন-প্রাণ ভরে যেত। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে নিজেই প্রশ্ন রেখেছিলেন – ‘‘এই কি ঈশ্বর? এই কি সেই পরম প্রাপ্তি যা পাওয়ার জন্য মানুষ যুগে যুগে সাধনা করে হিমালয়ে? কঠোর তপস্যায় ক্ষত বিক্ষত করে নিজের শরীর মন। এই কি সেই?’’ এই সময়টা তিনি একেবারে একান্তে থাকতেন। নিজের কাছে কাউকে থাকতে দিতেন না। যখন তিনি সঙ্গীত দেবতার চরণ ছোঁবেন সুরের মাধ্যমে – তখন সেই আবেগঘন মুহূর্তে অন্য কাউকে কি সেখানে থাকতে দেওয়া যায়? মান্না দে বলতেন – ‘‘আমার সারা জীবনের সাধনার গোপন কথা কি আমি অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষের কাছে বিলিয়ে দিতে পারি অযথা? আর তা ছাড়া সেই সময়ে অন্য কেউ থাকলে সঙ্গীতের দেবতা আমার কাছে আসবেনই বা কেন?’’ গানের পর্ব শেষ হলে একটু জলখাবার খেয়ে তিনি বসতেন নানা রকমের পড়াশোনা নিয়ে। তবে তাঁর সঙ্গীত জীবনের উত্তুঙ্গ সময়ে তিনি পড়াশোনা করার খুব একটা সময় পেতেন না – কারণ দিনের মধ্যে আঠারো ঘন্টাই লেগে থাকত গানের রেকর্ডিং, রিহার্সাল বা কোনও গানের অনুষ্ঠান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রেকর্ডিং আর অনুষ্ঠানের কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন – কিছুটা সময় পেতেন নিজের জন্য। এবং অবশ্যই তাঁর স্ত্রী জীবিত থাকার সময় তিনি কিছুটা সময় পেতেন তাঁর স্ত্রীর জন্য, তাঁর প্রিয় ‘সুলু’র জন্য। জীবনের একটা সময়ে তিনি তাঁর স্ত্রী ‘সুলোচনা’র সাথে ঠিকমতো গল্প করার সময়-সুযোগ পর্যন্ত পেতেন না। নিজের সঙ্গীত জীবনের ব্যস্ততম সময়ে মান্না দে কোনদিন বুঝতেই পারেননি যে তাঁর সংসার কিভাবে চলছে, কিভাবে তাঁর দুই কন্যা বড় হচ্ছে। কীই বা তাঁর দুই কন্যার প্রয়োজন আর কীই বা তাঁর স্ত্রীর প্রয়োজন। সংসারের সমস্ত ঝামেলা, এমনকি অনেক সময়ে মান্না দের ঝামেলাও একা নিজের হাতে সামাল দিতেন তাঁর স্ত্রী ‘সুলোচনা’। যতদিন তাঁর স্ত্রী জীবিত ছিলেন ততদিন মান্না দে পড়াশোনা শেষ করে দুপুরে স্নান করে তাঁর সাথে একসঙ্গে খেতে বসতেন। বেলা একটা-দেড়টা নাগাদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই মান্না দের আহারও হয়ে গিয়েছিল পরিমিত। জীবনের এই সময়টায় তিনি খেতে ভালোবাসতেন – একটু ডাল-ভাত, একটা ভাজা আর দু-একপিস মাছ। এর সাথে শুক্তো আর চাটনি হলে তো কথাই ছিল না। অবশ্য মান্না দে কোন কালেই খুব বেশি খেতে পারতেন না। যা খেতেন অল্পই খেতেন। এই কারণে তাঁকে অনেকেই নেমতন্ন করে খাইয়ে ঠিক সুখ পেতেন না। অবশ্য যদি কোন গানের অনুষ্ঠান থাকত, তাহলে তিনি সারাদিন স্যুপ খেয়েই কাটিয়ে দিতেন। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে তিনি বিকেলে শুনতেন নানা ধরনের গান। বিকেলেই চিঠি পত্রের উত্তর দিতে বসতেন। তারপরে স্ত্রীর সাথে বাড়ির ছাদে বৈকালিক ভ্রমণ করতেন। তারপরে আবার একটু রেওয়াজ – আবার সুরের সাধনা। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক রাত্রি আটটার সময়ে রাতের খাবার খেয়ে একটু টিভি দেখতে বসতেন। তারপরে শুতে যেতেন। অবশ্য কোথাও গানের অনুষ্ঠান থাকলে বা নেমতন্ন থাকলে, তাঁর এই রুটিনটা হেরফের হত। তবে নিয়মনিষ্ঠ মান্না দে সাধারণতঃ এই রোজনামচার বাইরে কখনও যেতেন না। এত নিয়ম মানার কারণ হিসেবে তিনি বলতেন – ‘‘শরীর ভালো না থাকলে আমি গান করব কিভাবে?’’ তবে তাঁর শরীর তেমন খুব একটা খারাপ হত না। জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন – ‘‘মায়ের আশীর্বাদ, গুরুর আশীর্বাদ’’। তবুও ১৯৯২ সালে তাঁর হার্টের একটা ‘বাইপাস সার্জারি’ হয়েছিল। এছাড়া তিনি যে রোগে জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে খুব ভুগতেন সেটা হল – ‘সাইটিকা পেইন’। এই যন্ত্রনা তাঁকে মাঝেমধ্যেই অবশ করে দিত। কিন্তু সেভাবে মান্না দে এসবে গুরুত্ব দিতে চাইতেন না। তিনি বলতেন – ‘‘যতদিন বাঁচব সশব্দে বাঁচতে চাই আমি। গান নিয়ে বাঁচতে চাই। গান ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। অসুস্থ শরীরে যন্ত্রনা নিয়ে শুয়ে থাকব আর গান গাইতে পারব না – এ জীবন আমি কোন ভাবেই চাই না।’’
নিজের জীবনের বেশির ভাগ সময়টা মান্না দে কাটিয়েছিলেন মুম্বইতে। ১৯৪৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ৫৭ বছর। এক সময় তাঁর সাধের বাড়ি ‘আনন্দন’ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বড় মেয়ে ছিলেন আমেরিকায়, আর তাঁর ছোট মেয়ে তখন বেঙ্গালুরুতে সেটেল্ড। মান্না দে ও তাঁর স্ত্রী সুলোচনা দে’র তখন বয়স বাড়ছিল। সাথে অত বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করাও খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি ঠিক করেছিলেন সেই বাড়ি বিক্রি করে বেঙ্গালুরুতে থাকবেন। অত সুন্দর লোকেশানে বাগানঘেরা ছবির মতো বাড়ি ছিল তাঁর। তাঁর বাড়ির আশেপাশে ছিল সব সেলিব্রিটিদের বাস। প্রচুর মানুষ কিনতে এসেছিলেন তাঁর বাড়ি। শেষে এক ভদ্রলোক এসে বলেছিলেন – তিনি মান্না দে’র গানের দারুণ ভক্ত। সেই জন্য সেই বাড়ি তিনি কিনে একই রকম ভাবে রেখে দিতে চান। সেই ভদ্রলোক মান্না দে’কে জানিয়েছিলেন – বাড়ির একটা চাবি তিনি রেখে দেবেন মান্না দে’র কাছে। মান্না দে যখন খুশি সেই বাড়িতে আসবেন, থাকবেন। কেয়ারটেকার ছাড়া সেই বাড়িতে আর কেউ থাকবে না মান্না দে’র অবর্তমানে। মান্না দে সেই ভদ্রলোককেই বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন। এর কিছুকাল পরে মান্না দে এসেছিলেন মুম্বইতে অনুষ্ঠান করতে। তাঁর হাতে কিছুটা সময় হাতে ছিল। ভেবেছিলেন, এক বার বাড়িটা দেখে আসবেন। কত স্মৃতি জড়িয়ে। এক বার ভিতর থেকেও ঘুরে আসবেন। সেই গানের ঘর। একবার দেখবেন না? হাতের তালুর মতো চেনা জায়গা। কিন্তু সেদিন নিজের পুরানো পাড়ায় কয়েক বার চক্কর মেরেও মান্না দে তাঁর সাধের ‘আনন্দন’ খুঁজে পাননি! আসল ঘটনা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন খানিকক্ষণ পরে – ‘‘আজ যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়/যা দেখিতেছ না/তাহারই ভিড়’’ – তাঁর সেই সাধের ‘আনন্দন’ ভেঙে রাতারাতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক বহুতল হাউজিং! শেষ জীবনে ঘটনাটা বলতে বলতে মান্না দে’র দু’চোখ বুজে আসত, চোখের কোল ছাপিয়ে জল ঝরে পড়ত। বলতেন – ‘‘বাড়ি তো আমি বিক্রিই করতাম। কেন এ সব বলল আমায়?’’ তাঁর জীবনের আরেকটা বড় দুঃখ ছিল – তাঁর দুই মেয়ের কেউ সে-ভাবে গান গাননি। ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি একটা চেষ্টা করেছিলেন। দু’জনে মিলে গেয়েছিলেন – ‘বাবা-মেয়ের গান’ – ব্যস ওই পর্যন্ত। মান্না দে বাচ্চাদের ভীষণ ভালবাসতেন – খুব আদর করতেন। কিন্তু তাঁর এমনই দুর্ভাগ্য যে তিনি আর দাদু হতে পারেননি।
একজন মানুষের জীবনের সব ইচ্ছা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। তাঁরও হয় নি। বেঙ্গালুরু ছিল তাঁর কাছে অচেনা-অজানা। নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি আরও একা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যে মান্না দের কাছে গান ছিল তাঁর জীবনের অক্সিজেন – সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর জীবনের শেষের দিনগুলোর কথা পড়লে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। মুম্বাই ছেড়ে যাবার সময় মান্না দে বলেছিলেন, ‘‘ছোট মেয়ে সুমিতা বেঙ্গালুরুতে কিছু কাজ-টাজ করতে চায়। তাই আমরাও চলে যাচ্ছি। ওকে তো আমরা একা ছেড়ে দিতে পারিনা।’’ তারপর? সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘আরতি মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যে’ জানা যায় – ‘‘দিনের পর দিন ফোন করেছি। বেজে গেছে শুধু। কেউ ফোন ধরতো না। একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়িকা শুনলাম মান্নাদার জন্মদিনে ওর বাড়িতে দেখা করতে গিয়ে শেষমেশ বাড়িতে ঢুকতে না পেরে জানালা থেকে শুভেচ্ছা আর প্রণাম জানিয়ে চলে আসেন।’’ কেন? যে মান্না দে প্রতিদিন ভোরবেলা রেওয়াজ ছাড়া ভাবতেই পারতেন না শেষ জীবনে তাঁর কাছে একটা হারমোনিয়াম পর্যন্ত ছিলনা! মান্না দে’র বহু গানের ‘মিউজিক এরেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করেছিলেন ‘শান্তনু বসু’। স্ত্রী ‘সুলোচনা’র মৃত্যুর পর মান্না দে একদিন ফোন করেছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন, ‘‘সুলুকে উৎসর্গ করে কয়েকটা গান করব ঠিক করেছি। তোমার হেল্প চাই।’’ তারপরেই বলেছিলেন, ‘‘দেখো,এই সময় আমার গান তো খরচা করে কেউ করবেনা। তুমি আমাকে বলো,আমি যদি আটটা গান করি,কত খরচ হতে পারে?’’ ভাবা যায়? মান্না দে কিনা শেষ বয়সে খরচের চিন্তা করেছিলেন? সেই মান্না দে, যাঁর গানের সুরে একদা সারা ভারতবর্ষ মাতোয়ারা ছিল! শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘মহুয়া লাহিড়ী’ এগিয়ে এসেছিলেন সেই রেকর্ড করার জন্য। এই রেকর্ডের কাজেই বেঙ্গালুরু পৌঁছে ‘শান্তনু বসু’ ফোন করেছিলেন মান্না দে’কে। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কাল তুমি কখন আসবে?’’ একটু অবাক হয়ে ‘শান্তনু বসু’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘দাদা আমি তো আজই আপনার সঙ্গে গান নিয়ে বসবো বলেই দুপুরে চলে এলাম। আমি যদি পাঁচটা-ছটা নাগাদ যাই।’’ একটু ইতস্তত করে মান্না দে তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘আজ তো চুমু (ছোট মেয়ে সুমিতা) কাজে চলে যাবে। তুমি কাল এসো।’’ ‘শান্তনু বসু’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘কাউকে লাগবেনা দাদা। আমি আর আপনি হলেই তো হবে।’’ তিনি তাও বলেছিলেন ‘‘অসুবিধে আছে।’’ এরপরে ‘শান্তনু বসু’র নিশ্চুপ থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে মান্না দে নিজেই অস্বস্তির সঙ্গে বলেছিলেন ‘‘আমাকে তো তালাবন্ধ করে চাবি নিয়ে ও কাজে চলে যায়। আবার রাত বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ আসে।’’ শুনে স্তম্ভিত হয়ে ‘শান্তনু বসু’ বলেছিলেন, ‘‘দাদা, এভাবে …!’’ এরপরেই ফোনের অপর প্রান্তে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে মান্না দে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আর বোলো না, আর বোলো না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল, আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা।’’ নাঃ, এরপরে আর বেশিদিন কাউকে বিরক্ত করেননি ‘ভারতের সঙ্গীতের সূর্য’। তবে তাঁর শেষ জীবনের দুঃখ আজ প্রকাশ্যে থাকলেও – আদতে কি কারণে কি ঘটেছিল, তা কারও জানা নেই।
শতায়ু হতে চেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “একশো বছর বেঁচে থেকে গান গাইতে চাই।” হয় নি। ৯৪’তে চলে গিয়েছিলেন ‘বাংলা গানের লাস্ট লিয়র’। বয়সের নিরিখে সেটা হয়তো অকালবিদায় ছিল না, কিন্তু তাঁর চলে যাওয়া, আক্ষরিক অর্থে, এক শূন্যতা তৈরি করেছিল ভারতীয় সঙ্গীতে। কারণ ধ্রুপদী গানের শিল্পী না হয়েও আসমুদ্রহিমাচল ছাড়িয়ে বিদেশেও ছিল তাঁর নামের বিস্তার। আর কোনও বাঙালি শিল্পীর ক্ষেত্রে এমনটি সুলভ ছিলেন না। সে দিক থেকে মান্না দে-র মৃত্যু ছিল এক অনন্য প্রতিভার অবসান। বাংলা, হিন্দি তো আছেই। তা ছাড়াও প্রায় সব প্রধান ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন তিনি। তামিল-মালয়ালি-ভোজপুরি-কোঙ্কনি, কী নেই তাঁর গাওয়া তিন হাজার গানের তালিকায়! আর সেই বিস্তারের জোরেই বোধ হয় ঘনিষ্ঠ মহলে রসিকতা করে বলতে পারতেন, ‘‘আমার সৌভাগ্য, ধানবাদের ও পারেও লোকে আমাকে চেনে। আমার গান জানে।’’ এই উক্তি নিছক অহমিকা ভাবলে হয়তো অবিচার হবে।
কিন্তু মান্না দে যতটা বাঙালি শিল্পী, ততটাই কি বাংলার? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই সম্ভবত রয়ে গিয়েছে ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে মান্না দে-র যাত্রাপথটিতে, যে পথে তাঁর অনেক সাফল্য, আর কিছু ব্যর্থতাও ছিল।
১লা মে ১৯১৯ সালে, উত্তর কলকাতার ন’নম্বর মদন ঘোষ লেনে পূর্ণচন্দ্র দে এবং মহামায়া দেবীর সংসারে শুরু হয়েছিল সেই জীবনযাত্রার। উত্তর কলকাতার সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হয়েছিলেন ‘প্রবোধচন্দ্র’। গোবর গোহের আখড়ায় কুস্তিচর্চা, স্কটিশ চার্চ কলেজের ক্যান্টিনে টেবিল বাজিয়ে গান, জীবন কেটেছিল সেই ভাবেই। তার পরে এক দিন প্রবোধচন্দ্র হারিয়ে গিয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ স্কুল ও কলেজের কাগুজে খাতায়। রয়ে গিয়েছিল ডাকনাম মানা থেকে হয়ে ওঠা ‘মান্না’। সে নামই শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ছায়ায় বেড়ে উঠলেও মান্নার গাইয়ে হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। তাঁর কাছে তখন গান বলতে ছিল অফ পিরিয়ডে টেবিল বাজিয়ে শচীনকর্তা, কানাকেষ্টর গান গাওয়া। সেই আসরের সঙ্গীরাই এক দিন এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তাঁর নাম লিখিয়েছিলেন তাঁর, সেই সূত্রেই কাকার কাছে তাঁর গান শেখা এবং নানা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন। সেই প্রথম স্থানটা বলিউডের বড় যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় বজায় থাকেনি। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সহকারী হিসেবে শুরু হয়েছিল সদ্য কুড়ি পেরোনো মান্না দে-র যাত্রা। ‘তমান্না’ ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে ডুয়েট এবং শঙ্কর রাও ব্যাসের সুরে ‘রামরাজ্য’ ছবিতে একক কণ্ঠে প্রথম প্লেব্যাক তেমন ভরসা যোগায় নি। কিন্তু কাকার সঙ্গে বাংলায় ফেরেন নি মান্না, জড়িয়ে গিয়েছিলেন বলিউড-বৃত্তে। সে থাকা সার্থক হয়েছিল। ১৯৫০ সালে, শচীন দেববর্মনের সুরে ‘মশাল’ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘উপর গগন বিশাল’। এই গানটিই যেন তাঁর গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
পুরুষালি নায়কোচিত কণ্ঠ বলতে তখন যা বোঝাত, সেটা তাঁর ছিল না। সেই বৈশিষ্ট্যের জন্যই হয়তো নায়কের গানের জন্য বিশেষ ডাক পাননি তিনি। সে দিনের রফি, মুকেশ, হেমন্তকুমার, তালাত মাহমুদ, কিশোরের দাপুটে প্লে-ব্যাক বৃত্তে নায়ক বা প্রধান চরিত্রের লিপে বড় একটা জায়গা হয়নি তাঁর। প্রধানতঃ পৌরাণিক-ধর্মমূলক ছবিতেই ডাক পেতেন। তবে শঙ্কর জয়কিষণ, শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী এবং উত্তরকালে রাহুল দেববর্মনের মতো সঙ্গীত পরিচালক মান্নার গায়কী বুঝে তাঁর কণ্ঠে তুলে দিয়েছিলেন কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্রগীতি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই বলিউডে নিজের নাম লিখেছিলেন মান্না। আওয়ারা, পরিণীতা, দো বিঘা জমিন পেরিয়ে শ্রী ৪২০ ছবিতে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। ‘আনন্দ’ ছবির ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ রেকর্ড গড়েছিল। শোলে, পড়োশন, জঞ্জীর-এর মতো ছবিতে এমনকী কিশোরকুমারের সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন মান্না। তবু প্লে-ব্যাক গাইয়েদের প্রথম সারিতে কোনও দিনই আসতে পারেননি। ধ্রুপদ-ধামার থেকে ভজন কীর্তন পর্যন্ত নানা ধারার তালিমে সমৃদ্ধ মান্না রাগাশ্রয়ী গানের ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে নির্ভরযোগ্য ছিলেন। আর সেই নির্ভরতার জায়গাতেই নায়কের লিপে বেশি গান না পেলেও তাঁকে মুম্বইয়ে থেকে যেতে হয়েছিল তাঁর সংগীতজীবনের সেরা সময়টা। প্রধানতঃ বলরাজ সাহনি-মেহমুদ-প্রাণ এর মতো অভিনেতার জন্যই তাঁকে প্লে-ব্যাক করতে হয়েছিল। হীরকখণ্ডের মতো এক একটি কম্পোজিশনে প্রাণ দিয়েছিল মান্নার কণ্ঠ, শিল্পী হিসেবে তাঁর জাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বার বার। মুম্বইয়ে চল্লিশ বছরের প্লে-ব্যাক কেরিয়ারে মান্না দের গানের সংখ্যা তাই তিনশোর কম, অর্থাৎ গড়ে বছরে সাত-আটটি। মুম্বই তাঁকে যতটা ‘সমীহ’ বা ‘গুরুত্ব’ দিয়েছিল ততটা সুযোগ দেয়নি। অথচ এই অবকাশেই তিনি ধ্রুপদী শিক্ষায় পারদর্শী বহুমুখী শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। কিছুটা মুম্বইয়ে প্রত্যাশা মতো গুরুত্ব না পাওয়ার কারণেই সম্ভবত পুরোপুরি বাংলা গানে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। মুম্বইয়ে থাকার সময়েও বাংলা গান গেয়েছিলেন। অবশ্য তা অনেকটা অতিথি শিল্পীর মতো। ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রথম বাংলা বেসিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলা বেসিক গানে ধারাবাহিক ভাবে সামর্থ্য বিনিয়োগ করে গেলেও অতিথি হয়েই রয়ে গিয়েছিলেন তিনি, বাংলার শিল্পীর দৈনন্দিন সংগীতযাত্রার অংশীদার হয়ে উঠতে পারেননি। হয়তো চেয়েছিলেন সেটা, তাই তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের কাছে পাকাপাকি ভাবে বাংলায় থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র নামে সঙ্গীত অ্যাকাডেমি গড়বেন বলে জমি চেয়েছিলেন। যে ভাবে সেই পরিকল্পনা করেছিলেন সে ভাবে জমি পাননি, ফলে অভিমান নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। মুম্বই থেকে সরে থাকা এবং কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে ফিরতে না পারার অভিমানই হয়তো তাঁকে বেঙ্গালুরুতে ঠেলে দিয়েছিল। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে এটা তাঁর এক রকম স্বেচ্ছানির্বাসনই ছিল। তবে সংগীতজীবনের শেষ কিছু কাল ধরে বেঙ্গালুরু-প্রবাসী মান্না দে আক্ষরিক অর্থে শুধু কলকাতার বা বাংলার শিল্পী হয়েই ছিলেন। গানের সূত্রেই যোগাযোগ ছিল কলকাতার সঙ্গে, মুম্বইয়ের সঙ্গে যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
শুধু বাংলায় পাকাপাকি থাকার ক্ষেত্রে নয়, বাংলা গানেও তাঁর প্রবেশটা খুব মসৃণ হয়নি। প্রেমে-ফুটবলে-বিরহে-কফিহাউসে যে মান্না দে বাঙালির প্রাণের শিল্পী তাঁকেও বাংলা গানে প্রথম কণ্ঠ দিতে হয়েছিল অন্য এক শিল্পীর প্রত্যাখানের সূত্র ধরে। ডাবল ভার্শন ‘অমর ভূপালী’ ছবিতে বসন্ত দেশাইয়ের সুরে মান্না দে’র প্রথম বাংলা ছবির গান ছিল ‘ঘনশ্যাম সুন্দর’। ‘একদিন রাত্রে’ ছবির ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ ছিল তাঁর প্রথম ব্রেক। এর পরেই ডাকহরকরা ছবির ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’ বাংলা সিনেমায় মান্না দে’র আগমনী ঘোষণা করেছিল। তারও আট বছর পরে উত্তমকুমারের লিপে ‘শঙ্খবেলা’ ছবির ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এবং ‘আমি আগন্তুক’ তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ পাকা জমিতে বসিয়ে দিয়েছিল উত্তম-মান্না জুটিকে। চৌরঙ্গী, বিলম্বিত লয়, নিশিপদ্ম, ছদ্মবেশী থেকে স্ত্রী-মৌচাক-সন্ন্যাসী রাজা বাংলা সিনেমার গানে তৈরি করে দিয়েছিল মান্না-যুগ।
আর বেসিক গান? ‘ও আমার মনযমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ কিংবা ‘এই কূলে আমি’র যুগ পেরিয়ে ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘কফি হাউস’ বা ‘ফুটবল খেলা’ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর কণ্ঠ আবেগময় বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। আজও মান্না দে-র কণ্ঠে এ সব গান বেজে ওঠে কোন মোবাইলের কলার টিউনে, পূজার মণ্ডপে, এফ এম রেডিওতে, বাড়ির মিউজিক সিস্টেমে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা শ্যামল গুপ্তের মতো গীতিকারের গান মান্না দে গেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের সেরা সময়ের সঙ্গে তাঁর সংযোগ হয়নি। পরে সুধীন দাশগুপ্ত তাঁর জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য গান লিখেছিলেন। তারও পরে প্রধানতঃ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গানই ছিল তাঁর সামনে।
অনেকের মতে, শেষ বয়সে মান্না দে অতি অকিঞ্চিৎকর গানও রেকর্ড করতে দ্বিধা করতেন না। এতে তিনি তাঁর কণ্ঠসামর্থ্যের অপচয় করেছিলেন বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করলে এ অভিযোগ তাঁর প্রতি অবিচার বলেই মনে হবে। গানেই তিনি জীবনযাপন করতেন। রোজ গান নিয়ে বসেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে এক বার এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, “গান নিয়ে কেন, গানেই তো বসে আছি।” স্ত্রী সুলোচনার মৃত্যুতে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন গানকেই। এ হেন মানুষ ‘ভাল’ গান নেই বলে থেমে যেতে পারেন কি? সময় তাঁকে যা দিয়েছিল তাই গেয়েছিলেন। কিন্তু যা পেয়েছিলেন, তবু গাননি? অনেকের আক্ষেপ, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে ওমন স্মরণীয় গায়কীতে ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গেয়েছিলেন যিনি, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত সে ভাবে রেকর্ড করলেন না কেন? তার কারণ হিসেবে ঘনিষ্ঠমহলে শিল্পী বলতেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে তাঁর ভয় করে! বিদ্রোহের গান, গণনাট্যের গানও সে ভাবে গাননি। তবু স্ত্রীর স্মৃতিতে শেষ যে অ্যালবামের পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানেও দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল। ‘আনন্দ তুমি স্বামী’ আর ‘তোমরা যা বল তাই বল’।
জীবনের একেবারে শেষে এসেও নতুন গান রেকর্ড করে অ্যালবামের কথা ভাবতে পারতেন ফালকে সম্মানজয়ী মান্না দে। এই সাঙ্গীতিক জীবনীশক্তিই আজও তাঁকে নতুন প্রজন্মের বহু শিল্পীর কাছে আইকন করে রেখেছে। সে ‘আইকন’ পুরোপুরি বাংলার না হোক, আপ্রাণ বাঙালির। বৃহৎ বাঙালির, সেটাই বাঙালির গর্ব।
(তথ্যসূত্র:
১- জীবনের জলসাঘরে: পূর্ণাঙ্গ আত্মকথা, মান্না দে, আনন্দ পাবলিশার্স (২০০৫)।
২- সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র মান্না দে, অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন (২০১৪)।
৩- মান্না দে: শিল্পীর চেয়েও যিনি বড় মানুষ, শরাফত আলী, বর্ষাদুপুর।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত