১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই। মৃত্যু হচ্ছিল এক পন্ডিতের, এক সমাজ সংস্কারকের, নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার এক অগ্রদূতের। সমাজের অচলায়তন ভেঙে ফেলার দুঃসাহস দেখানো এক যোদ্ধার।
‘বিধবা বিবাহ’ – স্রেফ দুটি শব্দ। এই দুটি শব্দই কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজ কে। কেউ কেউ তো বলেই বসেছিলেন যে সমাজ নাকি রসাতলে গেলো! হিন্দু ধর্ম উচ্ছন্নে গেলো! কত বিতর্ক, কত বিদ্রুপ। কেউ পক্ষে তো কেউ বিপক্ষে। কেউ আবার নির্লিপ্ত। কিন্তু তখনকার সমাজে বিধবা হওয়া মাত্র যাদের জীবনে নেমে আসতো বন্দিদশার অভিশাপ, ধর্মের করাল কুঠার; তাঁরা পেয়েছিলেন এক ঝলক টাটকা বাতাস, মুক্তির স্বাদ, নতুন করে বাঁচার আশ্বাস, ‘পাপ’ নামক বস্তুটি থেকে মুক্তি।
বাংলা সাহিত্যের প্রসার, সংস্কৃত সাহিত্যের সহজসরল অনুবাদ নারী শিক্ষা বিস্তারে বহু প্রবন্ধ লিখে সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীর সম্মান ও আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি। সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিদ্যাসাগর কি ‘নাস্তিক’ ছিলেন? তাঁর মহাপ্রয়াণের পরে এত যুগ কেটে গেলেও এই প্রশ্নটি বার বার তাঁকে নিয়ে অনুসন্ধিৎসু মানুষের মনে ফিরে আসে। এই কারণে ফিরে আসে যে, আশৈশব আমরা শিখেছি ঈশ্বরচন্দ্র নামক বাহ্যত ইস্পাত কঠিন পুরুষটি আসলে ‘দয়া’ ও ‘বিদ্যার সাগর’। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজির পরে, তাঁকে নিয়ে একটি প্রায় না জানা বিষয় পাওয়া গেছে তা হল, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ‘ঘোর যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক’। ‘ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষ’, ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’, বর্তমান সময়ে যেভাবে আমাদের চৌকাঠ থেকে খিড়কিতে উঁকি মারছে তখন মনে হয় একবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘নাস্তিক’ ও ‘যৌক্তিক’ দিকটা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
বাঙালীর হৃদয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ নামটি আজও অনন্য ও বিস্ময়কর! চাল নেই, চুলো নেই, ধন কৌলিন্য নেই, মাসিক ছ’টাকা বেতনের সওদাগরী অফিসের এক কেরাণীর ছেলে প্রধানতঃ সংস্কৃত শিক্ষার ‘পুঁজি’ ও ‘ইংরেজীর ব্যবহারিক জ্ঞান’ নিয়ে ‘সমাজ’, ‘শিক্ষা’, ‘সংস্কৃতি’ আন্দোলনের শীর্ষে আরোহন করলেন, হিমালয় সদৃশ উন্নত মস্তক পুরুষ হিসেবে বাঙালী জাতির প্রকৃত জনকের মর্যাদা পেলেন, এ এক বিরলতম ঘটনা। টুলো পণ্ডিতের ঘরের ছেলে ‘শাস্ত্রীয় শিক্ষা’কে সম্বল করে কি ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ মানবতাপ্রেমী’, ‘নিরীশ্বরবাদী’ ও ‘যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক’ হয়ে উঠলেন তা এখনও গবেষণার অপেক্ষায়। স্থিতাবস্থা ও অন্ধকারপন্থীদের নির্মম নিন্দা-মন্দ সত্বেও জীবিতকালেই বিদ্যাসাগরের ছবি বিক্রী হত (অনন্য বিদ্যাসাগর, শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়)।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান মনস্কতার অকাট্য প্রমাণ, ‘ধর্ম’ সম্পর্কে তাঁর নিস্পৃহ মনোভাব। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ কোনও ভাবেই বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনও স্থির বিশ্বাস বা ভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেন নি। যতদূর জানা যায় তিনি কোনও ধর্মযাজকের কাছে ঘেঁষতেন না, মন্দিরে যেতেন না, এমনকি পূজার্চনা বা জপতপও করতেন না। কিন্তু তিনি মানবতায় উদ্বুদ্ধ ‘দয়ার সাগর’।
স্বামী বিবেকানন্দ অবশ্য বিদ্যাসাগরের বিরাট সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। আলমোড়ায় সিস্টার নিবেদিতাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
‘‘উত্তর ভারতে আমার বয়সি এমন কোনো লোক ছিল না, যার উপর তাঁর ছায়া পড়েনি।”
বিদ্যাসাগরের লেখা ‘বোধোদয়’ ঈশ্বরকে ‘নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’ বর্ণনা করায় বিবেকানন্দ ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ-র লেখা ‘স্বামীজির স্মৃতি’ থেকে জানা যায় একদিন বিবেকানন্দ শিশুদের উপযোগী কোনো পাঠ্যপুস্তক না থাকার জন্য আক্ষেপ করলে উপস্থিত একজন তাঁকে বিদ্যাসাগরের লেখা পুস্তকগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেন৷ তিনি তখন উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন এবং বলেন,
“… ‘ঈশ্বর নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’, ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’- ওতে কোনো কাজ হবে না, ওতে মন্দ বই ভাল হবে না।…” (স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃ. ৪০৫; উদ্বোধন, ১৯৭৩)।
একবার শ্রী’ম’ (মাস্টার ম’শায়) একবার বিবেকানন্দকে ঈশ্বর সম্পর্কে মতামত জানান। ‘কথামৃত’র দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে বিষয়টির নিম্নরূপ বর্ণনা আছে:
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি) – ‘বিদ্যাসাগর বলেন- আমি নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার দেব?’
নরেন্দ্র- ‘যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া পরোপকার বুঝলে কেমন করে?
মাস্টার- ‘আর পাঁচটা কি?’
নরেন্দ্র- ‘যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া পরোপকার বুঝলে কেমন করে? স্কুল বুঝলে কেমন করে? স্কুল করে ছেলেদের বিদ্যা শেখাতে হবে, আর সংসারে প্রবেশ করে, বিয়ে করে, ছেলেমেয়েদের বাপ হওয়াই ঠিক, এটাই বা বুঝলে কেমন করে? যে একটা ঠিক বোঝে, সে সব বোঝে।’
আসলে ঈশ্বর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের এক ধরনের অনীহা বিবেকানন্দকে আদৌ খুশি করতে পারেনি। বস্তুত, বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের মনোভাব কিছুটা মোনালিসার হাসির মতো। কারণ আলমোড়ায় নিবেদিতার কাছে বিদ্যাসাগরের যে মূল্যায়ন তিনি করেছিলেন, তা ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব, ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রসূত সঠিক – অর্থাৎ সত্যই উত্তর ভারতে তাঁর বয়েসি যুবকদের উপর বিদ্যাসাগরের অসাধারণ প্রভাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি ছিল তাঁর সাধারণভাবে বস্তুগত বিচার। তবে তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেন নি – এমনকি কোনো ঘটনারও।
পিতার মৃত্যুর স্বামীজী পর যখন দারুণ আর্থিক কষ্টে ভুগছিলেন, চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে অনেক সময়ে অনাহারে থাকছিলেন, সেই দারুণ বিপদের সময়ে পরিচিতদের অনুরোধে বিদ্যাসাগর এগিয়ে এসে বিবেকানন্দকে মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশনের বৌবাজার শাখার প্রধান শিক্ষকের চাকরি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীজী সে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেননি এক মাসের বেশি৷ পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমার ঝঞ্ঝাটে প্রায়শঃই স্কুলে অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন। বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী ছিলেন ‘বিদ্যাসাগরের জামাতা সূর্যকুমার অধিকারী’। ঘটনা সুস্পষ্টভাবে কতটা কি ঘটেছিল তা আজ পর্যন্ত সঠিক জানা যায়নি৷ তবে বিবেকানন্দ তাঁর পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন৷ অনেকের ধারণা, ‘সূর্যকুমার অধিকারী’র চাপে তিনি চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন এবং বিদ্যাসাগর তা জানতেন অথবা তাতে তাঁর সম্মতি ছিল। তবে একথা সুনিশ্চিত তাঁকে কোনো বরখাস্তের নোটিশ ধরানো হয়নি৷ হতে পারে যুবক বয়সের এই দুর্ভাগ্যজনক স্মৃতি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁকে সারাজীবন তাঁড়িয়ে বেরিয়েছিল এবং যার ফলে মাঝে-মধ্যে উপরোক্ত অসতর্ক উক্তি বের হয়েছিল। তবে একই সঙ্গে মৃত্যুর আগে তিনি যখন ‘সিস্টার নিবেদিতা’কে ‘আলমোড়া’য় বলেছিলেন, “রামকৃষ্ণের পর আমি বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করেছি” (“After Ramakrishna, I follow Vidyasagar”), তখন সেটিকে ধরে নিতে হবে বিবেকানন্দের সতর্ক ও সচেতন উক্তি৷ খুব সম্ভবত এক্ষেত্রে তিনি বিদ্যাসাগরের স্বাজাত্যাভিমানের কথাকেই স্মরণ করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর স্পষ্টোক্তি এবং অতি সাধারণ বেশভূষা। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও মনে রাখতে হবে ১৮৯১ সালে (২৯শে জুলাই) বিদ্যাসাগর যখন মারা যান, তখন ‘নরেন্দ্রনাথ’ সন্ন্যাস নিয়ে ‘স্বামী বিবিদিশানন্দ’ হয়েছেন এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ (‘ত্রৈলঙ্গ স্বামী’, ‘স্বামী ভাস্করানন্দ’) করেছেন, অথচ ঘরের পাশে সুকিয়া স্ট্রিটে তিনি কদাপি যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। যদিও একদা তাঁর গুরু ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ যে যেচে ‘বিদ্যাসাগরের গৃহে’ সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলেন এবং আশা করা যায় সে কাহিনী তাঁর অবিদিত ছিল না।
সার কথা, ঈশ্বরে বিশ্বাসী বিবেকানন্দের ‘অজ্ঞেয়বাদী’ বা তথাকথিত ‘নাস্তিক’ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কৌতূহল খুব সামান্যই হবে যদি তিনি কোনো ভক্তের মুখে শোনেন,
“একজন বলিলেন যে বিদ্যাসাগর মহাশয় ঈশ্বর ব্রহ্ম কিছু মানেন না। তিনি বোঝেন জগতের কল্যাণ, বিদ্যাচর্চা – ইহাই প্রধান।” (উদ্ধৃতির জন্য, জীবন সন্ধানী বিদ্যাসাগর; রামরঞ্জন রায়, পৃ. ১৬৪)।
পাঠ্য বিষয় দর্শন সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের উক্তি ছিল – ‘‘কতগুলো কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয় … কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত সে সম্পর্কে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই।” (পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১ বঙ্গাব্দ)
শুধু তাই নয় ‘আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের লেখা’ থেকে জানা যায় – ‘‘ঐ বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, একথা বোধ হয় তোমরা জানো না, যাঁহারা জানিতেন তাঁহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সঙ্গে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না …’’ (পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা – ৩৭২)। অত্যন্ত সখেদে বিদ্যাসাগর কালজয়ী কয়েকটি মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলো হল –
‘‘দেশের লোক কোনও শাস্ত্র মানিয়া চলে না, লোকাচার ইহাদের ধর্মও’’ – আজীবন এই ছিল বিদ্যাসাগরের ধারণা, তাই তিনি লোকাচার স্বরূপ কুসংস্কার থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে গিয়ে সংশয়বাদী হয়ে ওঠেন। (অনন্য বিদ্যাসাগর, শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়)
‘‘দুঃখের বিষয় আমি এ বিষয়ে ব্যালেনটাইনের সঙ্গে একমত নই। … শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। … শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তাঁরা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয় নি।’’ (অনন্য বিদ্যাসাগর, শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়)
উত্তরকালের ‘Raionalist’ বা ‘যুক্তিবাদী’দের জন্য তিনি এক ‘মহামন্ত্র’ দিয়ে গিয়েছিলেন যা যুগে যুগে যুক্তির আকাশে ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করবে। উক্তিটি ছিল,
‘‘ধর্ম যে কি তাহা মানুষের জ্ঞানের অতীত এবং বর্তমান অবস্থায় ইহা জানিবার কোনও প্রয়োজন নাই।’’ (ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও বিদ্যাসাগর – শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়)
এবার আসা যাক বিদ্যাসাগরের ধর্মাভাবনা সম্পর্কে তাঁর জীবনীকাররা কি বলেছেন সেই আলোচনায়। ‘চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ একস্থানে উল্লেখ করেছেন, ‘‘তাঁহার নিত্যজীবনের আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন অবস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পরিচয়ও কখনো পাওয়া যায় নাই।’’ পাশাপাশি আরও এক জীবনীকার ‘বিহারীলাল সরকার’ অভিমান ভরে লিখেছেন, ‘‘দুঃখের বিষয় অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখ কাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে। হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসগর উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন।’’
২২শে জানুয়ারি, ১৮৫১ সালে বিদ্যাসাগর ‘সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ’ হন। এর অল্প কয়েকমাস পরে তাঁরই উদ্যোগে ও নির্দেশে ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘বৈদ্য’ ছাড়াও ‘কায়স্থ’রা কলেজে প্রবেশাধিকার পান। তার আগে সংস্কৃত কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। এক বছরের মধ্যে যে কোনও হিন্দু সন্তান কলেজে ভর্তি হতে পারবে এই মর্মে নিয়ম জারি করা হয়। (পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা – ৩৭৫)
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। বিদ্যাসাগর সমস্ত ভারতীয় দর্শন মন্থন করে ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে একটি মোক্ষম শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন,
‘‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চা পতিতে পতৌ
পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে’’
অর্থাৎ, ‘‘স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন।’’
‘শিবনাথ শাস্ত্রী’র লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠাগারে সারা দিন ধরে নানা শাস্ত্র পড়তে শুরু করেছিলেন। মাঝে এক বার শুধু খেতে উঠতেন। সালটা ছিল ১৮৫৩, সময় ছিল শীতকাল। ‘রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা’ থেকে জানা যায়, এক দিন তাঁর সামনেই বিদ্যাসাগর ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন। তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন উপরে উল্লেখিত পরাশর সংহিতার দু’লাইনের শ্লোকটি।
এই যুক্তির নিরিখে বিধবাদের বিয়ের পক্ষে দুটি বই লিখেছিলেন তিনি। এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বিধবা বিবাহের সপক্ষে জনমত গঠন ও সেইসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই মত সমর্থন করেছিলেন ‘বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান লেখক’, ‘ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম আচার্য’ ‘রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ’। এক বছর পরেই ১৮৫৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’-র সভায় ‘হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ ও বাল্যবিবাহ বর্জন’ নিয়ে ‘কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব’ আর ‘অক্ষয়কুমার দত্তের সমর্থনের’ বিস্তারিত একটি প্রতিলিপি ব্রিটিশ লিগ্যাল কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছিল। আইনের মাধ্যমে বিধবা বিবাহকে বৈধ করার লক্ষ্য নিয়ে ৯৮৭ জনের সই সংগ্রহ করে বিদ্যাসাগর আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে। তাঁর আবেদনপত্রের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন সনাতন পন্থী হিন্দুরা। রক্ষণশীল সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের সই সংগ্রহ করে পাল্টা আবেদনপত্র ভারত সরকারকে জমা দিলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তির কাছে হার মেনেছিল বিরোধীদের আবেদন।
‘রাধাকান্ত দেব’ কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে পণ্ডিতসভা ডেকেছিলেন। সেখানে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছিল বিদ্যাসাগর ও ‘পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের’ মধ্যে। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পণ্ডিতরা তা প্রমাণ করার জন্য জোর সওয়াল করেছিলেন। তবুও ব্যর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। রাধাকান্ত দেব এই বিধবা বিবাহে সমর্থন না করলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এক জোড়া শাল তাঁকে দিয়েছিলেন।
১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে বিধবা-বিয়ে নিয়ে লেখা বিদ্যাসাগরের বইয়ের প্রথম সংস্করণের দু’হাজার কপি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। উৎসাহিত বিদ্যাসাগর আরও তিন হাজার বই ছাপিয়েছিলেন। সংস্কারাচ্ছন্ন পণ্ডিতেরা তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনা শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের মতের বিরুদ্ধে অসংখ্য চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। বইটি সারা ভারতবর্ষে জুড়ে ঝড় তুলেছিল। বিদ্যাসাগরকে আরও দশ হাজার কপি ছাপাতে হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে ৯৮৬ জনের সই নিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে বিধবা বিবাহের দাবি পেশ করলে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল।
সেই সময়ের খবরের কাগজগুলি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শোভাবাজারের রাজা ‘রাধাকান্ত দেব’, কবি ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’-সহ অনেক প্রভাবশালী মানুষ সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। ব্যঙ্গ পদ্য বেরিয়েছিল ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায়,
‘‘… সাজ গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল।
তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল।’’
নামে, বেনামে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে বহু চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, বিধবার গর্ভের সন্তান সম্পত্তির অধিকারী হবে কি না।
১৮৫৬ সালে বর্ধমান থেকেও বিধবা বিবাহের সমর্থকদের একটি আবেদন সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। ‘বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ’ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সই করেছিলেন। ‘প্যারীচরণ সরকার’, ‘রাজনারায়ণ বসু’, ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’, ‘ভূদেব মুখোপাধ্যায়’, ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার’, ‘কিশোরীচাঁদ মিত্র’, ‘রাধানাথ শিকদার’, ‘দীনবন্ধু মিত্র’ প্রমুখ বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের সমর্থনে সরকারের কাছে আবেদন পাঠিয়েছিলেন। বিরুদ্ধে দরখাস্তের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ‘ত্রিপুরা’, ‘পুণে’, ‘মুম্বাই’, ‘উত্তর ভারত’ আর ‘নবদ্বীপ’ থেকেই প্রায় তিরিশ হাজার প্রতিবাদ সরকারের দফতরে জমা পড়েছিল। সাবধান করে বলা হয়েছিল, এমন বিয়ে চালু হলে ভারতে নিশ্চিত ‘ধর্মদ্রোহ’ হবে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই বছরে ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছিল। এই আইন পাশের পিছনে ‘গ্রান্ড’ সাহেবের অবদান ছিল। ‘কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র বাহাদুর’, ‘পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ’, ‘পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি’র সঙ্গে গ্রান্ড সাহেবের বাংলোয় গিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছিলেন।
বিধবা বিবাহ প্রচলনের পাশাপাশি তাঁদের দুরাবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সারা জীবন কঠোর সংগ্রামী, স্বাজাত্যভিমানী, কোনও কারণেই আপোস না করা – এই চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন বিদ্যাসাগর।
তাঁর জীবনী নিরীক্ষণ করে এটাই বলা যায়, সারা জীবন ধর্মের ধার ধরেননি বলেই সেই পণ্ডিত, যাঁকে ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ একদা ‘টুলো পণ্ডিত’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন এবং শেষে তাঁরই আশ্রয় নিয়েছিলেন, তথাকথিত হিন্দু ধর্মের পাঁচিলটা ভাঙতে পেরেছিলেন। সমাজে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন টাটকা বাতাসের ঝলক। এগুলো সম্ভবতঃ সম্ভব হয়েছিল তিনি ‘নাস্তিক’ ছিলেন বলেই।
বিদ্যাসাগর বলেছিলেন –
‘‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হব না।’’
আর অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন –
‘‘তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন। বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার প্রমাণ বিদ্যাসাগরের জীবনে ছড়িয়ে আছে।’’
আজ ভাবতে অবাক লাগে, প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে আজকের তুলনায় আরও আঁধার যুগে ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষবৃক্ষের শিকড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেভাবে আঘাত করার সাহস দেখিয়েছিলেন, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে তাঁকে কিংবা তাঁর কৃতকর্মকে সামান্যতমও মনে রাখার চেষ্টা করেছি কি?
(তথ্যসূত্র:
১- অনন্য বিদ্যাসাগর, শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়।
২- স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা, নবম খণ্ড, উদ্বোধন, ১৯৭৩।
৩- জীবন সন্ধানী বিদ্যাসাগর, রামরঞ্জন রায়।
৪- পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা, ১৪০১ বঙ্গাব্দ।
৫- ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও বিদ্যাসাগর, শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
৬- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত), ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬।
৭- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪।
৮- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙ্গালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, সুবর্ণ, ২০১৬।
৯- বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত