আকাশের রং ক’দিন ধরেই কী নীল হয়ে উঠেছে, বাতাস আঘ্রান করলে এক সুগন্ধী প্রাণময়তা অনুভব করা যাচ্ছে, ধূসর বর্ণহীন পাতা ঝরে গিয়ে গাছের শাখাগুলো ঢেকে যাচ্ছে কচি কচি নতুন পাতায়। শীতের রুক্ষ দিনের অবসান ঘটিয়ে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’! আর বসন্ত কালকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলে যে উৎসব, তা হল দোলোৎসব বা হোলি খেলা। নতুন করে জেগে উঠে, নতুন আনন্দে নতুন আশায় রঙিন হয়ে ওঠার এই উৎসব শীতল রুক্ষতার আগল ভেঙে বলে ওঠে,
“ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।’’
সেই কোন সুদূর অতীত কাল থেকে এই দোলোৎসব গোটা ভারতের একটি প্রাচীন প্রাণোচ্ছল উৎসবে পরিণত হয়ে মানুষকে মাতিয়ে চলেছে। ফাগের রঙিন স্পর্শে হিন্দোলিত হয়ে অন্তর বলে ওঠে,
‘দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা হৃদয় আকাশে
দোল ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে।’
মনে পড়ে যায়, সেই কবে বৃন্দাবনে প্রেমিক যুগল রাধাকৃষ্ণের রঙের উত্সবে মেতে ওঠার কথা — ‘বসন্ত আওল রে! মধুকর গুনগুন অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে।’
প্রাচীন ইতিহাস ও প্রাচীন চিত্রে দোল বা হোলির অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। রাজস্থানে রাজপুতদের কাছে হোলি খেলা কার্যত প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছিল। শুধু রঙেই নয়, হোলিখেলাকে কেন্দ্র করে রাজপুতদের জাতীয়তাবোেধের পরিচয়ও বারবার দেখা গেছে। জাতির সম্মান পুনরুদ্ধারে ভূনাগ রাজার রানি কী করেছিলেন?
‘পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী’।
কেসর খাঁ তো মনের আনন্দে দলবল নিয়ে হোলি খেলতে এলেন বিস্তর যত্ন করে সাজগোজ করে। মুখে আর হাসি ধরে না, রঙের রঙিন উৎসবে রেঙে উঠতে চলেছেন যে! কিন্তু কীসে শেষ পর্যন্ত রঙিন হল কেসর খাঁ?
‘শুরু হল হোরির মাতামাতি
উড়তেছে ফাগরাগ সন্ধ্যাকাশে
নববরন ধরল বকুলফুলে
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।’
ফাগের বদলে রক্তে রঙিন হল কেসর খাঁ আর তাঁর সৈন্যদের দেহ!
রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির দোল উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন, “দোলপূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে, আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।” কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে সে দিন ধ্বনিত হত:
‘ওরে আয়রে তবে
মাতরে সবে আনন্দে
আজ নবীন প্রাণের বসন্তে
পিছনপানের বাঁধন হতে
চল ছুটে আজ বন্যাস্রোতে
আপনাকে আজ দখিন হাওয়ায়
ছড়িয়ে দে রে দিগন্তে …।’
শান্তিনিকেতনে এই দোলখেলা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে ‘বসন্তোৎসব’ হিসেবে এক অসাধারণ ও অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। সে দিন শান্তিনিকেতনে মেয়েরা হলুদ শাড়িতে, চুলে লাল পলাশফুল দিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন। শাল শিমুল পলাশে ঘেরা শান্তিনিকেতনের অনন্যসাধারণ প্রকৃতিতে সঙ্গীত আর আবিরের ছোঁয়া লেগে রঙিন হয়ে ওঠে চতুর্দিক। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে,
‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’
সত্যিই আকাশ তখন রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। শত শত কণ্ঠে ধ্বনিত সঙ্গীত নিখিল বিশ্ব সম্পর্কে মানুষকে উদাস করে দেয়। মনে হয়,
‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে
সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, লয়ের আবীর হাওয়ায় জানে।’
দোল বা হোলি উৎসব ভারতে কবে প্রচলিত হয়েছিল, সেই সন-তারিখ নিয়ে অঙ্কের কচকচি মার্জনা করা হল। কল্পনার ডানা মেলে দিয়ে আমরা কল্পচোখে দেখতে পাই যেন কোনও সুদূর অতীতে নরনারী আবির-কুমকুমে নিজেদের রাঙিয়ে তুলছে, সুগন্ধ ভরা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে রঙিন ধোঁয়া, মাত্রাধিক রঙের আধিক্যে যা ক্রমাগত রূপবদল করছে।
আর যদি ইতিহাসের দিকে তাকাইতবে বেদ, পুরাণ, শব্দপুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ, মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসা সূত্র প্রভৃতিতে হোলি উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই হোলি উৎসব প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। বিবাহিতা মহিলারা তখন পূর্ণ চন্দ্রকে পূজা করতেন সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য। পরবর্তী যুগে আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে এই উৎসবটি পালিত হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বসন্ত-মহোৎসব কিংবা কাম-মহোৎসবের প্রতীক! চিরকালীন প্রেমিক-প্রেমিকা রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে যেমন আজও ফাগের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বৃন্দাবন।
‘‘রঙে রঙে রক্তিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস
যেন চলচঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে
ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।”
বাস্তবিকই শুধু দোল বা হোলি উৎসবের ইতিহাস আলোচনা নয়, এই উৎসব আমাদের শীতের রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে নবীন বসন্তকে আহ্বান জানায়। বলন্ত যদি শুধু মাত্র আমাদের ঋতু পরিবর্তনকে মনে করাত, তা হলে বসন্তের মহিমা ক্ষুণ্ণ হত না কিছুই। কিন্তু শুধু এইটুকু পরিচয়ের মাধ্যমে বসন্ত কালের পরিচয় প্রদান করা যায় না। বসন্তকাল আমাদের নতুন ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে, নতুন উৎসাহ জোগায় আমাদের অন্তরে। সে জন্যই হৃদয় বলে ওঠে,
‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে।’
দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় আকাশে পূর্ণচন্দ্র যখন আলোয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে তোলে, তখন কার প্রাণ বলে উঠবে না।
‘কে রক্ত লাগালে বনে বনে
ঢেউ জাগালে সমীরণে
আজ ভুবনের দুয়ার খোলা
দোল দিয়েছে বনের দোলা
দে দোল দে দোল দে দোল!’
ফাগুন হাওয়ায় মনপ্রাণ শীতল হয়ে ওঠে—আগতপ্রায় গ্রীষ্মের চোখরাঙানিকে ভুলে গিয়ে শান্তিতে হৃদয় ভরাতে ইচ্ছা হয়— ইচ্ছে হয় বলি,
‘ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে পাগলঝোরা লুকিয়ে ঝরে
গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের পরে।’
আমরা জানি, জীবন সব সময় সুখের নয়। বিবাদ অশান্তি দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এই সব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মনে আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারু রূপে চলবে? না। কারণ জীবন পরিবর্তনশীল। দোল উত্সবের আনন্দ উৎসবের মধ্যে রয়েচে সেই উৎসাহেরই বার্তা। যে উৎসব বার্তা দেয় সকল দুঃখ দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা—জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে।
এই লেখায় দোল বা হোলি উৎসবের ইতিহাসের একটু ছোঁয়া না দিলে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। স্কন্দপুরাণ বলছে, হোলিকা রাক্ষসী হরিপ্রেমে মাতোয়ারা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পুড়িয়ে হত্যা করার জন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য! হরির কৃপায় প্রহ্লাদ পুড়লেন না এতটুকুও। বরং পুড়ে মারা গেল হোলিকা রাক্ষুসী স্বয়ং। এর থেকেই নাকি হোলি উৎসবের শুরু। হোলির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ফাল্গুন পূর্ণিমার আগের শুক্লা চতুর্দশী তিথির সন্ধ্যায় মেড়া পোড়ানোর উত্সব। পুরাণ থেকে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ মেড়া তথা মেষাসুরকে বধ করার পর যে আনন্দ-উৎসব হয়েছিল, সেই মেড়া তথা পরবর্তী কালের অপভ্রংশে ‘নেড়া পোড়ানো’ উত্সবের সেই ছিল সূচনা।
রঙের উৎসব, নতুনকে আহ্বান করার উৎসব হল দোল। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগের এক ভারতীয় গুহালিপিতে দোল উৎসবের কথা আছে। এই গুহালিপি রয়েেছে মধ্যপ্রদেশের রামগড়ে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে বাৎসায়ন রচিত কামসূত্রে পাওয়া যায় দোল খেলার কথা। দেবতাকে কেন্দ্র করে রঙের উৎসবে মেতে ওঠার গল্প। চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি উৎসবকে শবরস্বামী তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন ‘হোলক উৎসব’ বলে।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় বৃন্দাবনে যমুনার তীরে অদ্বৈত বটের নীচে কৃষ্ণমন্দিরের গুলাব-পাপড়ি হোলির কথা। ভক্তরা মন্দিরপ্রাঙ্গণে একে অপরকে সুগন্ধী গোলাপের পাপড়ি ছুড়ে হোলি খেলেন। মনে হয় যেন শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীমতী রাধা সূক্ষ্ম শরীরে এখানেই বিরাজ করছেন।
দোলপূর্ণিমার এই পুণ্যলগ্নে নবদ্বীপের গঙ্গাপাড়ে জন্মেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। হরিপ্রেমে মাতোয়ারা, হরিনামে উন্মত্ত শ্রীচৈতন্য এই দিনে জন্মেছিলেন বলেই এই ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোলের দিনটিকে ‘গৌরপূর্ণিমা’ও বলা হত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রীগদাধর পণ্ডিত দোলায় চড়েছিলেন ও তাঁদের অনুগামী ভক্তবৃন্দ তাঁদের আবির কুমকুমে মাখিয়ে ভক্তি সহকারে পূজা করেছিলেন। এই অসাধারণ সুমধুর ঘটনাটিকে ‘হিন্দোলিকা বিহার’ বলা হয়। আজও নবদ্বীপ ও মায়াপুরের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা ‘ইসকন’ সংস্থাটি পৃথিবীর যত জায়গায় তাদের শাখা সংগঠন আছে সর্বত্রই দোলোৎসব পালিত হয় মহা সমারোহে।
ভারতবাসী সারা বছর ধরে যত উৎসব করে, তার মধ্যে হোলির সঙ্গে শাস্ত্রের সম্পর্ক সবচেয়ে কম আর বেলাগাম হুল্লোড় সবচেয়ে বেশি। ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎস, সাধারণত আগের রাত্রে হোলিকা দহন দিয়ে এর সূচনা হয়, তার পর সারা দিন অসহায় মানুষজনের উপর আবির এবং রঙের বর্ষণ চলে, শেষ হয় মিষ্টি এবং অন্য নানা খাদ্য ও পানীয়ের উল্লাসে। পণ্ডিত এস এম নটেশ শাস্ত্রীর বক্তব্য:
‘এর সঙ্গে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কিছুমাত্র যোগ নেই, তবে নির্বোধ আচরণ আছে প্রভূত পরিমাণে।’
হোলি, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? উত্তর খুঁজতে হলে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে যেতে হবে, সন্ধান করতে হবে নানান লোককথা এবং লোকাচারের গহনে। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক নথি বা তথ্য খুঁজে কোনও লাভ নেই, ভারতের প্রধান ধর্মটির কাছে সে-সব অতি বিরক্তিকর। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত দণ্ডিন্-এর সংস্কৃত নাটক দশকুমারচরিত ও শ্রীহর্ষের রত্নাবলী’তে হোলির কথা আছে। পুরাণেও এই উৎসবের কথা ইতস্তত পাওয়া যায়। মুঘল মিনিয়েচারেও এ নিয়ে নানান কাহিনি চিত্রিত হয়েছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি সপ্তদশ শতাব্দী থেকে হোলি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে: ১৬৮৭ সালে অক্সফোর্ড লিখেছে Houly, ১৬৯৮ সালে Hoolee, ১৭৯৮-এ Huli, ১৮০৯-এ Hoh-lee, ইত্যাদি।
গল্প এবং আচার নানা জায়গায় ও নানা যুগে নানা রকম, কিন্তু বহু শতাব্দীব্যাপী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দাপটে উৎসবের সময় এবং মূল চরিত্রে দেখা গেছে আশ্চর্য ‘ঐক্য’। নাম অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম: বাংলা, ওডিশা ও অসমে দোলযাত্রা, বিহারে ফাগুন, মহারাষ্ট্রে শিম্গা, গোয়া ও কোঙ্কন উপকূলে শিগমো। আবার কোঙ্কনের দক্ষিণাঞ্চলে এই উত্সব উক্কুলি নামে পরিচিত, মালয়ালম ভাষায় এর নাম মঞ্জলকুলি, যার অর্থ হল হলুদ-স্নান। কর্নাটক ও তেলঙ্গানার মানুষের বিশ্বাস, পবিত্র অগ্নিতে যাঁকে দাহ করা হয় তিনি হোলিকা নন, তিনি হলেন কামদেব, আর তাই ওঁরা বলেন কাম-দহন। পঞ্জাবে এ সময় ঘরবাড়িতে নতুন রং করা হয়, মেয়েরা কাপড়ের উপর অপূর্ব সব হাতের কাজ করেন, বহুবর্ণ সেই শিল্পকর্মের নাম চক-পুরানা। তামিলনাড়ুতে উৎসবের নাম হয়ে যায় পান্গুণি-উত্থিরম্, এবং অনেক প্রাক্-হিন্দু দেবতা এই দিন বিবাহবার্ষিকী পালন করেন; বুঝতে অসুবিধে হয় না, এ হল তাঁদের হিন্দু দেবলোকে আত্মসাৎ করার প্রকল্প। এখানে কোনও হোলিকা দহন হয় না, কারণ হোলি এখানে প্রধানত বসন্ত উৎসব, তবে অবশ্যই তাতে ধর্মের ভাগটা অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে বেশি। গুজরাতে হোলি চলে দু’দিন ধরে। হোলিকার আগুনে নারকেল এবং ভুট্টা আহুতি দেওয়া হয়। এই সময় রবিশস্য পেকে ওঠে, ফলে খাওয়াদাওয়া, নাচ, গানের ধুমধাম অনেক বেশি। কমবয়সি ছেলেমেয়েরা ননী-ভাণ্ডের দখল নিয়ে ‘লড়াই’ চালায়, সে উচ্ছ্বাসে প্রতিফলিত হয় বসন্ত, যৌবন, স্বাধীনতা। আসল হোলি অবশ্যই কৃষ্ণ-কান্হাইয়ার মথুরা ও বৃন্দাবনে, তবে এখানেও বারসানার ‘লাঠ-মার হোলি’ নিয়েই সবচেয়ে মাতামাতি। মেয়েরা সত্যিই পুরুষদের লাঠিপেটা করে, ছেলেরা দৃশ্যত সেই আদরের মার খেয়ে গান গায়, মেয়েদের রাগিয়ে দেওয়ার গান, তারা কপট রাগে আরও মারতে থাকে।
গঙ্গার তীর ধরে আরও নেমে এলে দেখা যাবে, কানপুরে হোলি উদ্যাপিত হয় জাতীয়তাবাদী গঙ্গা মেলা হিসেবে, আবার বারাণসীতে কাদামাটি গায়ে মেখে কুস্তি না হলে চলে না। আরও নীচে বিহারে ফাগুয়ার প্রচলন, এটা মূলত ভোজপুরী উৎসব, সেখানে রঙের বদলে কাদার ব্যবহার অতি প্রশস্ত। তার পর দুধ এবং মশলা সহ ভাঙের সরবত, অর্থাৎ ঠান্ডাই, এবং ঢোলক বাজিয়ে নাচগান। আবার উত্তরে কুমায়ুন পাহাড়ে পনেরো দিন আগে থেকে স্থানীয় মানুষ মিলে হোলিকার কাঠামো তৈরি করে, তার নাম চীর বন্ধন। তার পর আসে হোলি-ধুলান্দি-র মাহেন্দ্রক্ষণ।
ওডিশা ও বাংলায় দোলপূর্ণিমায় ঝুলনদোলায় রাধাকৃষ্ণের মিলন উদ্যাপিত হয়। বলা হয়, এই তিথিতেই শ্রীচৈতন্য তাঁর ভক্ত ও তীর্থযাত্রীদের মাধ্যমে পুরী থেকে বাংলায় দোল-উৎসব রফতানি করেছিলেন। হরিভক্তিবিলাস ও সমকালীন অন্যান্য লেখায় এই দোল-উৎসবের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু শ্রীচৈতন্যের জীবনীতে বা বৈষ্ণবপদাবলীতে নবদ্বীপে দোল উদ্যাপনের কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না। ভগিনী নিবেদিতা বাংলার দোলযাত্রা নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন, ১৯১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে যেটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। তিনি দোলপূর্ণিমাকে শ্রীচৈতন্যের জন্মদিন হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, এটি ‘প্রাক্-হিন্দু মানুষের প্রাচীন উৎসব’।
হোলির সঙ্গে দানবী হোলিকার সংযোগ নিয়ে আর একটু বলা দরকার। দৈত্য প্রহ্লাদের গল্পে হোলিকার খুবই গুরুত্ব আছে। হোলিকা হিরণ্যকশিপুর বোন, প্রহ্লাদের পিসি। তার পোশাক ছিল ‘ফায়ারপ্রুফ’। শিশু প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে হোলিকা আগুনে প্রবেশ করেছিল, কারণ সে জানত সে পুড়বে না, কিন্তু ভাইপো দগ্ধ হয়ে যাবে। হল অবশ্য উল্টো— তার পোশাকের মাহাত্ম্য অন্তর্হিত হল, আর নারায়ণের করুণায় তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত দেহে আগুন থেকে বেরিয়ে এল। প্রসঙ্গত, হোলিকা বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে, শিশুমাংস তার ভারী প্রিয়। পণ্ডিতরা হোলিকা দহনকে প্রতীক রূপে দেখেন। রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের প্রতীক। বছরের এই সময়টাতেই তো যত রকমের রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং তার প্রধান বলি হয় ছোট শিশুরা। অন্য গল্পটা কামদেবকে নিয়ে। শিবের রোষানলে তিনি দগ্ধ হয়েছিলেন। সেই দাহও হয়তো বা প্রতীকী— উদ্দাম হোলিখেলার মধ্যে কামনাবাসনার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, সেটা দমন করার জন্যই আগুনের কল্পনা; যদিও, সত্যি বলতে কী, ঠান্ডা জলেও কাজ হত। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ইউরোপীয় পর্যটকরা পর্যন্ত বাইরের লোকেরা হোলির একটা ব্যাপার নজর করেছেন, সেটা হল অশ্লীল গান গাওয়ার প্রথা। নানা হিন্দু গ্রন্থেও এ নিয়ে স্পষ্ট ভাবে লেখা হয়েছে। ১৮৮০’র দশকে উইলিয়ম ক্রুক কিংবা একশো বছর আগে এম এম আন্ডারহিল এই অশালীন ভাষার কথা উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, বিভিন্ন প্রাচীন স্মৃতি’তে বলা হয়েছে, এই উৎসব শ্রীচৈতন্যের কয়েক শতাব্দী আগেও প্রচলিত ছিল, তাতে নিম্নবর্ণের মানুষ ভয়ানক অশ্লীল সব কথাবার্তা বলত। এর থেকে দুটো ব্যাপার বোঝা যায়: এক, এই উৎসবে নিহিত যৌন ইঙ্গিত এবং দুই, এর প্রাগার্য ইতিহাস। আন্ডারহিল লিখেছেন, ‘নিম্নবর্গের পুরুষ ও বালকদের নাচ এই উৎসবের একটা বৈশিষ্ট্য’। একই সঙ্গে তিনি লক্ষ করেছেন যে, হোলি সব বর্ণের মানুষকে একসঙ্গে আনত। তিনি প্রাচীন শাস্ত্রবচনের সাক্ষ্য দিয়ে লিখেছিলেন, ‘হোলির দ্বিতীয় দিনে নিম্নবর্ণের মানুষের দেহ স্পর্শ করে তার পর স্নান করলে সমস্ত অসুখ দূর হয়ে যায়।’ এটা কি আসলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, মানে ইমিউনিটি গড়ে তোলা?
ভারত ও নেপাল ছাড়িয়ে হোলি চলে গিয়েছিল সুদূর সুরিনাম এবং ত্রিনিদাদ-টোবাগোর মতো দেশে, সেখানে এর নাম ফাগুয়া। গায়ানাতে তো এটা রীতিমত জাতীয় উৎসব, জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ এতে যোগ দেন। ফিজি ও মরিশাসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষরা আজও, দেশ ছেড়ে বহু দূরে চলে যাওয়ার এত কাল পরেও ঢোলক বাজিয়ে নাচের তালে ‘ফাগ গাইন’ গাইবেনই।
রং ছুড়ে হোলি খেলার ভারতীয় প্রথাটি এ কালে ইউরোপ আমেরিকারও মন কেড়েছে। পশ্চিম দুনিয়ায় বেশ কিছু কমিউনিটি উৎসবে, এমনকী বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানেও হাজার হাজার সাহেব-মেম রং খেলার উৎসাহে ভারতবাসীকেও হারিয়ে দেন। আমেরিকার সিবিএস বা এনবিসি’র মতো টেলিভিশন চ্যানেলে জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো’য় হোলি স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন সংগীতস্রষ্টা বা ব্যান্ড হোলির তীব্র আনন্দকে নিজেদের সৃষ্টিতে আত্তীকরণ করে নিয়েছেন, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় গুডলাক কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেশা অথবা রেজিনা স্পেকটর-এর ‘ফিডেলিটি’। আসলে আনন্দ, রং, খুশির নাচগান, এ সবই আজও মানুষের মন ভোলায়। আর সেই কারণেই ভারতের সাংস্কৃতিক রফতানির আরও একটি জিনিস যুক্ত হয়েছে। হরি বোল!
বসন্তোৎসবে বাঙালির অন্যতম প্রিয় স্থান কবিগুরুর শান্তিনিকেতন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে কিভাবে শুরু হল এই উৎসব। তাকানো যাক অতীতের পাতায়।
তখন সিপাহি বিদ্রোহ চুকেছে। রেলের লাইন পড়েছে। যাতায়াতের গতি দ্রুততর হচ্ছে। সাহেবরা রেল পাতছেন প্রশাসনের সুবিধের জন্য, সে রেলের সুবিধে ভদ্রলোক নেটিভরাও পাচ্ছেন। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ মহর্ষি হয়েছেন। নিরাকার ব্রহ্মের তিনি উপাসক। নিরাকারের ধ্যান-উপাসনা প্রকৃতির মধ্যে ভাল হয়। দেবেন্দ্রনাথের কাছে তাই প্রকৃতির মনোরম ক্ষেত্রগুলিই তীর্থভূমি। তিনি ঘোরেন প্রকৃতির নানা তীর্থে। ধর্ম প্রচারও করেন, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক বলে বেদ-উপনিষদ তাঁর আশ্রয়স্থল। দেবেন্দ্রনাথ বীরভূমের সিংহদের বাড়িতে ব্রাহ্মধর্মের ভাব প্রচারের জন্যই এসেছিলেন। সেই ভাবপ্রচারের কাজে এসেই তাঁর এখানকার মনোরম প্রকৃতি দর্শন। শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর ইতিহাসকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনেক ভেবেও অবশ্য বুঝতে পারেননি, দেবেন্দ্রনাথ ঠিক কোন পথে বোলপুর থেকে পালকি করে জমিদার সিংহদের বাড়ি থেকে যাতায়াত করছিলেন। চালুপথে গেলে প্রাকৃতিক জমি-জিরেতের মনোরম শোভা, যা তাঁর পরবর্তীকালের শান্তিনিকেতনের ভূমি, হালের বাবু-ট্যুরিস্টদের মোচ্ছব ভূমি, দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা নয়। তবে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, ভাল লেগেছিল, জমিদার সিংহরা জমির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে শান্তিনিকেতন গৃহও ব্রাহ্মদের উপাসনার জন্য আচার্য দেবেন্দ্রনাথ স্থাপন করেছিলেন। প্রথমে তা একতলা, পরে দ্বিতল।
তবে সে গৃহ কেবল অরূপের উপাসনার গৃহ হয়ে রইল না, রূপের উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠল। গৃহের সীমায় আটকে রইল না শান্তিনিকেতন। বলেন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের স্বপ্ন সেখানে পরিণতি পায়নি। বলেন্দ্র অকালে মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও কল্পনা সেখানে গড়ে তুলল তাঁর শান্তিনিকেতন। এই শান্তিনিকেতনের আদিপর্বে তপোবনের আদর্শের কথা উচ্চারিত হয়, কঠোর ব্রহ্মচর্যের আদর্শ ঘোষিত হয়। ১৯০২ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এমনিতে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শে ছিল নানা পার্থক্য। অনেক চেষ্টা করেও নিবেদিতা এই দুই বাঙালির মধ্যে সহজ সখ্য স্থাপন করতে পারেননি। তবে শান্তিনিকেতনের আদিপর্বে তপোবনের ছাঁচে ব্রহ্মচর্যের আদর্শে যে ইস্কুল নির্মাণের স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেন ও দেখান তা বিবেকানন্দের ভাবাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ তো বদলাতে বদলাতে, ভাঙতে ভাঙতে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর চোখ কেবল অরূপের নয়, বৈরাগ্য সাধনে কেবল মুক্তি নয় তাঁর। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথ কেবল অরূপের নন, রূপ ও অপরূপেরও। তাঁর দেখার চোখ বিরাগীর নয়, অনুরাগীর। সুতরাং শান্তিনিকেতনের মর্মে রং লাগল। রাণী চন্দ তাঁর চিত্রময় স্মৃতিকথায় গুরুদেবের বর্ণময় সজ্জার কথা লিখেছেন। প্রকৃতিতে ঋতু বদল হয়, গুরুদেবের বস্ত্রেও রং লাগে। ঋতুকে ঘিরে কবির মনের এই যে চলাচল তাই ভর করে শান্তিনিকেতনের উৎসবে, নানা সময়ে।
ইতিহাসকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পুত্র শমী ১৩১৩-র শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ঋতু উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সেই ঋতুর উৎসবে কেবল বসন্ত ছিল না, বর্ষা ও শরৎও ছিল। ঋতু সাজে সজ্জিত বালকদের এই উৎসব তাই শান্তিনিকেতনের আদি বসন্তোৎসব। তবে সাল তারিখের হিসেব অপরাপর সূত্রের সঙ্গে যাচাই করলে পুরোটা না-ও মিলতে পারে। যে সময় শমীন্দ্রের এই আয়োজন সেই সময় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে আসেননি, এসেছেন তার বছর দুই পরে। তাঁর এই ভাষ্য তাই পরোক্ষ সূত্র থেকে নেওয়া। তবে সাল তারিখের গরমিল যা-ই হোক না কেন, শমীর এই ঋতু উৎসবের কথাটা সত্য। প্রিয় পুত্রের মতো রবীন্দ্রনাথও ঋতুময়। তাঁর ঋতুময় নাটকগুলিতে মাঝে মাঝেই ঘর থেকে প্রকৃতির আঁচলে নেমে পড়ার ডাক শোনা যায়। কাজেই শান্তিনিকেতনে ঋতু যাপনের দোলা লাগবে সে আর বলতে! তবে সেই ঋতু-যাপনে সব সময় বছরের পর বছর একই-রকম দিনক্ষণ মানা হত না। চন্দ্রাহত শান্তিনিকেতনে রাতে বসন্তের গান উঠত জেগে। চরাচর ধুয়ে যাওয়া আদিগন্ত জ্যোৎস্নায় আনন্দের জোয়ার তো লাগবেই–চাঁদের হাসির বাঁধ তো ভাঙবেই। শমীর আয়োজনের পর যে খুব ধারাবাহিক ভাবে এ উৎসব হত তা নয়, তবে যেটা বোঝা যায় শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ঋতু উৎসব ছিল আশ্রমিকদের অংশগ্রহণের। সে উৎসবে আনন্দের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে নান্দনিকতার যোগ ছিল গভীর। অবশ্য এ কথাও ঠিক অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের সময়কালেই নান্দনিকতার মাত্রা অনান্দনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ত। অন্তত কারও কারও চোখে আনন্দ প্রকাশের সেই চেহারাটি কটু লাগত। পঞ্চানন মণ্ডলেরই যেমন ভাল লাগেনি কোনও কোনও ঘটনা। তবে সব মিলিয়ে ক্রমশই শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের মধ্যে ঋতু উৎসবের সহজ রূপটি পালনের আনন্দময় দিনক্ষণ স্থির হয়ে গিয়েছিল।
তবে রূপ দেখার ও অংশগ্রহণের শিক্ষা যে সবার থাকে তা তো নয়। বিশেষ করে যখন অংশগ্রহণের বদলে পয়সা খরচ করে দেখার বাসনা মুখ্য হয়ে ওঠে তখন মত্ততার পালে হাওয়া লাগে। ইতিহাসের পুরনো ক্রম অনুসরণ না করে এ কথা বলাই যায়, দোলে শান্তিনিকেতনে যাওয়া এখন সাংস্কৃতিক প্যাকেজ। এই প্যাকেজ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। আম বাঙালি শান্তিনিকেতনে নিমজ্জিত, ছোট শহরের নাভিশ্বাস উঠতে বাধ্য। গাছের গায়ে হাত পড়ে, রাস্তা জ্যামজমাট হয়। নিভৃতি উধাও। সেই প্যাকেজে পুঁজি ও দেখনদারিত্ব মুখ্য। আশ্রমের নিজস্ব উৎসবকে বাইরে থেকে এসে দেখার লাগ-ভেলকি-লাগে মন দিলে আর যাই হোক শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিকে স্পর্শ করা যায় না। তবু পর্যটনপুঁজির যুক্তি মেনে এ তো চলবেই। শুধু মনে হয় যদি পরিবেশ-পরিস্থিতিকে খানিকটা সহনীয় করার জন্য পর্যটকেরা একটু যদি সচেতন হন! নিভৃতিকে যদি নষ্ট না করেন! আর বসন্তের একটা দিনে হাজিরা না দিয়ে নিজেদের মতো করে নীরবে বসন্ত প্রকৃতিকে স্পর্শ করে চলে যান তা হলে তাঁদের মনে বসন্তের রং ঠিকমতো লাগতে পারে। ইচ্ছে হলে প্রমত্ত অবস্থায় কাদা মেখে হোলি খেলা যায় বটে তবে উৎসব মানে যে প্রমত্ততা নয় সে কথাই তো রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন। সেটুকু বোঝার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।
তবে বর্তমানে কী ভাবে দোলযাত্রাকে পিছনে ফেলে পরাক্রান্ত হয়ে উঠছে ‘হোলি’, সেটা মালুম হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। এ বার বাঙালির প্রাক্-দোল উৎসব ‘বুড়ি পোড়ানো’ বা ‘নেড়া পোড়া’-রও গেল-গেল দশা!
‘বুড়ি পোড়ানো’ বা ‘নেড়া পোড়া’র বদলে বঙ্গজীবনে দোলেই জাঁকিয়ে বসেছে ‘হোলিকা দহন’। যার পৌরাণিক গল্প কমবেশি শোনা থাকলেও এত দিন শহর কলকাতায় বসে যা তেমন চাক্ষুষ করা যেত না। এখন তা করা যায়।
দোল বা হোলিতে আগুনে অশুভকে সমর্পণের রীতিটি প্রায় সর্বভারতীয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমার আবহে শীতের আবর্জনা, শুকনো ডালপাতা পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার রীতি চালু আছে সারা দেশেই। কিন্তু হোলিকা দহন বাঙালির তত চেনা নয়। বাঙালির ‘নেড়া পোড়া’ দোলের আগের সন্ধ্যার আচার। আর হোলির আগের দিন উত্তর ভারতে হোলিকা দহনকে ‘ছোট হোলি’-ও বলা হয়।
সাবেক বাঙালি দেবতা মনসা, শীতলাদের পিছনে ফেলে ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছেন হনুমানজি, গণেশজি। ভূত চতুর্দশী ভুলে ধনতেরাস, কালীপুজোর থেকেও দিওয়ালিতে মত্ত বাঙালি। কারও কারও মত, একই ভাবে নেড়া পোড়া ভুলে হোলিকা দহনের জয়জয়কার।
পুরাণ, মহাকাব্যবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘বিশ্বায়নটা আজকাল বাঙালির কাছে হিন্দিকরণের আদলেই ঢুকছে!’’ তাঁর ব্যাখ্যা, হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার হাত থেকে প্রহ্লাদকে বাঁচাতেই তাকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন বিষ্ণু। আর নেড়া পোড়া কথাটি আদতে মেড়া বা ভেড়া পোড়ানো থেকে ধার করা। বৈদিক ভাব অনুযায়ী ভেড়া অশুভের প্রতীক। হোলিকাও তা-ই। তবে উত্তর ভারতের প্রথাটি পুরাণ-আশ্রিত। আগে দোলের পরের দিন অর্থাৎ হোলিতে ছুটি পেত না বাঙালি। এখন এ দিনও ছুটি দেয় বর্তমান সরকার।
বাঙালি হোলিকা দহন করুক বা হোলি খেলুক — তাতে অবশ্য সমস্যা দেখছেন না নৃসিংহবাবু। তবে তাঁর আফসোস, ‘‘দোল যে শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি, বাঙালি সেটা ভুলতে বসেছে দেখে কষ্ট হয়।’’
(তথ্যসূত্র:
১- Hindu Festivals: Origins, Sentiments & Rituals, Sadhu Mukundcharandas, Swaminarayan Aksharpith (২০১০)।
২- Religious Rites and Festivals of India, G. R. Sholapurkar, South Asia Books (১৯৯০)।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা: ১লা মার্চ ও ৫ই মার্চ ২০১৫ সাল, ২১শে মার্চ ২০১৯ সাল, ৯ই মার্চ ২০২০ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত