নারী দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি মুক্তি পেল শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় প্রযোজিত, অরিত্র মুখোপাধ্যায় পরিচালিত, উইন্ডোজ প্রোডাকশন নিবেদিত একটি আদ্যন্ত নারীবাদী ছবি “ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি”। এই ছবির প্রধান চরিত্র সংস্কৃতের অধ্যাপিকা শবরী গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋতাভরী চক্রবর্তী। এছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন সোহম মজুমদার, সোমা চক্রবর্তী, মানসী সিন্হা, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সাহেব চট্টোপাধ্যায় ও শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। শ্রদ্ধেয়া শ্রীমতী গৌরী ধর্মপাল প্রবর্তিত কন্যাদান প্রথা বিহীন বৈদিক মন্ত্র ও রবীন্দ্র সঙ্গীত সহযোগে বৈদিক বিবাহ পদ্ধতিকে সামনে রেখে অধ্যাপিকা নন্দিনী ভৌমিকের জীবনকাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেদহীন চিত্রনাট্য লিখেছেন জিনিয়া সেন ও যুক্তিপূর্ণ সংলাপ লিখেছেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবিটি তথাকথিত যুক্তিহীন পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধী। ছবিটি দেখলে বোঝা যায় এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ঋতাভরী চক্রবর্তী যথেষ্ট পরিশ্রম করে প্রস্তুত হয়েছেন। কেননা এই ছবিতে বেশ কিছু পূজা পদ্ধতি ও মন্ত্রের সরাসরি প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। সমগ্র ছবিতে তার অভিনয় খুবই সাবলীল।
মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা শবরী সংস্কৃতের পাশাপাশি নাচে গানেও পারদর্শী। সে ছোটবেলা থেকেই তার বাবার কাছে পূজো শিখেছে। পৌরোহিত্য তার কাছে পেশা নয় ভালবাসা। কিন্তু তথাকথিত গোঁড়া ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন মহিলার পুরোহিত হওয়াটাকে ভাল চোখে দেখেনা। কেননা মেয়েরা প্রতি মাসেই অশুচি হয় তাই তারা নিত্য পুজো করার অধিকার পায়না। তাছাড়া তারা পৈতে পরতে পারেনা। এই ছবি তার বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠে। বৈদিক যুগে মেয়েদের পৈতে পরার ও পূজা-যাগ-যজ্ঞ করার অধিকার ছিল। কালক্রমে মেয়েদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। সেই অধিকার পাওয়ার জন্য শবরী মিনতি করেনা বা অধিকার আদায় করে নেয় না, রীতিমতো যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় সেই অধিকার মেয়েদের আছে অনেক আগে থেকেই। রজঃস্বলা হওয়া নারীত্বের পরিচায়ক, মাতৃত্বের প্রতীক। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তা প্রকৃতির মহান দান।
তাই সেটা মেয়েদের দুঃখের কারণ নয় আনন্দের কারণ। অম্বুবাচীর সময় জগন্মাতাও রজোবতী হন, তাতে তিনি অপবিত্র হয়ে যান না। তাই শবরী ওই দিনটাকে ক্যালেন্ডারে লাল কালি দিয়ে হৃদয়ের চিহ্ন এঁকে চিহ্নিত করে রাখে। ছবিতে শবরীমালার প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে নিয়মমাফিক রজঃস্বলা না হলে সেই মেয়েকে কেউ বিয়ে দিয়ে ঘরে তুলতে চায়না। কেননা তার থেকে বংশবৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা থাকেনা। আবার সেই রজঃই মেয়েদের অপবিত্রতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু মন্দিরের প্রধান পুরোহিত (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়) মন্দিরের দেবতার গয়না চুরি করে, নিজের স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে চরিত্রহীনতার পরিচয় দেয়। তবুও সে পবিত্র কেননা সে পুরুষ। সমাজে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে আঘাত করে এই ছবি। মেয়েদের রজঃস্বলা হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেটিকে গোপন করার চেষ্টা করা হয়, সন্তান ক্ষিদের জ্বালায় কাঁদলে তাকে সবার সামনে স্তন্যপান করানোটা মায়ের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হয়ে যায়, কেননা তাতে স্ত্রী অঙ্গের গোপনীয়তা রক্ষা হয়না কিন্তু পুরুষেরা গোপনে কোন অপরাধ করলে তা জানাজানি হয়ে গেলেও তারা ক্ষমার যোগ্য শুধুমাত্র তারা পুরুষ বলেই। মানুষ সব কিছু গোপন করার চেষ্টা করলেও সর্বব্যাপী ঈশ্বরের কাছে কোনোকিছুই গোপন থাকেনা। কার্যত সেই কারনেই ছবির এই নামকরণ। শবরীর সংলাপের মধ্যে বলা হয় ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপনের পদ্ধতিই হল পূজা।
সেই অধিকার কি একচেটিয়া পুরুষেরই আছে? আবার কন্যাদান একটি সামাজিক প্রথা। কন্যাদান না হলে বিবাহ সম্পূর্ণ হয়না এই ধারণায় সবাই অভ্যস্থ। শবরীর সংলাপে বলা হচ্ছে একমাত্র গরু আর কন্যা এই দুটি দান করার কথা বলা হয়। কন্যা আর গরু কি এক হল? নাকি কন্যা কোনো পন্য যে তাকে দান করা হবে? পুত্রকে তো কখনও দান করা হয়না। হিন্দু বিবাহ পদ্ধতিতে একমাত্র কন্যাদানের কোন মন্ত্র নেই। বৈদিক বিবাহ পদ্ধতিতে কন্যাদানের কোন উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালে যে মন্ত্র রচিত হয়েছে তাতে সংস্কৃত ভাষায় শুধু বলা হয়, সালঙ্কারা বস্ত্রাবৃতা কন্যাকে আমি তোমায় দান করছি। এর পেছনে কোন দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক তাতপর্য নেই। বিবাহ মানে একজন সাবালক ও একজন সাবালিকার মিলন। সারাজীবন সব পরিস্থিতিতে একসাথে একে অপরের সহায়ক হয়ে চলার অঙ্গীকার। তাই মেয়েদের শাঁখা-সিঁদুর বন্ধনের প্রতীক নয়। এর সাথে অনেক মানুষের ভালবাসা, আশীর্বাদ মিশে থাকে। তাই ছবিতে দেখা যায় সিঁদুর দানের পর কনে নিজের কপাল থেকে একটু সিঁদুর নিয়ে বরের কপালে তিলক পরিয়ে দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে মন্ত্রগুলো বিয়ের সময় বলা হয় তার সঠিক অর্থটা বর ও কনের জানা প্রয়োজন। আবার বিয়ের জন্য জাতপাতের সংস্কারকে দূরে সরিয়ে শবরী বলে, “আমি মানুষের সাথে মানুষের বিয়ে দিই।“ অর্থাৎ বিয়ের জন্য জাতপাত বা কুষ্ঠি মেলানোর চেয়ে দুটি মানুষের মন ও মানসিকতার মিল হওয়াই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। শবরী তার লড়াইয়ে সম্পূর্ণভাবে তার স্বামীকে (সোহম মজুমদার) পাশে পায়। শবরীর শাশুড়ি তথা পঞ্চায়েত প্রধান অমরাবতী (সোমা চক্রবর্তী) ও জ্যোতিষী পিসিশাশুড়ি গুরুদাসী (মানসী সিন্হা) প্রথম থেকে শবরীর চূড়ান্ত বিরোধিতা করলেও শেষে তারাও মেয়েদের পৌরোহিত্যের যৌক্তিকতা বুঝে সমর্থন করেন। ছোট চরিত্র শবরীর বাবার ভূমিকায় সাহেব চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় সাবলীল। শেষে বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায় গায়িকা ইমন চক্রবর্তীকে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ছবির বিষয়টি গুরুত্ত্বপূর্ণ হলেও সিনেমাটোগ্রাফিতে বেশ কিছু খুঁত ধরা পড়ে। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ছবিতে ব্যবহৃত একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও দুটি গান ভাললাগার মতো। সৌম্যজ্যোতি ঘোষের বাঁশিতে “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে” গানটির প্রয়োগ সুন্দর হলেও সমগ্র ছবিটির আবহ অত্যন্ত দূর্বল। ছবিটির জন্য পরিচালক, লেখিকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী সকলের পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো। সব মিলিয়ে ছবিটিকে ১০-এর মধ্যে ৭ দেওয়া যায়।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত