লোকসভা নির্বাচনের পরে হিড়িক উঠেছিল রাজনৈতিক দলবদলের। ভোটের ফল দেখে এবং গেরুয়া বাহিনীর হুমকির মুখে বহু নেতা-কর্মী-জনপ্রতিনিধিই যোগদান করেছিলেন বিজেপিতে। কিন্তু কিছুদিন গড়াতেই বিজেপির ওপর ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে নিজের নিজের পুরনো দলেই ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে শুধু ভিনদল থেকে আসা কর্মীরাই যে ক্ষুব্ধ, এমনটা নয়। জেলায় জেলায় বিজেপি নেতা-নেত্রীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের দেওয়ালে ঢুঁ মারলেই মালুম হচ্ছে গোষ্ঠীকোন্দল কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ, নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ উগড়ে দিতে সোশ্যাল মিডিয়াকেই হাতিয়ার করেছেন দলের জেলাস্তরের অনেকে। যোগ্য নেতাকর্মীদের কেন পার্টি গুরুত্ব দিচ্ছে না, সেই প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলতে শুরু করেছেন বিজেপির নিচু ও মাঝারি তলার নেতা-কর্মীদের একাংশ। ঘনিষ্ঠমহলে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের অনেকেও স্বীকার করছেন, দলের একাংশের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা বিপজ্জনক ইঙ্গিত। বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহার কথায়, ‘পার্টিতে শৃঙ্খলা বলে একটা ব্যাপার আছে। ক্ষোভবিক্ষোভ থাকতেই পারে, তবে সে-সব প্রকাশের জায়গা সোশ্যাল মিডিয়া হতে পারে না।’
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি খড়গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে বিজেপি গো-হারা হারার পর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে কোনও রাখঢাক না রেখেই চলছে দোষারোপ ও পাল্টা দোষারোপের পালা। এরইমধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি শিবু পানিগ্রাহী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিজেপির নেতাদের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ, কাজের লোককে কাজে লাগান। কাছের লোককে কাছে রাখুন। এতে দলের ভালো হবে।’ শিবু দলে পরিচিত মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে।
কতকটা শিবুর সুরেই পুরুলিয়ার বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা নগেন্দ্র ওঝার ফেসবুক পোস্টটি এ রকম- ‘দিনরাত পরিশ্রম করে, নিজের টাকা খরচ করে যারা রাজনীতি করেছে, এমন কর্মীদের সম্মান দেওয়া উচিত।’ নগেন্দ্র ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে লড়েছিলেন। বিজেপির মহিলা মোর্চার মালদা জেলার প্রাক্তন সভানেত্রী সাগরিকা সরকারের আক্রমণ আরও সরাসরি। তিনি গত ২৯ নভেম্বর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যারা রাজনীতির অ-আ-ক-খ ভালো করে শিখল না, তারাই জেলা সংগঠনের মাথায়! দলে এই ধরনের আহাম্মক নেতাদের জন্যই বুথ ও মণ্ডল সংগঠনগুলির এই হাল।’
আবার ফেসবুকে মহিলা মোর্চার পূর্ব বর্ধমান জেলার সভানেত্রী নীলিমা রায়ের আহ্বান, ‘লবিবাজি বন্ধ করুন। অনেক হয়েছে, এ বার ঠিক ভাবে চলুন।’ তবে শুধু জেলাস্তরের নেতা-নেত্রীরাই নন, ফেসবুকে মাঝেমধ্যে প্রাণখুলে আক্ষেপ করছেন দলের রাজ্যস্তরের নেতারাও। তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে ভরাডুবির পর প্রাক্তন সাংসদ অনুপম হাজরা যেমন ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘উপনির্বাচনের ফল সঙ্কেত দিচ্ছে, নতুন-পুরোনো ভেদাভেদ মিটিয়ে সবাইকে কাজে লাগিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত।’
আরএসএস-ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা রন্তিদেব সেনগুপ্তও উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর মুখ খুলে ফেসবুকে লেখেন, ‘অতিরিক্ত আত্মসন্তুষ্টি ও আত্মম্ভরিতাই বিপর্যয়ের কারণ। উপনির্বাচনের ফল সেটাই বলছে।’ কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে নিয়ে এসে কি আদৌ লাভ হচ্ছে বিজেপির? প্রাক্তন সাংসদ অনুপমের ব্যাখ্যা, ‘পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয় প্রকাশ্যে না-আসাই ভালো। কিন্তু জেলাস্তরের কিছু নেতা জেগে ঘুমোন। তাঁদের ঘুম ভাঙানোর জন্য ফেসবুকের দেওয়ালে কড়া নাড়া ছাড়া উপায় থাকে না।’