সিটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এস-সি পাশ করেন সুকুমার। কলেজে থাকতে গড়ে তোলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এর মুখপত্র ছিল ‘৩২II ভাজা’ (সাড়ে বত্রিশ ভাজা)। বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি ‘মন্ডা ক্লাব’ (ইংরেজিতে Monday Club) নামে এক সাহিত্য-আসর প্রতিষ্ঠা করেন। এটিরও মুখপত্র সাড়ে বত্রিশ ভাজা বলে উল্লেখিত হয়েছে। মনে হয়, ‘ননসেন্স ক্লাবে’র মুখপত্রটিই চালু ছিল এবং পরে সেটি ‘মন্ডা ক্লাবে’রও মুখপত্র হিসাবে গণ্য হয়।
সুকুমারের খেয়াল রসাস্রিত লেখা প্রথম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতাতেই বেরিয়েছিল। ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন সুকুমার, ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। ‘ঝালাপালা’তেই রয়েছে তাঁর সেই বিখ্যাত রসসৃষ্টি,
“পণ্ডিত। বটে! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ওই তালতলায় – ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-’ মানে কি ?
পণ্ডিত। ‘আই’ – ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ – গয়ে ওকার গো – গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল – গরুর চক্ষে জল – অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে – কেন কাঁদিতেছে – না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা – ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদোমখানা – গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না – তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে” …
‘ননসেন্স ক্লাবে’র নাটক দেখার জন্য ছেলেবুড়ো সকলেই ভিড় জমাতো। তাঁর বোন পুণ্যলতা লিখেছেন, “বাঁধা স্টেজ নেই, সীন নেই, সাজসজ্জা ও মেকআপ বিশেষ কিছুই নেই, শুধু কথা সুরে ভাবে ভঙ্গিতেই তাদের অভিনয়ের বাহাদুরি ফুটে উঠত, দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত। … হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না। অভিনয় করতে ওরা নিজেরা যেমন আমোদ পেত, তেমনি সবাইকে আমোদে মাতিয়ে তুলত। চারিদিকে উচ্ছ্বসিত হাসির স্রোত বইয়ে দিত। …… ননসেন্স ক্লাবের অভিনয় দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে থাকত।”
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। পরে অবশ্য বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় সেটা হয়ে ওঠেনি। তখন শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন যে তাঁরা বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবেন না। উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। পুণ্যলতা লিখেছেন, “মেজভাই মণি (সুবিনয় রায়) দেশি সুতোর মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারা ব্যাঁকা পেয়ালা পিরিচ খুঁজে পেতে নিয়ে আসত।”
লীলা মজুমদারের ভাষায়, “বাড়িসুদ্ধ সবাই এইসব জিনিস ব্যবহার করত। বড়দাও করত। অবিশ্যি এই নিয়ে একটা গান না লিখেই সে কি করে?”
গানটি ছিল,
“আমরা দেশি পাগলের দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ টিকবে কম, দামটা একটু বেশী
(তাহোক) তাতে দেশেরই মঙ্গল”।
তাঁর আরও একটি লেখা –
“লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি
কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী।”
অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ‘মন্ডা ক্লাবে’র সভ্য ছিলে। এদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ক্লাবের সম্পাদক ছিলেন সুকুমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশিরকুমার দত্ত। সভ্যদের নামের তালিকায় তার নামের সঙ্গে ‘এ.বি.সি.ডি.’ এবং পাশে বন্ধনীতে ‘সম্পাদক’ ছাপা হত।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ক্লাবের তৃতীয় জন্মদিন উপলক্ষে ১৯১৮ সালের ১৮ই আগস্ট ‘মন্ডা-সম্মিলন’ নামে একটি গান রচনা করেছিলেন। সুরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’-এর অনুরূপ। গানটি ছিল –
“মন্ডা-সম্মিলন
(সুর : আমাদের শান্তিনিকেতন)
আমাদের মন্ডা-সম্মিলন।
আরে না – তা’ না, না –
আমাদের Monday সম্মিলন।
আমাদের হল্লারই কুপন।
তার উড়ো চিঠির তাড়া
মোদের ঘোরায় পাড়া পাড়া,
কভু পশুশালে হাসপাতালে আজব আমন্ত্রণ।
( কভু কলেজ-ঘাটে ধাপার মাঠে ভোজের আকর্ষণ )।” ইত্যাদি।
একবার এই সম্মিলনীর আয়-ব্যয়ের একটি হিসেব ছাপা হয়েছে। হিসাবের শেষে দেখানো হয়েছে নগদ চোদ্দ আনা তখনও মজুদ আছে। সম্পাদক সেই হিসেবের নীচে লিখেছেন,
“আমার হাতে অর্থাৎ বাক্সে এই সোয়া চৌদ্দ আনা পয়সা মজুদ আছে। সভ্যেরা যদি অসভ্যের মতো খাই-খাই না করিয়া চা-বিস্কুটে খুসী থাকিতেন – যাক সে কথা বলিয়া কোন লাভ নাই।
শ্রীশিশিরকুমার দত্তদাস
অনাহারী সম্পাদক।”
এই বিবরণীতে একটি বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল। সেটি হল,
“আমাদের অভূতপূর্ব সম্পাদক সংসার বিমুখ ও উদাসীন হইয়া লোটাকম্বল ও চা-বিস্কুট সহযোগে বাণপ্রস্থ অবলম্বনের সংকল্প জানাইয়া, ক্লাবের মায়া কাটাইবার উদ্যোগ করিয়াছেন। তাঁহাকে উক্ত সংকল্প হইতে নিরস্ত করিবার জন্য কয়েকটি বলিষ্ঠ ভক্তের প্রয়োজন। ভক্তসভ্যগণ সত্ত্বর হউন।”
কিন্তু সংসার তিনি ত্যাগ করেন নি। কারণ, ক্লাবের যেমন তাঁকে ছাড়া চলত না, তেমনি তাঁরও ক্লাব ছাড়া চলত না। এ কারণেই একটি ‘প্রতিবাদ সভা’র চিঠি পাওয়া গিয়েছে, সেটি হ’ল –
“সম্প্রতি ক্লাবের সর্ব্বজনস্বীকৃত সম্পাদকরূপে আমি ‘অধিকারী’ উপাধি গ্রহণ করিয়াছি। ইহাতে কোন কোন ঈর্ষাপরায়ণ ‘সভ্য’ অসঙ্গতভাবে আপত্তি করিতেছেন। কালিদাসবাবু আপত্তি করিতে চান করুন, কিন্তু আমি স্বোপার্জ্জিত উপাধি ছাড়িব না।
এইরূপ অন্যায় আপত্তির বিশেষ প্রতিবাদ বাঞ্ছনীয়। অনেক হিসাব করিয়া দেখিলাম, আগামী মঙ্গলবার ২১শে আগষ্ট, বাংলা তারিখ জানি না, আমাদের ক্লাবের জন্মদিন, অর্থাৎ প্রায় জন্মদিন। ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় ১০০নং গড়পার রোড, অর্থাৎ কালাবোবা ইস্কুলের পশ্চাতে, সুকুমারবাবু নামক ক্লাবের একজন আদিম ও প্রাচীন সভ্যের বাড়ীতে সভার আয়োজন হইয়াছে। বক্তা প্রায় সকলে, সভাপতি আপনি, বিষয় গম্ভীর – সুতরাং খুব জমিবার সম্ভাবনা।
আসিবার সময় একখানা সেকেন্ডক্লাস গাড়ী সঙ্গে আনিবেন – আমায় ফিরিবার পথে নামাইয়া দিতে হইবে। খাওয়া গুরুতর হইবার আশঙ্কা আছে।
ইতি
শশব্যস্ত –
শ্রীশিশিরকুমার দত্তাধিকারী
সুযোগ্য সম্পাদক।”
ভোজের ব্যবস্থা ছাড়া যে সাহিত্য আলোচনা নিষ্ফল, সেটা বোধ হয় সব সভ্যই মেনে নিয়েছিলেন। অপর একটি নিমন্ত্রণের চিঠি ছিল এই রকম –
“আঃ ! আবার খাওয়া !!
এইত সেদিন সবাইকে বুঝিয়ে বললুম যে আর ‘খাই খাই’ ক’রো না – এর মধ্যে সুনীতিবাবু খাওয়াতে চাচ্ছেন। আমার হাতে কতকগুলো টাকা গছিয়ে দিয়ে এখন বলছেন, না খাওয়ালে জংলিবাবুকে দিয়ে মোকদ্দমা করাবেন। আমি হাতে পায়ে ধরে নিষেধ করলুম, তা তিনি কিছুতেই শুনলেন না, উলটে আমায় তেড়ে মারতে আসলেন। দেখুন দেখি কি অন্যায়! তা আপনারা যখন উপদেশমত চলবেন না, কাজেই অগত্যা সুকুমারবাবুকে বলে কয়ে এই ব্যবস্থা করে এসেছি যে তাঁর বাড়ীতে আগামী মঙ্গলবার (৩০শে জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার সময় আপনি সুস্থদেহে হাজির হবেন। সুনীতিবাবুর ভোজের পাত সেখানেই পড়বে। এখন খুসী হলেন ত?
ত্যক্তবিরক্ত
শ্রীসম্পাদক।”
প্রায় সব নিমন্ত্রণই করা হত পদ্য লিখে। আরও কয়েকটি নিমন্ত্রণ পত্র এখানে দিলাম –
(১)
“আসছে কাল, শনিবার
অপরাহ্ণ সাড়ে চার,
আসিয়া মোদের বাড়ি,
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলুপুষু খুশি হবে।”
(সুকুমারের স্ত্রী সুপ্রভার ডাক নাম ছিল টুলু এবং ভাই সুবিনয়ের স্ত্রী ছিলেন পুষ্পলতা। টুলু এবং পুষু বলতে সম্ভবত এদেরই বোঝানো হয়েছে।)
(২)
“রবিবার ১০ই চৈত্র
প্রফেসর সুরেন মৈত্র
আবাহন করেন সবে
শিবপুরে আপন ভবে
মহাশয় সময় বুঝে
চাঁদপালে জাহাজ খুঁজে
চড়িবেন যেমন রীতি
নিবেদন সাদর ইতি।”
(৩)
“শনিবার ১৭ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতী মেলা।
অতএব ঘড়ি ধ’রে-
সাবকাশ হয়ে,
আসিবেন দয়া করে
হাসি মুখ লয়ে।
সরবৎ, সদালাপ,
সঙ্গীত ভীতি –
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ – ইতি।”
(এটি ‘সরবৎ সম্মিলন’-এর নিমন্ত্রণ, কার লেখা জানা নেই। সুকুমারেরও হতে পারে)।
একদিন সম্পাদক কোথায় ডুব দিলেন জানা নেই। ‘সভ্যদের মাথায় তো প্রায় বজ্রাঘাত হবার জোগাড়। ক্লাবটিও টলমল করে উঠলো’। সে সময়ে সুকুমার রায় একটি চিঠি লিখে সেটি বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক না থাকায় চিঠির চারদিকে শোকচিহ্নস্বরূপ কালো বর্ডার ছিল। এই পদ্যটি বহুল প্রচলিত এবং অনেকেই পড়েছেন,
“সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি ত যায় যায়।
তাই বলি, সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধুলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি যত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে।
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।”
কিন্তু ইতিমধ্যেই সম্পাদকের খোঁজ পাওয়া গেল। কাজেই এর পরের চিঠি,
“শুভ সংবাদ, সম্পাদক জীবিত আছেন। আগামী সোমবার ২৫নং সুকিয়া ষ্ট্রীটে ৬II ঘটিকায় তাঁহার শ্রীমুখচন্দ্র দর্শনার্থ ভক্ত সমাগম হইবে।”
এবার সম্পাদক ফিরে এসে নিজেই পদ্যে চিঠি লিখলেন,
“আমি অর্থাৎ সেক্রেটারি
মাস তিনেক কলকেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে-
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে !!
বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়-
আমার প্রাণে এসব কি সয় ?
এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,-
আমি এবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।–
শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার ‘বিবেকানন্দ’,
মঙ্গলবার আমার বাসায়-
(আর থেকো না ভোজের আশায়)।”
একটি বিষয় পরিষ্কার যে মজলিশি মেজাজে এধরণের সম্মেলন প্রায়ই হোত, এবং খুব ঘন ঘনই হোত। আলোচ্য প্রসঙ্গেই সুকুমারের ‘সম্পাদকের দশা’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। সেটি আর এখানে উধৃত করছি না। এটি সুকুমারের মৃত্যুর পর সুবিনয়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশে’র ১৩৩১ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু শেষের কিছু অংশ বাদ দিয়ে। কবিতার শেষে সুকুমারের নিজের কিছু মন্তব্য ছিল। এই অংশটি হয়তো অনায়াসলভ্য নাও হতে পারে। সেজন্য এই বর্জিত অংশটি মন্তব্য সহ তুলে দেওয়া হল –
“হে পাঠক জ্ঞানবান, কর সবে অবধান।
উপদেশ লভ এই হয়ে অতি সাবধান।।
সম্পাদকী কাজ পাওয়া-সৌভাগ্য সে অতিশয়।
কিন্তু সেটা নহে ঠিক আদ্যোপান্ত মধুময়।।
তোমাদের সম্পাদক-সেও ত মানুষ বটে।
বৃথা যেন তার পরে অত্যাচার নাহি ঘটে।।
যদি এ পত্রিকা তব নাহি হয় মনোমত।
কিম্বা যদি “৩২II” বন্ধ থাকে মাসকত।।
কিম্বা যদি অন্যরূপে দোষত্রুটি ঘটে তবু।
সম্পাদকে গালি দেওয়া উচিত না হয় কভু।।
লেখকবৃন্দের প্রতি আছে এক নিবেদন।
না লিখেন কভু যেন গুরুপাক বিবরণ।।
পেচকের মত সবে হাঁড়িমুখ নিরবধি।
গম্ভীর গম্ভীরতম প্রবন্ধ লিখেন যদি।।
নির্ঘাৎ জানিহ তবে, ধ্রুব সত্য অতি খাঁটি।
নিস্ফূর্তি নির্জীব সভা একদম হবে মাটি।।
অতএব কহি শুন ছাড় শুষ্ক নীরবতা।
পেট ভরে হাস আর শুনাও হাসির কথা।।
নচেৎ এ সম্পাদক হতশ্বাস হয়ে শেষে।
একেবারে দিবে ছুট জনহীন দূর দেশে ।।”
“উৎসাহের চোটে পদ্য লিখিয়া ফেলিলাম-লেখকগণ অতি সূক্ষ্মভাবে কবিতার ভাষাগত বা ছন্দোগত দোষ গুণ বিচার না করিয়া ইহার মর্মগ্রহণ করিতে সচেষ্ট হইলে সম্পাদক বেচারা বাধিত হইবে।”
বেশ কয়েকটি কবিতা এখানে উধৃত হল, কারণ কবিতাগুলি একসঙ্গে পাওয়াটা কষ্টসাধ্য।
সুকুমার রায়ের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তাঁরা এক অর্থে সৌভাগ্যবান, কারণ জীবনে বন্ধুর চলার পথকে তিনি মসৃণ করে দিয়েছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যরসের সঞ্জীবন ধারায়। সে সময়ের বহু মানুষের স্মৃতিতে বিধৃত রয়েছে তার রসসৃষ্টির টুকরো টুকরো উদাহরণ। লেখক কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “সেদিন তাঁর এক লেখার-খাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে, ‘নোটিস, এই খাতা হারাইলে কাহারও নিস্তার নাই, আদায় না করিয়া ছাড়িব না – না পাইলে গালি দিব’।”
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সুগায়িকা ভাগ্নি সাহানা দেবী (বসু) লিখেছেন, “১৯১৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন) রসা রোডের বাড়িতে আমার বিবাহ হয় ডাঃ বিজয়কুমার বসুর সঙ্গে। মনে আছে বিয়ের পরের দিন মামাবাড়ির সুবৃহৎ বৈঠকখানার ঘরে আমাদের পিসতুতো ভগ্নীপতি তাতাবাবু (সুকুমার রায়) কি রকম জমিয়েছিলেন তাঁর ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’র পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি করে এবং তাঁরই অন্যান্য লেখা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে। এখনও কানে বাজে সেই অসাধারণ একেবারে নিজস্ব ঢঙে এই লাইনগুলি তাঁর পড়া –
“কাছে এসে ঘেঁষে ঘেঁষে
হেসে হেসে কেশে কেশে
এত ভালো বেসে বেসে
টাকা মেরে পালালি শেষে-”
ঘরভর্তি লোক সেদিন কি হাসিটাই হেসেছিলেন। কি অদ্ভুত ঢঙই যে ছিল তাতাবাবুর এসব পড়ার। ওরকম আর শুনিনি। অমন প্রতিভা আর হল না।”
বিমলাংশুপ্রকাশ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, একবার সুকুমার রায়কে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সুকুমার তুমি যে লিখেছ, ‘ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগণে ধোঁয়া তিন ভাবে ডিসপেপসিয়া ঢেঁকুর উঠবে চোঁয়া’- আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছ কি?”
সুকুমার ভাষা, শব্দ, এদের ব্যবহার ও প্রকৃত অর্থ নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন তার সাক্ষাৎ মেলে তাঁর ‘ভাষার অত্যাচার’ নামক প্রবন্ধে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’র ১৩২২-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। অপর একটি রচনা শব্দ-ঝঙ্কার সমৃদ্ধ অনুপ্রাসকেন্দ্রিক কবিতা ‘বর্ণমালাতত্ত্ব’ পড়লে এ ধরণের রচনায় সুকুমারের অনায়াস এবং অসাধারণ দক্ষতা সহজেই চোখে পড়ে। কয়েকটি পংক্তি –
“অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি
হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি ।
কহে, কই কে গো, কোথায় কবে গো, কেন বা কাহারে ডাকি?
কহে কহ-কহ, কেন অহরহ, কালের কবলে থাকি?
কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে,
কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে।”
১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যান, সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে করে গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদও নিয়ে গিয়েছিলেন। লন্ডনে তখন রবীন্দ্রভক্তদের মধ্যে ছিলেন রামানন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ, আনন্দমোহন বসুর কনিষ্ঠ পুত্র অরবিন্দ, কালীমোহন ঘোষ, প্রশান্ত মহলানবীশ ও সুকুমার রায়। বিলেতে সুকুমারের রচিত এবং একটি সভায় পঠিত The spirit of Rabindranath Tagore নামক একটি রচনার মাধ্যমে কবি প্রাথমিক ভাবে বিদ্বজ্জনের কাছে পরিচিত হন একথার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। রচনাটি Quest পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সুকুমার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯১২ সালের ১৯শে জুন লন্ডনে উইলিয়ম পিয়ার্সনের (পরে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক) বাড়িতে এক ঘরোয়া বৈঠকে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে সেগুলি পাঠ করেন। সুকুমার তার ছোট বোন পুণ্যলতাকে লিখেছেন, “পরশু দিন পিয়ার্সন তার বাড়িতে বেঙ্গলি লিটারেচার সম্বন্ধে একটি পেপার পড়বার নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি মিঃ অ্যান্ড মিসেস আর্নল্ড, মিঃ অ্যান্ড মিসেস রটেনস্টাইন, ড: পি. সি. রায় প্রভৃতি অনেকে। তাছাড়া কয়েকজন অচেনা সাহেব মেম উপস্থিত। শুধু তাই নয় ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে আছেন। বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। যা হোক, চোখ কান বুঁজে পড়েছিলাম। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে বইটই এনে ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করতে হয়েছিল। তাছাড়া রবি বাবুর কয়েকটি কবিতা – সুদূর, পরশপাথর, সন্ধ্যা, কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ ইত্যাদি অনুবাদ করেছিলাম। মিঃ ক্র্যানমার বীং, নর্থব্রুক সোসাইটির সেক্রেটারি, আর উইজডম অব দি ইস্ট সিরিজের এডিটর খুব খুশি। আমাদের ধরেছেন অনুবাদ করতে, তিনি পাবলিশ করবেন।”
মিঃ বিং (Crammer Byng) অবশ্য সে অনুবাদ পরে আর ছাপেন নি। এই সমাবেশের পরের দিন রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কিন্তু সুকুমারের কবিতা পাঠের কোন উল্লেখ নেই। রচনার কলেবর বৃদ্ধি করে লাভ নেই। এখানে শুধু ‘সুদূর’ কবিতাটির সুকুমার এবং রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদের কয়েক পংক্তি তুলে দিই।
মূল কবিতাটি হ’ল,
“আমি চঞ্চল হে
আমি সুদূরের পিয়াসি
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে
ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার পিয়াসী।
আমি সুদূরের পিয়াসি
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। ……”
সুকুমারের অনুবাদটি ছিল –
“I am restless
I am athirst for the great Beyond
Sitting at my window,
I listen for its tread upon the air, as the day weras on.
My life goes out in longing
For the thrill of its touch,
I am athirst for the great Beyond !
O Beyond! Vast Beyond!
How passionate comes thy clarion call. …….”
রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদটি ছিল –
“ I am restless. I am athirst for far-away things.
My soul goes out in a longing to touch the skirt of the dim distance.
O Great Beyond. O the keen call of thy flute !”
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট। সুকুমারের অনুবাদ সবটাই মূলানুগ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তাঁর স্বরচিত কবিতা নিজেই অনুবাদ করছেন, তখন অনেক সময়েই তিনি শুধু ভাবটি গ্রহণ করেছেন, আবার অনেক কিছু বাহুল্য মনে করে বর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা সুকুমারের ছিল না। তবে ‘ব্যাকুল বাঁশরি’র অনুবাদ সুকুমার করেছিলেন ‘passionate clarion call’. এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘keen call of the flute’-এ ভাবের দ্যোতনা অনেক বেশি। ‘তার পরশ পাবার প্রয়াসী’ সুকুমারের অনুবাদে হয়েছে ‘for the thrill of its touch’; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতে সেটা হয়েছে ‘to touch the skirt of the dim distance’। এটা মূল রচনার বাইরে বেরিয়ে এসে কবি করেছেন, কিন্তু অন্য কেউ ত সেটা করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ কি তবে সুকুমারের অনুবাদ গ্রহণ করেন নি। হয় ত তাই, স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে পরে কবি তার নিজের লেখা নিজেই অনুবাদ করেছেন।
সুকুমারের ‘আবোল তাবোল’ কবিতার শেষের দু’লাইন ছিল –“ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর/গানের পালা সাঙ্গ মোর”। এটি বাস্তবায়িত করেই সুকুমার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৯২১ সালেই তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা তখনও অধরাই ছিল। শেষের আড়াই বছর তার অধিকাংশ সময়েই কেটেছে রোগশয্যায়। পুত্র সত্যজিৎ লিখেছেন –“… রুগ্ন অবস্থাতেও তাঁর কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতে হয়। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এগুলি পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিল, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠে নি।”
সুকুমারের মৃত্যু নেই। তাঁর লেখনী থেকেই নিঃসৃত হয়েছে, “দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ”। এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই প্রাণোচ্ছল, কর্মচঞ্চল, আনন্দময় মানুষটি তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্য কীর্তির মধ্য দিয়ে চির ভাস্বর হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করবেন।
(তথ্যসূত্র :
১- যখন ছোট ছিলাম, সত্যজিৎ রায়।
২- পুণ্যস্মৃতি, সীতা দেবী।
৩- শতায়ু সুকুমার, সম্পাদনা শিশিরকুমার দাশ।
৪- একত্রে রবীন্দ্রনাথ, অমিতাভ চৌধুরী।
৫- ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বারিদবরণ ঘোষ।
৬- স্মৃতির খেয়া, সাহানা দেবী।
৭- পাকদন্ডী, লীলা মজুমদার।
৮- ছেলেবেলার দিনগুলি, পুণ্যলতা চক্রবর্তী।
৯- উপেন্দ্রকিশোর (প্রবন্ধ), প্রসাদরঞ্জন রায়।
১০- ব্যক্তি সুকুমার, স্মৃতির আলোয় (প্রবন্ধ), শ্যামলী দেবী এবং শুভাশিস ঘোষের একটি ছোট রচনা।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে নভেম্বর ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত