(ছবিতে – ১৮৬০ এর দশকে অজ্ঞাতনামা চিত্রকরের দ্বারা পাটনাই চিত্রশৈলী তে অঙ্কিত একটি কালীপূজার দৃশ্যের তৈলচিত্রের ফটোগ্রাফিক প্রিন্ট।
ছবি সৌজন্যে – ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম।)
কলকাতার নানা কালীমন্দিরে ও ধনাঢ্য বাবুদের বাড়িতে কালীপূজার নানা সংবাদ পাওয়া যায় পুরনো সংবাদপত্রের পাতায়। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ১৮২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে পশুবলির এক অদ্ভুত সংবাদ দেখা যায়,
“মোকাম কলিকাতার ঠনঠনিয়া বাজারের উত্তরে কালীবাটীর নিজ পূর্ব তেমাথা পথে ১৪ মাঘ রবিবার ২৬ জানুয়ারি গ্রহণ দিবসে রাত্রিকালে ১ রাঙ্গা বাছুর ও ১ বানর ও ১ কালো বিড়াল ও ১ শৃগাল ও ১ শূকর এই পাঁচ পশু কাটিয়াছে। পরদিন প্রাতঃকালে সকলে দেখিল যে এই পাঁচ জন্তুর শরীর মাত্র আছে কিন্তু মুন্ড নাই, ইহাতে অনুমান হয় যে মুন্ড কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার কারণ জানা যায় নাই।” (সমাচার দর্পণ, ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৮২৩ সাল)
বোঝা যায় যে, এই সব পশুবধ যে কালীপূজার বলির সঙ্গে সম্পর্কিত, এ কথা পত্রিকাটি জোর দিয়ে বলতে পারেনি, কারণ সচরাচর কালীপূজায় এই সব পশু বলি দেওয়া হয় না। হতেও পারে যে, এই বলি ছিল ঐ কালীপূজার কোনো গুপ্ত ক্রিয়াচারের সঙ্গে জড়িত।
১৮২২ সালে কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত কালীমন্দির বিষয়ে একটি খবর দেখা যাচ্ছে এই কাগজটিতেই। কালীঘাটে রাজা গোপীমোহন ঠাকুর পূজো দিতে গিয়ে যে দানধ্যান করেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ‘সমাচার দর্পণ’ লেখে যে রাজা নানাবিধ গহনা,
“জরি ও পট্টবস্ত্রাদি ও নৈবেদ্যাদি ও পূজোপকরণেতে নাটমন্দির পূর্ণ তদুপযুক্ত দক্ষিণা ও শাল ও প্রণামী ও তত্রস্থ অধিকারীবর্গ ও স্বস্তয়নকারক ব্রাহ্মণ ও তাবৎ বাঙ্গালীয়দিগকে বহু মুদ্রা প্রদানপূর্বক সন্তুষ্ট করিয়াছেন। এ বিষয়েতে কলিকাতার ও জেলা হওয়ালী শহরের পুলিশের দারোগা প্রভৃতি নিযুক্ত থাকিয়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইয়াছে…।” (সমাচার দর্পণ, ১৬ই ফেব্রুয়ারি,১৮২২ সাল)
এর কাছাকাছি সময়েই কালীঘাট মন্দিরে কালীপূজা-সংক্রান্ত আর একটি খবর দেখা যেতে পারে এই পত্রিকাটি থেকেই,
“এই কালীঘাটে এক অবাঙ্গালী আশ্চর্যজনক ঘটনার সৃষ্টি করে। সেই ব্যক্তি শ্রীশ্রীকালীঠাকুরানীর সম্মুখে আপন জিহ্বা ছূরিকা দ্বারা ছেদন পূর্বক বলিদান করিল, তাহাতে রক্ত নির্গত হইয়া ভূমি পর্যন্ত ভূপতিত হইল এবং সেই ব্যক্তি রক্তাক্ত কলেবর হইয়া একেবারে মূর্ছাপথ হইল।”
এই কাজকে কিছুটা যেন বাহবা দেবার সুরেই পত্রিকাটি মন্তব্য করে,
“এ ব্যক্তির অসমসাহসী কর্ম দেখিয়া ও শ্রবণ করিয়া যাঁহারা কনিষ্ঠাঙ্গুলির এক দেশ ছেদনপূর্বক ভগবতীকে কিঞ্চিৎ রক্ত দর্শন করাইয়াছিলেন বা করাইবেন তাঁহারা অবাক হইয়াছেন ও হইবেন।” (সমাচার দর্পণ, ২১শে এপ্রিল, ১৮২৭ সাল)
“কলিকাতার মধ্যে এবং চতুর্দিকে শ্যামাপর্ব উত্তমরূপে সম্পন্ন হইয়াছে”, এই সংবাদ জানিয়ে ‘সম্বাদভাস্কর’ কাগজটি একদা সখেদে লিখেছিল যে, কলকাতার সব প্রধান ধনীদের বাড়িতেই শ্যামাপূজা হয় না, যারা পূজা করেন, তারাও সমারোহ না করে নিয়মরক্ষা করেন। এই মন্তব্য করে পত্রিকাটি অতীতের কিছু গৃহস্থবাড়ির কালীপূজার আড়ম্বরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে লেখে,
“কম্বোলিয়াটোলানিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র মৈত্রমহাশয় শ্যামাপূজায় সমারোহ করিয়াছিলেন, তাঁহার বাটীতে দান, ভোজন ও নৃত্যগীতাদির বিলক্ষণ আমোদ হইয়াছিল এবং বাগবাজার নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামাচরণ মিত্র মহাশয়ও শ্যামাপূজায় ব্যয় করিয়াছেন। মিত্রবাবুদিগের বাড়ির শ্যামাপূজা স্মরণ হইলে কে না দুঃখ করিবেন, তাঁহারদিগের গুরু ভট্টাচার্যেরা শ্যামাপূজার ধনে ধনী হইয়াছিলেন। মিত্রবাবুরা প্রতি বৎসর শ্যামাপূজায় ভগবতীর আপাদমস্তক স্বর্ণমন্ডিত করিতেন আর তৈজস বস্ত্রাদি কত দিতেন তাহার সংখ্যা ছিল না। চারি পাঁচ মণ তন্ডুল না হইলে এক একটি নৈবেদ্য হইত না, নৈবেদ্যের পশ্চাদভাগে মনুষ্য লুক্কায়িত হইয়া থাকিতে পারিত। এক একটা সন্দেশের পরিমাণ দশ সেরের ন্যূন ছিল না, অর্দ্ধ মোন পরিমিত এক এক সন্দেশ কেবল ঐ বাড়িতেই হইত। মিত্রবাবুদিগের সে সে পূজার সহিত তুলনা করিলে শ্যামাচরণবাবুর এপূজার ব্যয় তাহার একাংশও বলা যায় না। তথাচ শ্যামাচরণ পরায়ণ শ্যামাচরণ শ্যামাচরণ পূজায় যাহা করিয়াছেন কলিকাতা নগরে অন্যত্র কুত্রাপি এমত হয় নাই।……” (সম্বাদভাস্কর, ১লা নভেম্বর, ১৮৫৬ সাল)
পুজার উপাচার ইত্যাদির জন্য খরচের আতিশয্য ও “দান ভোজন ও নৃত্যগীতাদির বিলক্ষণ আমোদে” ‘সম্বাদভাস্কর’-এর কোনো আপত্তি না থাকলেও কাগজটিকে বিসর্জনের সময় পথে পথে প্রতিমা নিয়ে ঘোরানোর কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যায়! এই একই প্রতিবেদনে এই কাজকে শাস্ত্রবিরুদ্ধ অনাচার হিসেবে অভিযুক্ত করে হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীদের নানা ভন্ডামি ও ভেকধারণ সম্পর্কে দীর্ঘ উপদেশ বর্ষণ করা হয়। “অনেকে বিসর্জন দিন রাত্রি সাত আট ঘণ্টা পর্যন্ত…… আলো করিয়া পথে পথে প্রতিমা দেখাইয়া বেড়ান”, এই কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছিল,
“…..এদেশের অধিকাংশ লোক হাটেবাটে ধর্মধ্বজিত্বের ঠাট দেখাইতে ভালোবাসেন, শাস্ত্রে লেখেন, শ্যামাসাধন অতি গুপ্ত সাধন, রাত্রিতেই পূজা, রাত্রিতেই বিসর্জন, যাহাকে রাত্রিতেই আবাহন করিয়া আনিলেন, যেভাবেই হোক, ইষ্টভাব দেখাইয়া অর্চনা করিলেন এবং সেই রাত্রিতেই মন্ত্রযোগে বিদায় দিলেন, যদি তন্ত্র-মন্ত্র সত্য বহন করেন, তবে তন্ত্রমতেই চলিতে হয়, তাঁহাকে পরদিন চন্ডীমন্ডপে উপবাসে রাখেন, একবিন্দু গঙ্গাজল, একটি বিল্বফল দিয়াও সম্বর্ধনা করেন না, রজনীতে সেই উপবাসিনী উলঙ্গিনী ঠাট হাটেবাটে বেশ্যাদিগকে দেখাইয়া বেড়ান, যাঁহাকে মাতা বলেন তাঁহার এই অপমান করেন ইহাতে কি তিনি সন্তুষ্ট হন?……ভগবতীর এই দুর্গতি কি ধর্মকর্ম বলা যায়? তন্ত্রশাস্ত্রের কোন গ্রন্থে ইহার প্রমাণ আছে?…” ইত্যাদি।
পথে পথে প্রতিমাকে ঘোরানো নিয়ে এই পত্রিকাটির আপত্তির আর একটি কারণ ছিল এই যে, হিন্দুরা যাদের অস্পৃশ্য জাতি মনে করেন, তারা “পথে পথে প্রতিমা সকলকে স্পর্শ করিয়া যাইতেছেন”!
কালী আরাধনায় বলিসংক্রান্ত গুপ্তপূজার একটি বিবরণের উল্লেখ করা যায় ১৮২২ সালের সংবাদপত্রের পাতা থেকে। তারকেশ্বরের কাছে শিববাটি কালিকাপুর গ্রামের অদূরে এক সিদ্ধেশ্বরী কালীপ্রতিমা সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদটির কিছুটা এ-রকম,
“সম্প্রতি ৯ মাঘ সোমবার রটন্তী পূজার রাত্রিতে ওই সিদ্ধেশ্বরীর গুপ্তরূপে পূজা হইয়াছে। সে পূজা কে করিল তাহা স্থির হয় নাই। কিন্তু পর দিবস প্রাতঃকালে সেই সিদ্ধেশ্বরীর সেবাকারী ব্রাহ্মণ সেখানে গিয়া পূজার আয়োজন দেখিয়া চমৎকৃত হইল। চারি জোড়া পটবস্ত্র ও চারি বর্ণের চারিখান পট্ট শাড়ি বস্ত্র আর ঘড়া প্রভৃতি এক প্রস্থ তৈজসপত্র এবং প্রচুর উপকরণযুক্ত নৈবেদ্য ও আট প্রমাণ পিতলের বাটিতে আট বাটি রক্ত আছে। কিন্তু কী বলিদান করিয়াছিল তাহার নিদর্শন কিছু নাই। কেহ কেহ অনুমান করে যে নরবলি হইয়া থাকিবেক। এবং নগদ ৫ পাঁচটি টাকা রাখিয়াছে ও লিখিয়া রাখিয়াছে যে এই তাবৎ সামগ্রী ও পাঁচ টাকা দক্ষিণা সেবাকারী ব্রাহ্মণের কারণ রাখা গেল।” (‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)
“এই কলিকাতা কালিকাক্ষেত্র, কাহিনী ইহার সবার শ্রুত”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার এই কথাগুলো কিন্তু ফেলনা নয়। কলকাতার সঙ্গে কালীর সম্পর্ক এমনকি দুর্গাঠাকুরের চেয়েও বেশি পুরোনো। কলকাতা শহর গড়ে ওঠার আগেই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষরা এসে ভিড় করে পুজো দিতেন কালীঘাটের মন্দিরে। কেউ কেউ তো ‘কলিকাতা’ নামের পিছনেও ‘কালী’ শব্দটির খোঁজ পেয়েছেন। সে হয়তো কষ্ট-কল্পনা, কিন্তু তা বলে কালীপুজোর সঙ্গে এই শহরের সম্পর্ক খুঁজতে কল্পনাবিলাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই শহরজোড়া একাধিক বিখ্যাত কালীমন্দির। কালীঘাটের মন্দির ছাড়াও চিৎপুরের ডাকাতে কালী, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী, ফিরিঙ্গি কালী বা দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী। এইসব বিখ্যাত কালীমন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে কত রোমাঞ্চকর ইতিহাস। নেহাত ভক্তিরসের সামগ্রী নয় সেইসব গল্প। আর, কলকাতার কালীপুজো বলতে এই বিখ্যাত মন্দিরের বাইরেও হাজারো ইতিহাস। রাজ-রাজরা, ডাকাত, জমিদার, লালমুখো সাহেব, বড়োলোক সবাই সমাপতিত সেখানে।
কলকাতার সবচাইতে বিখ্যাত কালীমন্দির কালীঘাটের পুজো নিয়েই গল্পের শেষ নেই। অনেকের মতে, এই কালীই কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। হিন্দু রাজা-রাজরা-জমিদার তো বটেই এই মন্দিরের ‘জাগ্রত’ দেবীর কাছে পুজো দিতে আসতেন সাহেবরাও। পাদরি ওয়ার্ড লিখে গেছেন, পালকি করে মন্দিরে এসে সাহেব-মেমদের হাজার-হাজার টাকার পুজো দিয়ে যাওয়ার কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক লালমুখো সাহেব-কর্তা নাকি মামলা জেতার আগে মানত করে গেছিলেন মন্দিরে। মামলা জেতার পর পুজো দিয়েছিলেন হাজার তিনেক টাকার। সেইযুগে টাকাটার পরিমাণ নেহাত কম নয়।
পাঞ্জাব আর বার্মা দখল করল ব্রিটিশরা। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কালীঘাটে ঘটা করে পুজো দেওয়া হল ষোড়শোপচারে। শুধু ইংরেজরাই নয়, ওয়ার্ড লিখেছেন প্রতি মাসে প্রায় পাঁচশো জন মুসলমানও নাকি পুজো দিয়ে যেতেন এই মন্দিরে।
আর, এই মন্দিরে রাজাদের দানধ্যান-ব্যয়ের কথা বললে তো শেষই হবে না। রাজা নবকৃষ্ণ ১৭৬৫ সালে সোনার মুণ্ডমালা দান করলেন কালীপ্রতিমাকে। সঙ্গে লক্ষাধিক টাকা। শোভাবাজারের রাজা গোপীমোহন দেব এমনই ধূমধাম করে পুজো দিতে এলেন যে তা দেখতে ভিড় হামলে পড়ল। ভিড় সামলাতে গিয়ে পুলিশ লাঠি চালিয়েও কুল পায় না শেষে। খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল গড়ে দিয়েছিলেন দেবীর চারটি রুপোর হাত। সেই হাতকেই পরে সোনায় বদলে দেন কালীচরণ মল্লিক। সোনার জিভটি পাইকপারার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহর উপহার। পাতিয়ালার মহারাজ দান করেছিলেন দেবীর গলার মুণ্ডমালা আর দেবীমূর্তির ওপরের ছাতাটি দান করেছিলেন নেপালের প্রধান সেনাপতি জঙ বাহাদুর।
দেবীর অঙ্গসজ্জার পাশাপাশি এই মন্দিরের গড়ে ওঠার, সেজে ওঠারও বিচিত্র ইতিহাস। পাঞ্জাবি সৈনিক হুজুরিমল্লের শেষ ইচ্ছেনুযায়ী মন্দিরের সামনের আদি গঙ্গার ঘাটটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল কোম্পানি সরকার। বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল বড়িশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরীদের উদ্যোগে। আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায় ১৮৩৫ সালে গড়ে দিয়েছিলেন নাটমন্দির। তথ্য গুনে শেষ করা যাবে না।
শুধু কালীঘাট নয়, কলকাতার অন্যান্য সাবেক কালীমন্দিরগুলোর ইতিহাসও কম রঙিন নয়। ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামে প্রচলিত ছিল দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। উচ্চতায় নাকি মনুমেন্টের থেকেও উঁচু ছিল এই মন্দির। ভূমিকম্পে, ঝড়ে একাধিকবার ভেঙেছে, নির্মিতও হয়েছে নতুন করে। আর, ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮৫৫ সালের ৩১ মে-তে লিখেছিল, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠার দিন “কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক্, পাণিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন হইয়া উঠে। এইমত জনরব যে পাঁচশত মণ সন্দেশ লাগে।”
কলকাতায় নানা বড়োলোক-অভিজাত মানুষদের বাড়ির কালীপুজোয় জাঁক-জমকের পাশাপাশি অবধারিত ছিল পশুবলি। খিদিরপুরের ন্যায়নারায়ণ ঘোষালের পুজোয় বা শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির কালীপূজার টাকার পাশাপাশি মদ্য ও রক্তেরও বন্যা বইত। ওয়ার্ডের লেখায় কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির পুজোর যে বিবরণ আছে, তা ভয়াবহ। নর্দমা লাল হয়ে যেত পশুবলির রক্তে। মায়ের পুজোর ভোগ হিসেবে থাকত মদ। সেই মদ পুজোর শেষে পান করতেন বাবু স্বয়ং। শুধু পশুবলিই নয়, নরবলির ঘটনাও শোনা যেত তখন কলকাতায়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা তখন জঙ্গলাকীর্ণ এক শহর। এখানে-সেখানে ডাকাতদের ডেরা। চিতু ডাকাত-প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরে ১৭৭৮ সালের এক অমাবস্যায় নাকি নরবলি হয়েছিল। কালীঘাটেও নাকি নরবলি দেওয়া হয়েছিল একবার। ডঃ ডাফ লিখেছেন, এই নরবলির ঘটনায় কোম্পানির শাসকরা ফাঁসিতেও ঝুলিয়েছিলেন কয়েকজনকে।
সেদিনের কলকাতা শহর আজকের তিলোত্তমা মহানগরী নয়। তার কালীপুজোর ধরণেও তাই ভক্তিরসের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যায় বীভৎসরস। পশুবলিকে ঘিরে রাজা-বাবুদের উদ্দামতার বিবরণ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং, এরই পাশাপাশি মিশে থাকে বাবু-জমিদারদের আড়ম্বরের কথাও। কালীপুজোর রাতে কারণবারি তো ‘প্রসাদ’। তার নেশা সাত্ত্বিক নেশা। সেই ‘কারণবারি’ হোক না বিলিতি। ক্ষতি কী? মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, শিমলার বসুবাড়ির বিখ্যাত কালীপুজোয় ততোধিক বিখ্যাত মদ্যপানের কথা। গৃহস্থ-ভক্ত সবাই মিলে মাটির গামলায় কারণবারি নিয়ে ঘোল হয়ে ঘিরে বসতেন। তারপর স্ট্র থুড়ি নল দিয়ে টানতেন সুরা। আবার শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়িতে তো ভৃত্য-গৃহিণী কেউই সুরারসে বঞ্চিত হতেন না। একবার নাকি নেশার ঘোরে পুরুতকেই বলি দেবার উপক্রম হয়েছিল।
এই নিয়ে প্রাণকৃষ্ণের মজার গপ্প আছে একখানা। কারণবারি প্রসাদে চুর এক ভৃত্য পদসেবা করতে গিয়ে কিছুতেই আর বাবুর পা খুঁজে পাচ্ছে না। গোটা বাড়ি জুড়ে পায়ের খোঁজে হইহই পড়ে গেল। বাবুর পা কোথায় গেল? পুজোমণ্ডপেও পা নেই। এদিকে পায়ের অভাবে বাবু নামতে-হাঁটতে পারছেন না। শেষে গিন্নিমা আদেশ দিলেন পুরুতমশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করার। নৈবেদ্যর সঙ্গে পা-টাও ভুলক্রমে চলে গেছে হয়তো। পুরুতমশাই সব শুনে খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, এত নৈবেদ্যর মধ্যে বাবুর পা খুঁজতে রাত কাবার হয়ে যাবে। খুঁজে পেলে কাল সকালে তিনি স্বয়ং বাবুকে পা ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন।
শুধু মদ্যপানে কি আর জমে পুজো? তাই, পুজোর পরে পার্টি হত। সেই পার্টিতে সাহেব-মেমরা আসতেন। বাইজি নাচ, কবিগান, পাঁচালি, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াইতে মেতে থাকত আসর। পরে যুক্ত হল যাত্রাগান আর জেলেপাড়ার সঙ। তাছাড়া ছিল আতসবাজির পসরা। কালীপ্রতিমা নিয়ে বাজনা-আলো সহকারে শোভাযাত্রাতেও বেরোতেন বাবুরা। সেই শোভাযাত্রার জাঁক নিয়ে পরস্পরের মধ্যে রেষারিষিও ছিল তীব্র। সব মিলিয়ে কালীপুজো ব্যাপারটা মোটে সাধারণ এক উৎসব ছিল না কলকাতাবাসীর কাছে।
সময় গড়িয়ে গেল ঢের। গঙ্গার মূল স্রোত সরে এসে আদিগঙ্গাও শুকিয়ে পরিণত হল খালে। সেইসব বাবুয়ানি-রাজ-রাজরাদের কালও শেষ হল। মহানগরীর সেইসব কালীপুজোও মুখ লুকোল ইতিহাসে। বিখ্যাত কালীমন্দিরগুলোর পুজোর কথা অবশ্য আলাদা। প্রথা মেনে তারা আজও বহমান। কিছু সাবেক পুজোও বেঁচে-বর্তে আছে কোথাও কোথাও। কিন্তু, ফাঁকা জমি-জঙ্গলাকীর্ণ আধো আলো-আধো অন্ধকারের সেই গা ছমছমে কলকাতার গায়ে কাঁটা দেওয়া কালীপুজোরা আর নেই। ডাকাতরা নেই, বলির বীভৎসতাও নেই। কিন্তু, ইতিহাসের গপ্পেরা এত সহজে মরে না। আতসবাজির মতো আকাশজুড়ে তাদের ছড়িয়ে পড়তে দেখাও কম লোভনীয় নয়।
(তথ্যসূত্র:
১- সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২- কালী পূজা ও কিছু কথা, সনজিৎ ঘোষ, অর্পিতা প্রকাশনী।
৩- কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
৪- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/history-of-kolkata-kalikhetra)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত