আমার মা রোজ চিন্তা করে আমাকে নিয়ে। আমার ধারণা সব্বার মায়েরই চিন্তা হয় তাদের বেয়াদব ছেলেদের নিয়ে। ভগত সিং এর মা হোক বা সাভারকরের। চিন্তা হয়।
আমি ফেসবুকে কী লিখছি, কেন লিখছি, কোন লোকের সাথে উত্তর প্রদেশে ঝগড়ায় জড়িয়ে পরছি, তাই ভেবে প্রেসার সুগার উচ্চগতিতে চলে। স্ট্রেস অনেক রোগের কারণ।
আমার মা এর কাছে সিপিএম, বিজেপি, পুলিশ বা তৃণমূলের কেউ এসে আমার অকাজগুলো নিয়ে গুছিয়ে কথা বললে আমার মা কেঁদে কেটে একশেষ করতো। ক্যামেরার সামনে তা দেখতে ঠিক এরকমই লাগতো। এরকম সময় গুলো বড্ড দোলাচালের। সবটা গুলিয়ে যায়।
ওই যে ছেলেটা চুলের মুঠি ধরে টেনেছিল বাবুল সুপ্রিয়-র বলে অভিযোগ, ইনি ওই বাঁদর ছেলেটার মা৷ ক্যান্সার আক্রান্ত, কেমো চলে। নিজেই বললেন চিকিৎসার খরচাপাতির পরে ও ছেলের যাতে ভালো হয় তার জন্যই ওনার বেঁচে থাকা। আকুতি করেছেন ক্যামেরার সামনে যাতে ছেলের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ না করা হয় কারণ ছেলের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে।
বাবুল সুপ্রিয় ও ফেসবুকে ভদ্রলোকের মতো জানিয়েছেন যে, কোন এফআইআর করবেন না তিনি। বাকিদের ও করতে বারন করেছেন। সেদিন ও এতোকিছুর পরে ওর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকেদের বলেছিলেন সংযত থাকতে। এটাই তো গণতান্ত্রিক দেশের নেতার আচরণ হবে। সবাই কী তিয়ানমেন স্কোয়ারে ট্যাংক চালিয়ে দেবে নাকি? বাবুল সিংহ হৃদয় প্রমাণ করতে চাইলে তার এমপি ল্যাডের টাকা থেকে মাসিমার চিকিৎসার ও দ্বায়িত্ব নিক। দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক সহিজ্ঞুতা আর গণতান্ত্রিক পরিমন্ডলের। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে এটাই তো হবে কবীর সুমনের নতুন গানের লাইন।
এসবটাই ঠিক ছিল। কিন্তু এই এবিভিপির ছেলেদের এক অসুস্থ মহিলার কাছে গিয়ে তার “অসভ্য” ছেলের ঠিক কি কি হতে পারে, রাষ্ট্র তাকে ঠিক কি কি ভাবে শাস্তি দিতে পারে তা জাহির করার প্রয়োজন ছিলনা বলেই মনে হয়। এটা ও নোংরামি। মাসিমার শরীর খারাপ এর মধ্যে মানসিক চাপ দেওয়ার ও কি খুব প্রয়োজন ছিল?
সে রাজনৈতিক লড়াই যখন, এসব তো হবেই। বাম বা তৃণমূল হলে ও নিপুণ কৌশলে এটাই করতো৷ আগে ও করা হয়েছে।
এই ভিডিওকে হাতিয়ার করে অনেকে আবার সেই প্রাচীন আলোচনায় ফিরছে। ছাত্রদের পার্টি পলিটিক্স না করে মন দিয়ে লেখাপড়া করা উচিত। তারপর বড় হয়ে গাড়ি ঘোড়া চড়া, বিদেশে ফ্ল্যাট কেনা, সুন্দরী বউকে বিয়ে, ফ্যামিলি ফটো সৌখিন ড্রইংরুমে। এই আলোচনাতে ঢাল করা হচ্ছে এই মায়ের আকুতি।
নেতাজী, ভগত সিং হোক বা ক্ষুদিরাম কার মা চিন্তা করেনি বলতে পারেন? সব্বাই যদি আইসিএস পরীক্ষাটা দিয়ে দিত, “দ্দশ” স্বাধীনের স্বপ্ন দেখতো কে?
সব্বাই ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক হলে এই আকালে স্বপ্ন দেখবে কে? সারাদিন বইতে মুখ না গুঁজে ভুখ হরতাল করতে দেখলেন কিছু দামাল ছেলেমেয়েকে সব্বার প্রাপ্য হোস্টেলের দাবীতে, ওটাই এই আকালে স্বপ্ন দেখা।
সব্বাই গাড়ি ঘোড়া চড়া প্র্যাক্টিস করলে, দিনরাত পড়াশোনা করলে, মাঝরাতে ফোন পেয়ে বন্ধুর বাবার জন্য হাসপাতালে জাগবে কে? পরিক্ষার আগের দিন দারুন বৃষ্টিতে পাশের বাড়ির কারো মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রী হবে কে? প্রানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত কেউ বা কারা আসছে শুনে যে যেখান আছে সেখান থেকে মেন গেটে মানববন্ধন করবে কে? এসব সিলেবাস শেখায় না। সংগঠন শেখায়।
ভালো ছেলে না হয়ে, মা বাবার কথার অবাধ্য হয়ে যারা এই কলকাতা শহরের বুকে ৮৪’ সালে একজন ও শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের গায়ে আঘাত হানতে দেয়নি, ৯২’ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে যাওয়ার পরে পালা করে রাত জেগেছিল যারা মুসলমানী ঘরের সামনে, ওরা ও লেখা পড়াটা করে, তবে স্রেফ ওটাই করেনা৷
মায়েদের চিন্তা হয়। বাবার দুশ্চিন্তা। দামাল ছেলে, বিদ্রোহী, বিপ্লবী বা রাজনৈতিক নেতা ভিনগ্রহের থেকে জন্মায় না। এরকমই ঘাত প্রতিঘাত থেকে জন্মায়। বাবুল সুপ্রিয় র পরিবার ও চিন্তা করে যখন ওর গাড়িতে কয়লা মাফিয়ারা বোম মারে। তাই বলে সে ভালো ছেলে হয়ে গেলে মুশকিল।
মাসিমা আপনার ছেলেটা বাঁদর, অসভ্য ও বলা চলে। পাকা মাথার উস্কানিতে বিদ্রোহ দেখানো ও হতে পারে। কিন্তু মাসিমা আপনার ছেলেটা আলুভাতে না। হাতের সব আঙুল, আশেপাশে সবকিছু যদি এক রঙের হয়ে যায় হঠাৎ, একই ভাষা, একই ভাবে রাগ দেখানো, একই ভাবে ভালোবাসতে শুরু করি যদি সবাই, গোটা সমাজটা ফ্যাকাসে, খয়েরী রঙের হয়ে যায়। কোন বৈপরীত্য নেই, বিবিধের মাঝে মিলন বলে কিচ্ছু নেই।
ছেলেটা, ছেলেগুলো অন্যরকম বলে তাদের শ্রেণিটাই মুছে ফেলার, উপড়ে ফেলার চেষ্টা হলে রুখে দাঁড়াবো। বাবুলের চুলের মুঠি ধরে টানা হলে ও নিন্দা করবো কারণ আমার খোদা লেনিন বা লেননের মাঝামাঝি কোন অবয়ব। আমার স্লোগান ইনকালাবির আগে:
“I don’t agree with what you say but I will defend to the death your right to say it.”।
যারা ঘাস কাটতে চায় বা বনের মোষ তাড়াতে তাদের ও সমানাধিকার আছে এ সমাজে বাস করার। আমাদের সেটাও নিশ্চিত করতে হবে যে এই দ্রোহকালে!
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত