রাস্তার ধারে এক খাটিয়া পাতা। সেই খাটিয়ায় বসেই রাস্তা আর ধুলোর বোঝাপড়া দেখছিলেন আর লক্ষ্মীনারায়ণ। কোনও কাজ নেই। বসে-বসে এসবই দেখেন। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে জলের গাড়ি বেরিয়ে গেল এইমাত্র। দূরে লাঙল-চলা শূন্য ক্ষেত। ক্ষেতের ধারে একটা কাঁটাগাছ আষ্টেপৃষ্ঠে উঠেছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় লক্ষ্মীনারায়ণের পুরো ক্ষেতটাই না কাঁটাগাছটা গিলে ফেলে!
অনন্তপুরে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সকলেই ক্ষিপ্ত। মোদী সরকারের সময়ে স্বচ্ছ ভারতে শৌচালয় আছে, কিন্তু জল নেই। এ এক আজব দেশের গল্প। দাওয়ার পাশেই অনন্তম্মা জল ধরছিলেন। আর গজগজ করছিলেন, ‘‘শৌচালয় করে দিয়েছে! এদিকে জলই নেই”! কে শৌচালয় করে দিয়েছে জানতে চাইলে বলেন, “কে আবার? সরকার! ওই স্বচ্ছ ভারত না কি আছে তাতেই তো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে শৌচালয় বানিয়ে দিয়েছে, এদিকে জল নেই সারা গ্রামে। মানুষের সমস্যার শেষ নেই”।
রোদ্দুরের তাপে ঝলসাচ্ছে চতুর্দিক, অনেক বার বলার পরেও জলের গাড়ির লোকটা এদিন বেশি জল দেয়নি। অন্য দিন কাকুতি-মিনতি করলে বাড়তি বালতিতে জল দিয়ে দেয়। কিন্তু এ দিন না কি জলের টান রয়েছে। এমনিতে অনন্তপুরে লক্ষ্মীনারায়ণদের চন্নমপল্লি গ্রামের সব বাড়িতেই স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের শৌচালয় আছে। কিন্তু জলই তো নেই। তাই ফিরে এসেছে পুরনো অভ্যাস। ছোট পাত্রে জল ভরে মাঠে-ঘাটে যাওয়া আর কী! গ্রামের বাসিন্দা এম রেড্ডি বলছিলেন, ‘‘গ্রামের ১২০টা ঘরেই গিয়ে দেখুন, স্বচ্ছ ভারতের শৌচালয় শুকনো, খটখট করছে।’’ জল নেই, তাই খরার দেশে চাষের জমির মতোই স্বচ্ছ ভারতের শৌচালয়েরও দাম নেই! লক্ষ্মীনারায়ণদের বাড়িতে একটা ট্যাপ আছে বটে। কিন্তু গত দেড় বছর তাতে জল পড়ে না। অনন্তম্মা অবশ্য রোজ ট্যাপের দিকে নিষ্পলকে চেয়ে থাকেন। এই বুঝি জল এল! লক্ষ্মীনারায়ণ বলছিলেন, “প্রতিটা পরিবার এখন জল কিনে খায় এখানে। কিনতেই হয়। পাত্রপিছু ১০ বা পাঁচ টাকা”। পিছনে পড়ে থাকে সরকারি জলের গাড়ি, গ্রামের মুখে বসানো অনিশ্চয়তার ট্যাপ আর স্বচ্ছ ভারতের শুকনো-খটখটে শৌচালয়। আর ট্যাপের বেরনো পাইপের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা অনন্তম্মা।—যদি কখনও সেটায় ফের জল আসে, এই আশায়!
বেঁচে থাকার জন্য জল প্রয়োজনীয়। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশের এই অঞ্চলে জলের দেখা নাই। খরার কবলে সম্পূর্ণ অঞ্চল । জল কখন চলে যায়!— এই ভয় সবসময় তাড়া করে বেড়ায় খরার এই স্বচ্ছ ভারতের জলহীণ অঞ্চলে। যাঁরা পারছেন, কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন। বেসরকারি সংস্থার এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রায় সাত লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। খরার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রকল্প ‘অন্ধ্রপ্রদেশ ড্রট মিটিগেশন প্রজেক্ট’-এর এক কর্তা বললেন, ‘‘দ্য মহাত্মা গাঁধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমের মাধমে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে ‘মাস মাইগ্রেশন’ আটকানোর চেষ্টা করছে সরকার। খরা-কবলিত এলাকার মানুষকে যাতে কাজের খোঁজে অন্যত্র না যেতে হয়, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’’ কিন্তু চাষিদের দাবি, সব এলাকাতেই ওই প্রকল্পে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কাজ পেলেও মজুরি বাবদ টাকা হাতে পেতে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে।