কথায় আছে, ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা/ অতি মানে চ কৌরবাঃ’। কিন্তু বর্তমানে ডাক্তারদের ‘কর্মবিরতি’ নামক মারণ অসুখে রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের যা পরিস্থিতি, তাতে এ কথা স্পষ্ট যে, ওপরের কথাগুলি আদৌ স্মরণে নেই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের। তাই ঔদ্ধত্যের সব সীমা পার করে গিয়েছেন তাঁরা। হ্যাঁ, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার দিনভর আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান, প্রবীণ চিকিৎসকদের মধ্যস্থতার চেষ্টা, সব কিছু যে ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন, তাকে অসৌজন্য এবং সীমাহীন ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কোনও ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। নিঃসন্দেহে এটা নিন্দনীয়।
প্রসঙ্গত, দিন কয়েক ধরেই শোনা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি এক বার প্রহৃত চিকিৎসকের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় সহানুভূতির হাত রাখলে সমস্যার সমাধান আরও আগে এবং অনেক সহজে হত। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মুখ্যমন্ত্রী কি আদৌ আলোচনায় বসতে চাননি জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে? নাহ, তা একেবারেই নয়। বরং মুখ্যমন্ত্রী বারবারই তাঁদের নবান্নে আহ্বান জানিয়েছেন। কোনও রাজনৈতিক দলের ফাঁদে পা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গতকালও তিনি বলেছেন, ‘যারা এখন কাজ শুরু করতে চায় তারা কাজ শুরু করুক। এভাবে একজন দুজন কাজে ফিরলেই দেখবেন সবার বাঁধ ভেঙে যাবে। আমরা কারও বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করব না। কারণ ওরা সবাই ছোট। পড়াশোনা করছে। ওদের সবার জীবন পড়ে আছে।’
এমনকী নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ‘১০ তারিখ একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। তার পরেরদিন থেকেই আমরা সরকারের তরফে সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছি। পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে এত কড়া মামলা রুজু করা হয়েছে যে আদালত জামিন নাকচ করে দিয়েছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তিস্থাপনের অনুষ্ঠানের দিনই স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সিপি অনুজ শর্মাকে পাঠিয়েছিলাম। তখন ওরা আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চায়নি। সেটা ওদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তারপরও আমরা চেষ্টা করে গিয়েছি সমাধান খোঁজার।’
উল্লেখ্য, শুক্রবার ও শনিবার প্রবীণ চিকিৎসকদের মাধ্যমে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী নিজে সরাসরি কর্মবিরতি তোলার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, যদি তাঁকে পছন্দ না হয়, তা হলে রাজ্যপাল, মুখ্যসচিবের মতো যে কোনও শীর্ষ পদাধিকারীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁর কথায়, ‘আমি আবেদন করেছি সব মেডিক্যাল ফ্র্যাটারনিটিকে কাজে যোগ দিতে। সরকার কারও সঙ্গে নেতিবাচক আচরণ করেনি। এর আগে প্রায় ১০টা রাজ্য এসমা জারি করেছিল জরুরি পরিষেবা চালু করতে। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে এটা করিনি।’ আন্দোলনকারীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে এবং চিকিৎসকদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু এতেও কি আদতে কোনও লাভ হয়েছে? ছ’দিন গড়িয়ে গিয়েছে। সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় শিশুমৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তাতেও আন্দোলন মেটেনি। টলানো যায়নি জুনিয়র ডাক্তারদের অহংকে। তাঁদের সেই এক দাবি, মুখ্যমন্ত্রীকে নিজে এনআরএসে আসতে হবে। যার একটাই অর্থ দাঁড়ায়, মুখ্যমন্ত্রী না এলে, তাঁদের কাছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আসা মুমূর্ষু রোগীদেরও ফিরিয়ে দেবেন তাঁরা। এভাবেই তাঁদের আন্দোলনটিকে রাজ্যবাসীর জন্য এক সীমাহীন দুর্গতির রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন জুনিয়র ডাক্তার। যা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়।
চিকিৎসকরা সমাজের সব চেয়ে বড় বন্ধু বলেই জানা ছিল। কিন্তু আন্দোলনে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত বহাল রেখে সেই চিকিৎসকেরাই এবার ক্রমশ ‘গণশত্রু’ হয়ে উঠছেন। তবে এর ফল যে খুব একটা ভাল হবে না তা সময়ই বলে দেবে। কারণ কথাতেই আছে, ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা/ অতি মানে চ কৌরবাঃ’।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত