‘কর্তৃপক্ষ মেলা যথাযথভাবে না করতে পেরে, এটা থেকে তারা হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। ভাবনাটা এমন-যেন আমিই মেলাটি বন্ধ করে দিয়েছি বা দিচ্ছি। নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার এইভাবে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ পৌষমেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবার এই ভাষাতেই নরেন্দ্র মোদীকে তোপ দাগলেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। তাঁর অভিযোগ, মেলা বন্ধ করে আসলে বিশ্বভারতী এবং তার আচার্য নরেন্দ্র মোদী আদতে মেলা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করার দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সেই দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাঁর উপরে।
মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেই তাকে পরিবেশ বান্ধব করে তোলার চেষ্টা করা হোক। তা যেন দেশের অন্যন্য মেলা বা উৎসবগুলির জন্য মডেল হতে পারে সেই প্রচেষ্টা করা হোক বলে দাবি পরিবেশবিদের। কিন্তু মেলার দায়িত্ব বিশ্বভারতীর। বিগত কয়েক বছরে মেলার জেরে লাগামছাড়া দূষণ হওয়ায় এই বছর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে মেলা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে বিশ্বভারতী। এরই প্রতিবাদ করে সুভাষ দত্ত সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পৌষমেলা চালু করা হোক। তিনি বলছেন হঠাৎ করে মেলা পুরোপুরি বন্ধ না করে দিয়ে কোনও লাভ হবে না।
তিনি আরও বলেছেন যে, ‘আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, আদালত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কঠিন ও তরল বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছে। পৌষ মেলা থেকে হাত গুটিয়ে নিলেও কিন্তু এই স্বচ্ছতা প্রদানকারী অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের দায়িত্ব থেকে ওঁরা নিস্কৃতি পাবেন না। প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিষ্ঠানের আচার্য এবং সারা ভারতকে স্বচ্ছতায় মুড়ে ফেলার ডাক যিনি দিয়েছেন, তিনি কি কর্তৃপক্ষের এই অস্বচ্ছ পদক্ষেপ মেনে নেবেন?’ তবে এখানেই না থেমে, তিনি আরও বড় তোপ দেগেছেন বিশ্বভারতী এবং মোদীর দিকে।
তাঁর কথায়, “বিশ্বভারতীর খরচ জোগায় জনগণ। হঠাৎ কর্তৃপক্ষ মেলা থেকে লোকসানের কথা পাড়লেন। তাহলে চুপিচুপি একটি কথা বলি ‘মেলা থেকে প্রচুর আয় হয় কিন্তু সেই আয়ের প্রবাহ অন্য খাতে আজ বইছে।‘ মেলাকে দুর্নীতিমুক্ত করাও প্রয়োজন।” আক্ষেপের সুরে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘প্রকৃতি মাতার জঠরে জন্ম নেওয়া এবং পরিবেশের কোলে বড় হওয়া ঐতিহাসিক এই প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ বিধির মান্যতা দিয়ে মেলা করতে পারবে না – এই অক্ষমতা অত্যন্ত বেদনার। আমাদের সকলের মাথা নীচু করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই? আজ তাই প্রার্থনা – হে ঠাকুর, তুমি আমাদের ক্ষমা কোরো।’
প্রসঙ্গত, সুভাষ দত্ত পরিবেশ রক্ষার জন্য সবসময়েই লড়াই করেছেন। কলকাতা বইমেলা ময়দান থেকে সরিয়ে নেওয়ায় ভূমিকা ছিল তাঁরই। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই মেলা মারাত্মক ভাবে দূষণের সৃষ্টি করছে। তাই একে স্থানাতরিত করা হোক। তবে তিনি মেলা বন্ধ করতে বলেননি। কলকাতা বইমেলা আজ আরও সারম্বরে হচ্ছে। বহু স্থান পরিবর্তন করেও মেলার চাহিদা, জনপ্রিয়তা কমেনি। শীতে কলকাতার বঙ্গ জীবনের অঙ্গ আজও কলকাতা বইমেলা। সেই সুভাষ দত্তই পৌষ মেলা নিয়ে স্পষ্ট জানাচ্ছেন, মেলার দেখভাল করা হোক পরিবেশের সম্পর্কে সচেতন হয়ে। মেলা বন্ধ করে দিয়ে কখনই তা সুরাহা হবে না।
কিন্তু তা না করে মেলাই বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বভারতী এবং মোদী। এবং তার দায় চাপানো হয়েছে সুভাষের ওপরেই। এর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মাধ্যমে তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছেন, ‘২০১৭ এবং ২০১৮ তে বিধি মেনে মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি, তা আদালতকে জানানো আমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। আমি তাই আইন মোতাবেকে মেলা করার জন্যই আদালতে আবেদন রেখেছি। মেলা বন্ধ করতে নয় , কেননা এই ঐতিহ্যবাহী মেলাটি আমারও অত্যন্ত প্রিয়। মেলা করবে না বিশ্বভারতী আর দায়ী হব আমি, এটা কেমন বিচার?’ এই প্রতিবাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরী দলিলও সামনে এনেছেন।
সুভাষ দত্তের দাবি, সেই দলিলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পষ্ট লিখেছেন যে কোনও মূল্যে প্রত্যেক বছর পৌষমেলা করতে হবে। সব ধর্মের মানুষ এক হয়ে এই মেলায় আনন্দ উপভোগ করবেন। কোনওরকম মূর্তি পূজা মেলায় হবে না। চলবে না কোনওরকম কুরুচিকর বিনোদন। মদ এবং মাংস বাদে সবরকম খাওয়া দাওয়া এখানে চলতে পারে। সুভাষ দত্তের প্রশ্ন, যেখানে মহর্ষি লিখে গিয়েছেন যে মেলা করতেই হবে তখন কোন যুক্তিকে সামনে রেখে প্রায় ১২৫ বছর ধরে পৌষ মেলাকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? তাঁর কথায়, ‘এই মেলা বন্ধ করার নিদান কে বা কারা নিয়েছেন জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি এই ঐতিহ্যকে বন্ধ করার অধিকার আমাদের কারোরই নেই।’