দূরদর্শী দিদি
কিছুদিন আগে আপনাদের বলেছিলাম এবারের নির্বাচনী সফরের সময় আমি আমাদের সবার প্রিয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এমনকিছু ভাবনা, মুহূর্ত ও দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো যা তাকে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে। মানুষের মমতা নামে� চিত্রকথা বা সিরিজটি এই ভাবনারই ফসল। অনেক সময় ছোট সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দেয় একটা ভাবনার ব্যাপ্তিকে। পরে দেখেছি দেশের অনেক পণ্ডিত ও রাজনৈতিক নেতারা সেই ভাবনারই প্রতিধ্বনি করেন। যেমন ধরুন, এবারের ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে ২০০ দিনের কাজের কথা বলা হয়েছে। আমার মতে, দেশের গরীব মানুষকে বিকাশের রাস্তায় টেনে আনার জন্য এটা অত্যন্ত একটি জরুরি ঘোষণা।
এই কথাটা কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আগে দেশের কোন রাজনৈতিক দলই বলেনি। বিজেপি তো দেশ বাঁচানোর নামে দাঙ্গা আর মেকি দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে গরীবদের নিঃস্ব করে তোলার খেলায় মেতেছে। কংগ্রেস তাদের বহু বিজ্ঞাপিত �ন্যায়� যোজনায় গরীবি দূর করার নামে গরীবদের কিছু টাকা পাইয়ে দেওয়ার রাস্তায় হেঁটেছে। আর বামপন্থীরা সর্বক্ষণ মুখে গরীবের কথা বললেও তাদের বিকাশের ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দিশা দেখাতে পারেননি। অবশেষে তৃণমূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও তাদের ইস্তাহারে ২০০ দিনের কাজের কথা বলেছে। ভাবনার দিক থেকে তৃণমূল নেত্রী কিন্তু এগিয়েই রইলেন।� �
দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে তার সঙ্গে আছি বলেই আমি জানি একাজটা তৃণমূল নেত্রী� করতে পেরেছেন কারণ, গরীবদের মনের কথা তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারেন। অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত নাড়িতে হাত রেখেই তিনি চট করে ধরতে পারেন সমস্যাটা ঠিক কোথায়? তিনি জানেন দেশের গরীব ও পিছিয়ে থাকা মানুষেরা কামচোর নয়, তারা খেটে খেতে চায়। কাজের আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করেই তাদের বিকাশের রাস্তা, যাকে পণ্ডিতরা বলেন, ইনক্লুসিভ গ্রোথ, সেই রাস্তায় টেনে আনা যায়। গরীবরা মনেপ্রাণে সেটাই� চায়। আর রাহুলের মত সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো হঠাৎ নেতারা গরীবদের উন্নতি বলতে বোঝেন সরকারি তহবিল থেকে তাদের কিছু দান-খয়রাত করা।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি চট করে মিশে যেতে পারেন। এটা ট্রেন, গাড়ি বা প্লেন থেকে স্তাবক পরিবৃত হয়ে দেশ দেখা নয়, এ দেখার মধ্যে একটা মানবধর্ম থাকে, আর থাকে মানুষের মঙ্গল করার ইচ্ছা। এজন্যই তিনি তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন। তার সিদ্ধান্তগুলিও যার জন্য সফল হয়। কর্মসূত্রে রাজ্যের নানা জায়গায় তার সফরসঙ্গী হয়ে আমি দেখেছি গত কয়েক বছরে কন্যাশ্রী থেকে সবুজসাথী, খাদ্যসাথী থেকে যুবশ্রী তার নানা দূরদর্শী প্রকল্পগুলি কীভাবে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের জীবন বদলে দিয়েছে। এই সাফল্যের জোরেই তিনি প্রকৃত অর্থেই গোটা দেশের জননেত্রী হয়ে উঠেছেন।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শুধু ভোট আসলেই সাধারণ মানুষের কাছে যান না, তার এই যাতায়াত চলে বছরভর। তিনিই একমাত্র নেত্রী যিনি ভোট ঘোষণা মাত্রই রাজ্যের সমব্যাথী, কৃষক বন্ধু, রূপশ্রীর মত গরীববান্ধব প্রকল্পগুলি নিষিদ্ধ না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। আমাদের গরীবদরদী জননেতারা তখন রা কাড়েন নি। তারা শুধু বিরোধিতার জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করেন, পরে ভুল বুঝতে পেরে চুপ করে যান। তার সঙ্গে গ্রামে যখনই যাই তখনই দেখি কোন ঘোষণা, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তার পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। ক্ষেত থেকে বাড়ির উঠোন, গ্রামের বটতলা থেকে মন্দির, স্কুল থেকে খেলার মাঠ সর্বত্র ছোট-বড় সবার সঙ্গে তার অবাধ মেলামেশা। স্কুলের ছাত্র থেকে প্রবীণ নাগরিক সবাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারেন। এই মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ধরতে পারেন কার কি প্রয়োজন। এই উপলব্ধিই উঠে আসে দলের নীতিতে। তার ভিত্তিতেই তৈরি হয় তৃণমূল নেত্রীর পরবর্তী কার্যক্রম।� গ্রামীণ মানুষের কথা ভাবেন বলেই তিনি দলের ইস্তাহারে ২০০ দিনের কাজের কথা নিয়ে এসেছেন।
স্কুলে পড়ার বয়সে অতিবাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সময় একটা স্লোগান শুনতাম, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। সে আন্দোলন নানা ভুলে পথ হারিয়েছে, কিন্তু স্লোগানটা মিথ্যে নয়। গ্রাম বাঁচলেই শহর বাঁচবে। একসময়ের লাল বাংলা এখন তৃণমূল নেত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে ফিরে পেয়েছে তার স্বাভাবিক সবুজ রঙ। অন্যদিকে �মোদি-অমিতরা ভোটের বাজারে এখন হেলিকপ্টার আর বিমান কিংবা পেল্লায় কনভয় নিয়ে গ্রামে পৌছতে চেষ্টা করলেও গ্রাম-ভারত তাদের ভাবনা চিন্তায় নেই। থাকলে তাদের আমলে দেশজুড়ে কৃষকরা ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করতেন না, ডিমনিটাইজেশনের কোপে সর্বস্বান্ত হতেন না দেশের মানুষ।
একাত্তরে ইন্দিরা গান্ধীর গরীবি হঠাও স্লোগানটাকেই রাহুল ২০১৯ এ গরীবি মেটাও নামে ফিরিয়ে এনেছেন। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মোদিকে হঠিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গড়ার কথা। সংবাদ মাধ্যমে কিছু মন্তব্য ছাড়া মোদি বিরোধী প্রকৃত লড়াইয়ে তিনি নেই। সিপিএমের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। চিরকাল দেখছি দেশের একশ্রেণীর� তথাকথিত বিরোধী নেতাদের কিছু ফাঁকা বুলি ছাড়া গরীবদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নেই। বস্তুত তারা শাসকদেরই সুবিধা করে দেন। বাম আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যখন সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই চলছিল তখন রাজ্যের নামজাদা অনেক কংগ্রেস নেতাই সেই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান নি, বরং কুৎসা করেছেন। মার খাওয়া কংগ্রেস কর্মীদের পাশ থেকে সরে গেছেন তারা। সত্যি বলতে কী তাদের জন্যই সিপিএম দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। নইলে বহু আগেই তারা বিদায় নিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সময়কার লড়াইয়ের ছবি তুলতাম বলে অনেক কংগ্রেস নেতা ছাপার অযোগ্য গালাগাল দিয়ে আমায় বলতেন, কি অশোক, শুধু মমতার ছবি তুললেই হবে? আমাদেরও তোলো? আমি বলেছিলাম, তোমরা তো শুধু অ্যাসেম্বলিতে আছো, গ্রামে গিয়ে সিপিএমের সঙ্গে লড়াই কর, ছবি তুলবো। তাদের অনেকেই আজ তৃণমূলেই আছেন। যতদূর মনে পড়ে, হাওড়ার কান্দুয়া গ্রামে ভোট দিতে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল। সিপিএমের গুণ্ডাদের এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কোন কংগ্রেস নেতা সেদিন রুখে দাঁড়ান নি। একমাত্র তিনিই সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন।
দূরদর্শী বলেই তিনি সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন এই অত্যাচারিত মানুষদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা দিতে পারলে তারাই রাজ্যে সিপিএমের অপশাসনের অবসান ঘটাতে পারবেন। সেটাই সত্যি হয়েছে। ঠিক তেমনি সারা দেশের মানুষ যদি দলমত নির্বিশেষে বিজেপির জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয় তবেই তাদের দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে। সেই জনজাগরণ শুরু হয়ে গেছে। এই সরল সত্যটা কংগ্রেস ও বামপন্থী দলের নেতারা বুঝতে পারলে তারা মমতা বিরোধী রাজনীতি থেকে সরে আসতেন। তাই বলি, নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ করার রাজনীতি বন্ধ করুন। নইলে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে আপনারা কোন সদর্থক ভূমিকা নিতে পারবেন না।
দূরদর্শী দিদি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন, আপনারা হয়ে থাকবেন শুধুই দর্শক।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত