ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও ব্যক্তি যদি মোদী সরকার বা বিজেপির সমালোচনা করেন, তা হলে দলবেঁধে তাঁকে উত্ত্যক্ত বা ‘ট্রোল’ করা হয়। তিনি যদি বিখ্যাত, বা সম্মানিত কেউ হন, তা হলেও রেহাই পান না। উল্টে তাঁকে অপদস্থ করার মাত্রা আরও বাড়ে। এবং এই পরিকল্পিত নিগ্রহ পরিচালিত হয় সরাসরি বিজেপির ভেতর থেকেই। এবার এমনই বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন খোদ সাধ্বী খোসলা, যিনি ২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন।
সাধ্বী বলেছেন, বিজেপি ঠিক করে রাখে তাঁর শিকার। কোন রাজনৈতিক নেতা, কোন অভিনেতা, সাংবাদিক ট্রোলিংয়ের নিশানা হবেন, তার ‘হিট লিস্ট’ আগাম তৈরি থাকে। তৈরি থাকে ট্রোলিংয়ের কায়দাও। রাজনৈতিক কুৎসা হবে, নাকি ব্যক্তিগত চরিত্রহনন, যদি টার্গেট মহিলা হন, তা হলে তাঁর নামে যৌন কেচ্ছাও ছড়ানো হবে কি না, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী যাঁরা, তাঁদের কি সরাসরি জাত-ধর্ম তুলে আক্রমণ করা হবে, কাদের দাগিয়ে দেওয়া হবে ‘দেশদ্রোহী’— সব ছক কষে তার পরেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শুরু করে বিজেপির আইটি বাহিনীর স্বেচ্ছাসৈনিকরা। মঙ্গলবার প্রকাশিত এক বইয়ে গেরুয়া শিবিরের এই ঘরের খবর দিয়েছেন সাধ্বী।
‘আই অ্যাম এ ট্রোল’ নামে বইটির অনুলেখক সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিমানুষকে নানাভাবে অপমান, অপদস্থ করা এবং তার অন্তরালে বিজেপির ভূমিকার ওপর অনুসন্ধানী আলো ফেলেছেন তিনি। মেয়েদের, বিশেষত মহিলা সাংবাদিকদের সোশ্যাল মিডিয়ায় নোংরা ভঙ্গিতে, অশ্লীল ভাষায় আক্রমণের ঘটনা গত কয়েক বছরে বেড়ে গেছে। যদিও সে সবই বেনামি হুমকি, কিন্তু তাদের কিছু চরিত্রগত মিল আছে। মেয়েদের বিরুদ্ধে হুমকি মানেই সেগুলো যৌনগন্ধী এবং ঘোরতর জাতীয়তাবাদী!
সাধ্বী জানিয়েছেন, বিজেপির যে নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া শাখা, সেখান থেকে প্রত্যক্ষ নির্দেশ আসত কাকে, কীভাবে ট্রোল করা হবে। কখনও সেই নির্দেশ ছিল মৌখিক। ওই শাখার কর্ণধারদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে হত এবং ওঁরা মুখে বলে দিতেন। আবার কখনও নির্দেশ আসত হোয়াটস্অ্যাপ মারফত। সাধ্বী সে সময় নরেন্দ্র মোদির বিরাট ভক্ত। অতি উৎসাহে টুইটার, ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে আক্রমণ শানাতেন রাহুল আর তাঁর মা সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্রমশ সাধ্বীর অস্বস্তি বাড়তে শুরু করেছিল। বিশেষ করে যখন রাজদীপ সারদেশাই বা বরখা দত্তের মতো বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপপ্রচারের শরিক হতে হত।
দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কংগ্রেস নেতারা, বিশেষ করে গান্ধী পরিবার এবং মোদী বিরোধী সাংবাদিকরা তখন থেকেই বিজেপির প্রিয় চাঁদমারি। কুৎসা, কেচ্ছা আর অপপ্রচারের লাগাতার তিরবৃষ্টি চলত সেই নিশানায়। অনেক সময় সরাসরি হুমকি। পুরুষদের ক্ষেত্রে তাঁর এবং পরিবারের ক্ষতি করার, মেয়েদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের। এভাবেই যেদিন বরখা দত্তকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া শুরু হল, সাধ্বী খোসলার খারাপ লাগতে শুরু করে। আর যেদিন তাঁর কাছে নির্দেশ এল, অনলাইন বাণিজ্য সংস্থা ফ্লিপকার্ট যাতে অভিনেতা আমির খানের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে, সেই দাবিতে অনলাইনে সই সংগ্রহ অভিযান শুরু করতে হবে, সাধ্বীর মনে হল, না, অনেক হয়েছে!
আমির তখন সদ্য দেশের অসহিষ্ণুতার রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করে বিজেপির বিরাগভাজন হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে খ্যাপা কুকুরের মতো তাড়া করে ফিরছে ছদ্ম দেশপ্রেমিকরা। আমিরের ক্ষেত্রে সাধ্বীর এত খারাপ লাগার কারণটা যদিও ব্যক্তিগত। কিশোরী বয়স থেকেই সাধ্বীর প্রিয়তম নায়ক আমির। সাধ্বী বলেছেন, ‘সেই প্রথম বুঝতে পারলাম, আমার প্রিয় নায়ক, যাঁকে আমি আর পাঁচজন ভারতীয় অভিনেতার থেকে আলাদা ভাবিনি কখনও, তাঁকে মুসলিম বানিয়ে দিচ্ছে এরা। বুঝতে পারলাম, আমার দেশ, আমার সাধের ভারত বদলে যাচ্ছে!’