প্রতিটি দিনই দেশপ্রেমের দিন, প্রতিটি দিনই ভালোবাসার দিন। দেশপ্রেম আর ভালোবাসা একাকার হয়ে গেল গত বৃহস্পতিবার কাশ্মীরের পুলওয়ামায়। যে জওয়ানরা পাকিস্তান সরকারের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের গাড়িবোমার অতর্কিত হানায় প্রাণ হারিয়েছেন তারা সবাই ছিলেন কোন না কোন পরিবারের প্রিয়জন। প্রেমদিবসের উষ্ণতা, আলিঙ্গনকে পাশ কাটিয়েই জঙ্গিদের মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন তারা। বাড়িতে তাদের ফোন, মেল, চিঠির জন্য অপেক্ষা করছিলেন কারও স্ত্রী, কারও প্রেমিকা, কারও পথ চেয়ে বসেছিলেন বৃদ্ধ বাবা, মা ও ভাইবোনেরা। এই ভালোবাসার জোর তাদের দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল। ধর্মান্ধ জঙ্গি ও তাদের মদতদাতা পাক রাষ্ট্রনায়করা ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের এই সম্পর্ক বুঝবেন না। ভারতের প্রতি ঘৃণার রাজনীতি তাদের মূল পুঁজি। ঘৃণার আগুনের জ্বালানি হিসেবে তাদের মদতে কাশ্মীর সহ পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে জেহাদি জঙ্গিরা। এই রাজনীতি দীর্ঘকাল ধরে কাশ্মীর উপত্যকা সহ আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করে চলেছে ধারাবাহিক নিধন যজ্ঞস্থল। পুলওয়ামা তারই এক সাম্প্রতিক উদাহরণ।
এই বীর জওয়ানদের সেলাম জানাই। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এবার এই হত্যার রাজনীতি মুছে ফেলার কাজে দলমত নির্বিশেষে এক হয়ে নামতে হবে। নাহলে এ জিনিস বন্ধ হবে না। কিছুদিন পরপর দেশের একেক জায়গায় ঘটতেই থাকবে গুরুদাসপুর, পাঠানকোট, পাম্পোর, উরি কিংবা সিঞ্জোয়ানের মত জঙ্গিহানার ঘটনা। একেকটা ঘটনায় একেকটা উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম ওঠে। আসলে এদের মদতদাতারা কিন্তু সকলেই এক। এরা সবাই পাক সামরিক মদতপুষ্ট জনবিচ্ছিন্ন একশ্রেণীর জীব। দেশের সমস্যা থেকে সাধারণ মানুষের মুখ ঘোরানোর জন্য এরা ভারতবিরোধী নানা কাল্পনিক কাহিনি ফেঁদে ধর্মীয় জিগির তৈরি করেন যার বলি হয় কিছু অল্প শিক্ষিত এবং ভুল পথে পরিচালিত কিছু যুবক। প্রাণ যায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ও জওয়ানদের।
ধর্মান্ধ জেহাদিরা তাদের নিজেদের জায়গাতে আছেন। কিন্তু আমার অবাক লাগে যখন দেখি মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নাম করে দেশের কিছু মানুষ এই জেহাদিদের সমর্থনে রাজনীতি শুরু করেন। তাদের মতে সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ি জেহাদিদের কার্যকলাপ বাড়াচ্ছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে গেলেই রেরে করে ঝাঁপিয়ে পড়েন এরা। বলেন, কাশ্মীরে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের সরকারের মদতে যুক্তিহীন হত্যার রাজনীতিকে সমর্থন করেন এরা। এই দিগভ্রান্ত জঙ্গিরা বস্তুত মৃত্যুর কারবারি। ভারতে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করাটাই এদের মিশন।
দেশপ্রেম নয়, এরা বিকৃত ধর্ম ভাবনায় মগজধোলাই করা একশ্রেণীর পেশাদার ঘাতক। আমি আমার প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব, যারা কথায় কথায় দেশের নানা দোষ ধরেন এবং প্রতিবেশী জনবিরোধী মূলত সামরিক বাহিনীর অঙ্গুলিহেলনে চলা দেশটির প্রশংসা করেন তাদের বলতে চাই নিজের দেশের দোষ ধরা এবার ছাড়ুন, পাকিস্তানের ভারতবিরোধী হামলার প্রতিবাদ করুন। বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরও তারা নানাভাবে নিজেদের দেশকে ছোট করে পুলওয়ামায় জঙ্গিহানার ঘটনাটিকে লঘু করে দেখাতে চাইছেন। বলতে চাইছেন নিজেদের দেশের সমস্যার থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখতেই শাসকরা জঙ্গিহানার ঘটনাটাকে ঘিরে একটা পাকিস্তানবিরোধী গণউন্মাদনা তৈরি করতে চাইছেন। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা! তাদেরকে বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা মানে একদল অনুতাপহীন রক্তপিশাচদের পক্ষে ওকালতি নয়। খোলাখুলি পাকজঙ্গিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে। এই নৃশংস ঘটনাটা যারা ঘটিয়েছে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি তুলতে হবে।
বৃহস্পতিবারের ঘটনায় নিহত হাওড়ার বাউরিয়ার বাসিন্দা সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার সঙ্গে তার স্ত্রী মিতা সাঁতরার ঘটনার দিন সকালেই কথা হয়েছিল। তখনও তিনি জানেন না এটাই তাদের শেষ কথা। এই ছোট ছোট ঘটনা এবং বাবলু সাঁতরার মত সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত শহিদদের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের ভুললে চলবে না পাকমদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হামলার কথা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচার জোরদার করতে হবে। যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এই নৃশংস হামলায় মদত দেয় তাকে কোনমতেই ছাড়া যাবে না। ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে এব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে আমাদের একটা মঞ্চে দাঁড়াতে হবে। কারণ, সবার আগে দেশ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আমরা সবাই এক।
ভারত সহনশীল দেশ, আমাদের রাজনীতিও সহনশীল। কিন্তু সহনশীলতার নামে দেশের ওপর আক্রমণ মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষকরে শত্রু যখন আমাদের সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভাবে তখন আমাদের স্পষ্টভাবে দেশে এই সন্ত্রাসবাদী হামলার পিছনে যাদের মদত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই হবে। পাল্টা আক্রমণে সবক শিখাতে হবে তাদের, কারণ তারা এই ভাষাটাই বোঝেন। এই শোকের আগুন জ্বালাক দ্বিগুণ, শত্রুর প্রতি ঘৃণার আগুন। এই সন্ত্রাসের পাল্টা জবাবের মধ্যে দিয়েই আমরা পুলওয়ামার শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবো। আমরা বুঝিয়ে দিতে পারবো সহনশীলতা মানে দুর্বলতা নয়।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )