দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার সুবাদে আমি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের� প্রশাসক ও প্রতিবাদী এই দুটো রূপই দেখেছি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময় কিংবা তারও আগে ২১শে জুলাই পর্বে আমি দেখেছি বাংলার এক মানবদরদী প্রতিবাদী অগ্নিকন্যার রূপ। সিপিএম নামক এক সাংঘাতিক সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে নিজের� জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন তিনি। একের পর এক হামলা হয়েছে তার ওপর, যেকোন সময় মারা যেতে পারতেন তিনি। আবার সিপিএম পরাস্ত হওয়ার পর তাকে দেখছি মানবদরদী এক দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকায়।
রাজ্য প্রশাসনের প্রধান হিসেবেই তিনি একজন দক্ষ পুলিশ অফিসারকে সিবিআইয়ের হেনস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। এই ঘটনাটাতে যেন একইসঙ্গে দিদির প্রতিবাদী ও প্রশাসক দুটি সত্ত্বাই ফুটে উঠেছে। রবিবার সন্ধ্যা থেকে দেখছিলাম তার সেই অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতা, ধর্না মঞ্চের সামনে পায়চারি করতে করতে পরের পরিকল্পনা ঠিক করে নেওয়া এবং মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রয়োজনীয় নির্দেশদানের ক্ষমতা। আমাকে সবচাইতে বেশি যেটা অবাক করেছে সেটা হল, তার সাহস। সুপ্রিম কোর্টে কী হবে আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা, দিদির এই সাহসটাকেই আমি স্যালুট করি। ���
এই দিদিকেই বঙ্গবাসী তো বটেই, গোটা দেশ চেনে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তারের জন্য সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের তৎপরতা বিজেপির কাজটা আরও কঠিন করে দিল। রবিবার সন্ধ্যায় রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের হানার প্রতিবাদে অতি অল্প সময়ের মধ্যে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে লড়াই করা গেরিলা স্কোয়াডের কমান্ডারদের মত ক্ষিপ্রতায় দিদি যেভাবে মেট্রো চ্যানেলে সত্যাগ্রহের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিলেন তা মোদী-অমিত ব্রিগেডের সব কৌশলে জল ঢেলে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আমাদের দিদিই নিতে পারেন। আগের শাসক সিপিএম দিদির এই রূপ চেনে, মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার, প্রশাসনিক যোগসাজশ সবকিছুই এই ক্ষিপ্রতার সামনে হতভম্ব হয়ে যায়। এবার বিজেপি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই রূপ দেখবে।
আমার মনে পড়ছে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় মেট্রো চ্যানেলে দিদির ২৬দিন অনশন করার কথা। সিপিএমের অপশাসন ও সন্ত্রাস দিদিকে পথে নামিয়ে দিয়েছিল। ২০১৯সালে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি আমি। শুধু বদলে গিয়েছে প্রতিপক্ষ। এবার প্রতিপক্ষ আরও বেশি ক্ষমতাশালী, সংগঠিত এবং আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ক্ষমতায় থাকার জন্য গোটা দেশটাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে নিতে চায় তারা। গরিব কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্তদের ভালো মন্দ, ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দামই নেই তাদের কাছে।
এদেরকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য গোটা দেশে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সেই লড়াইয়ের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত তার উদ্যোগেই বিরোধী দলগুলি একটা ছাতার তলায় আসতে চাইছে। এখানেই নিজেদের বিপদ সংকেত দেখতে পেয়েছে মোদী-অমিতরা। তাই তারা যেকোন ভাবে অশান্ত করে তুলতে চাইছে বাংলাকে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবদিক থেকেই তারা পিছিয়ে দিতে চায় বাংলাকে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআইয়ের বেআইনি হানা এই পরিকল্পনারই একটা অংশ।
সিপিএম তাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছে ধমকে চমকে আমাদের দিদিকে ভয় পাওয়ানো যায়না। তিনি চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত প্রমাণপত্র ছাড়া মোদী সরকারের একাজ অসাংবিধানিক। এর প্রতিবাদে শুধু রাজ্য নয়, গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলবেন তিনি। মেট্রো চ্যানেলে এই অবস্থানকে তিনি সত্যাগ্রহ আখ্যা দিয়েছেন। এই সত্যাগ্রহ মঞ্চ থেকেই দেশের বিরোধী নেতৃত্বকে বিজেপির অসাংবিধানিক কাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছেন তিনি। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআই হানার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সংসদ। কাশ্মীর থেকে বিহার, দিল্লি থেকে পাঞ্জাব সর্বত্র উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। সত্যাগ্রহ মঞ্চ থেকেই একক সক্রিয়তায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার পাশে টেনে আনতে পেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, চন্দ্রবাবু নাইডু, মেহেবুবা মুফতি, কানিমোজি, তেজস্বী যাদবের মত বিরোধী নেতাদের। রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআই হানা বাংলার রাজনীতিকে দিদির ডাকে ব্রিগেডের সমাবেশের পরবর্তী স্তরে পৌঁছে দিল। অর্থাৎ দেশের বিরোধী নেতারা এরপর থেকে দেশের যেকোন প্রান্তে মোদী-অমিতের বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে সরব হবেন।
তৃণমূল নেত্রী জানেন আন্দোলন মানে বিশৃঙ্খলা নয়, প্ররোচনা এবং প্রতিহিংসার সবরকম উপকরণ মজুত থাকলেও তিনি দলের কর্মীদেরকে পথ ও যানবাহনের অবরোধ করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাই প্রতিবাদ কোন বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়নি। একইসঙ্গে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন সিবিআইয়ের মত কোন কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে প্রতিহিংসার রাজনীতি করে তাকে ভয় পাওয়ানো যাবেনা। সত্যাগ্রহ মঞ্চ হয়ে উঠেছে আগামি দিনে দেশের রাজনীতি কোন পথে চলবে তা দিশা নির্ধারণের মঞ্চ। মোদী-অমিতরা অন্তত এটুকু বুঝবেন প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আর যাকেই হোক, তৃণমূল নেত্রীকে ভয় পাওয়ানো যায়না। অন্যদিকে বুকে ক্ষোভ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষদের এই সত্যাগ্রহ মঞ্চ নতুন করে ভাবতে শেখাবে। তারা বুঝবেন, সাহস রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। দেশের রাজনীতিতে এখন এটাই বড় অভাব। তাই তৃণমূল নেত্রীর যেকোন কাজ আরও বেশি করে চোখে পড়ে।
মোদী-অমিতদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাস্তাই এখন একমাত্র রাস্তা। সেই রাস্তায় নেমেই পুরনো মেজাজে লড়াই শুরু করেছেন বাংলার নেত্রী। দেশ বাঁচাতে পথে নামা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। মেট্রো চ্যানেলে সত্যাগ্রহ মঞ্চ আমাকে মনে করিয়ে দিল সলিল চৌধুরীর সুর করা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পথে আবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা গানটির কথা।
অশোক মজুমদার