ভারতের অন্যতম গর্বের শহর কলকাতায় রবিবার সন্ধ্যার ঘটনাপ্রবাহ শুধু কলকাতাবাসী বা বঙ্গবাসীকে স্তম্ভিত করেনি, স্তম্ভিত করেছে গোটা দেশকে। অঙ্গরাজ্যের সরকারের ওপর কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার সংস্থার এমন প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জড়ানোর ছবি ভারত আগে কখনও দেখেনি।
পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআই হানা, তা রুখতে পুলিশের পাল্টা পদক্ষেপ, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর এবং রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের ছুটে যাওয়া, পুলিশ কমিশনারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন, রাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ধর্নায় বসা – মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার মধ্যে উপুর্যপরি ঘটে গেল এ রকম একটার পর একটা বেনজির ঘটনা। ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাত সামলে ওঠা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে জনসাধারণের পক্ষে। তাই অস্থিরতা দ্রুত কাটা দরকার।
কিন্তু এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে গেছে যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কেন হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করল সিবিআই? সম্প্রতি একটি বিজ্ঞপ্তিতে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে সিবিআই কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না। সেই নির্দেশ অমান্য করে সিবিআই এবং ইডি-র অফিসারেরা সিপি-র বাড়িতে বলপূর্বক ঢোকার চেষ্টা করল কী করে? গত ২ ফেব্রুয়ারি নতুন সিবিআই ডিরেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। তারপর দিনই অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ সিবিআই অফিসারেরা গায়ের জোরে পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে। এই পরিস্থিতি প্রমান করে, সিবিআই মোদী সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চালিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই চিটফান্ড কাণ্ডে যেসব সেবি, আরবিআই এবং আরওসির অফিসারেরা দুর্ণীতিতে যুক্ত তাঁদের কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? নিদেনপক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে? উত্তরটা সবার জানা, একজনকেও নয়। যে বাম আমলে ব্যাঙের ছাতার মতো চিটফান্ড গড়ে উঠেছিল সেই বামেদের কোনও মন্ত্রী, এমএলএ বা এমপি-কে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কখনও ডাকেনি কেন? এমনকী মুকুল রায় বা হেমন্ত বিশ্বশর্মার মতো যেসব নেতার নাম এই কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে তারাও এখন বিজেপিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সিবিআই তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করছে না কেন? যত রাগ তৃণমূলের ওপর কেন?
তৃতীয়ত, বাংলা নিয়ে মোদী সরকার এবং সিবিআই-এর এই অতি সক্রিয়তার কারণ কী? সাহারা মামলা বা দিল্লীর পার্ল গ্রুপ পঞ্জী স্কিমের ক্ষেত্রে সিবিআই-এর এই অতি সক্রিয়তা কোথায় থাকে? দেশের নিরাপত্তা জড়িয়ে যে রাফাল চুক্তির সঙ্গে সেই যুদ্ধ বিমান দূর্ণীতি নিয়ে তদন্তে মোদী সরকার এমন আশ্চর্য নীরবতা পালন করছে কেন? চৌকিদারের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে?
চতুর্থত, ১৫৬(১) ধারায় সিবিআই কখনওই উপযুক্ত তথ্য প্রমান ছাড়া কাউকে জেরা করতে বা তল্লাশি চালাতে পারে না। তাহলে এক্ষত্রে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে তারা হানা দিল কী করে? এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সিবিআই রাজ্য প্রশাসনকে হেনস্থা করতে চেয়েছিল। পাশাপাশি লোকসভা ভোটের আগে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘেঁটে দেওয়াই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
পঞ্চমত, পানামা দুর্নীতি এবং প্যারাডাইস পেপার দুর্নীতি মামলায় সিবিআই একজন বিজেপি নেতাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেনি সিবিআই। বিজেপি নেতাদের দ্বারা পরিচালিত গুজরাটের একটি সমবায় ব্যাঙ্কে যে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয় এবং নোটবন্দীর পর বাংলা, বিহার এবং রাজস্থানে যে স্থাবর সম্পত্তির লেনদেন হয় সেই ঘটনার তদন্ত হল না কেন?
ষষ্ঠত, সিবিআই কর্মকর্তাদের দ্বারা ঘোষিত দুর্ণীতির মামলায় অভিযুক্ত একজন বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। কীভাবে? সেই মামলা আপাতত সুপ্রিম কোর্টে মুলতুবি রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যক্তি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ তো করেনইনি, মোদী সরকার তাঁকে বরখাস্তও করেনি। কেন? পিএমও-কে ব্ল্যাকমেল করতে পারে বলে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব মোদী সরকারেরই। এই দায়িত্বটা মোদী সরকারকেই নিতে হবে। এখনই।