খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হতে বসেছে, এই অভিযোগ তুলে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে নেমেছিলেন দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল। বসেছিলেন ধর্নায়। সেইসময় অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সিবিআইয়ের সঙ্গে সংঘাতে তাঁকে ছাপিয়ে গেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে যে ভাবে বিজেপি বিরোধী দলগুলির সমর্থন পেলেন তিনি, সাম্প্রতিককালে ভারতীয় রাজনীতিতে তা খুব কমই দেখা গিয়েছে। তাঁর ধর্নার খবর পেয়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তের বিজেপি বিরোধী দলগুলির সংহতি বুঝিয়ে দিল মোদী বিরোধী লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র মমতাই।
গতকাল সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হতেই বিজেপি বিরোধী দলগুলির প্রায় সমস্ত নেতা তৃণমূল নেত্রীর পাশে দাঁড়ান। সিবিআইয়ের সঙ্গে মমতার সংঘাতের খবর পেয়েই টুইট করেন রাহুল গান্ধী। তিনি লেখেন, ‘রাতে মমতাদির সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা ওঁর পাশে আছি। বাংলায় আজ যা হচ্ছে, তা দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর উপর মোদী এবং বিজেপির হামলার অংশ। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং এই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করেই ছাড়বে।’
দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া টুইটে লেখেন, ‘বাংলায় পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে ছুটে গিয়েছে সিবিআই। সেই থেকে কলকাতায় যা ঘটছে, তাতে বাকরুদ্ধ আমি। জরুরি অবস্থার সময় এই ধরনের অংবিধানিক আচরণ দেখেছিল দেশ। আজ বাংলায় জরুরি অবস্থার মতোই পরিস্থিতি। #সেভ ডেমোক্রেসি’। অন্যদিকে, কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া অরবিন্দ কেজরীওয়ালও তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘দেশের গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করছেন মোদীজি। কয়েক বছর আধা সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে দিল্লীর অপরাধ দমন শাখাকে আটক করিয়েছিলেন। আজ আবার এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। মোদী-শাহ জুটি ভারত এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। আজকের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি।’
জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা বলেন, ‘মমতাদিদির সঙ্গে কথা হয়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের তরফে ওঁর পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়েছি। রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির অপব্যবহার করছে মোদী সরকার। আজ তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। যিনি নিজে একসময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি তাঁর এমন আচরণে স্তম্ভিত আমি।’ যাঁর হাত ধরে কর্ণাটকে বিরোধী জোটের উত্থান শুরু, সেই এইচ ডি কুমারস্বামী টুইটারে লেখেন, ‘সংবিধানে প্রতিটি রাজ্যকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার দেওয়া হয়েছে। আজ বাংলায় তার উপর আঘাত হানা হল। আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে আছি।’
মমতার ডাকে ব্রিগেডে হাজির ছিলেন অখিলেশ যাদব। নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, ‘দেশে উৎপীড়ন চালাচ্ছে বিজেপি সরকার। সিবিআইয়ের অপব্যবহার করছে। দেশের সংবিধান ও মানুষের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে বসেছে। এই নিপীড়ণের বিরুদ্ধে যে ভাবে ধর্নায় বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে আমার। বিজেপিকে পরাজিত করতে এই মুহূর্তে একজোট দেশবাসী ও বিরোধী নেতারা।’ ব্রিগেডের মঞ্চে হাজির থাকা গুজরাতের দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবানি বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে ধ্বংস করা হচ্ছে। কলকাতায় সিবিআই লেলিয়ে দিয়েছেন মোদী-শাহ। তাঁদের এই ফ্যাসিবাদী আচরণ অঘোষিত জরুরি অবস্থার জানান দিচ্ছে। যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে সিবিআই নিশানা করেছে, সব দলের উচিত তার নিন্দা করা।’
আবার পশুখাদ্য দুর্নীতি মামলায় জেল খাটা লালুপ্রসাদ যাদব। মোদী সরকারই ষড়যন্ত্র করে তাঁকে জেলে পুরেছে বলে একাধিকবার অভিযোগ তুলেছেন তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব। সেই তিনি টুইটারে মমতার সমর্থনে লেখেন, ‘শ্রদ্ধেয় মমতাদির সঙ্গে কথা হয়েছে। দলের হয়ে সমর্থন জানিয়েছি ওঁকে। বিরোধী নেতাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও পৈশাচিক আচরণে বিশ্বাসী বিজেপি। কাল কলকাতা যেতে পারি। গত কয়েকমাস ধরে রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআইকে বিজেপি যে ভাবে ব্যবহার করেছ, তাতে সব রাজ্যকেই এমন পদক্ষেপ করতে হবে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে যে ভাবে বিজেপির জোটসঙ্গী হিসাবে কাজ করছে সিবিআই, তাতে জনসাধারণই না একদিন ওদের সব হিসাব মিটিয়ে দেয়। গণতন্ত্রে জনতার চেয়ে কেউ বড় নয়।’
ছেলের টুইট তুলে ধরে লালুপ্রসাদ যাদবের টুইটার হ্যান্ডেলে লেখা হয়, ‘বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়েছে সিবিআই। দেশবাসী তাদের বিপক্ষে। আমরা মমতাজির সঙ্গে। ভয়ঙ্কর স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। দেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি আজ সঙ্কটে। নির্বাচনে জিততে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বিজেপি।’
একসময় বিজেপির সদস্য ছিলেন। কিন্তু বিজেপির সমালোচনা করতে ছাড়েননি যশবন্ত সিনহাও। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে চান প্রধানমন্ত্রী। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছেন উনি। এবার অন্তত হঁশ ফিরুক মানুষের। নইলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।’ আবার অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু বলেন, ‘কলকাতায় যা ঘটছে, তার তীব্র নিন্দা করছি। এতেই বোঝা যায়, মোদী-শাহ জুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কীভাবে ধ্বংস করছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে বেছে বেছে বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী নেতাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। এতে দেশের চরম ক্ষতি হবে।’
একসময় বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে উপত্যকায় সরকার গড়েছিলেন মেহবুবা মুফতি। কিন্তু সে যাত্রা সুখকর হয়নি। মতভেদের জেরে শেষমেষ সরকার ভেঙে দিতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে মুখ খোলেন তিনিও। জানান, ‘পাশে আছি। ইতিহাস সাক্ষী, জম্মু-কাশ্মীরও কেন্দ্রীয় সংস্থার রোষে পড়েছে। বিরোধীদের হেনস্থা করতে যে ভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কে তা শুভ নয়।’
ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেন বলেন, ‘২০১৯-এর নির্বাচনের জন্য বাংলাকে নিশানা বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সাংবিধানিক সংস্থার অপব্যবহার করা হচ্ছে। এই লড়াইয়ে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছি।’ মমতার পাশে দাঁড়িয়েছেন এনসিপি নেতা শরদ পওয়ারও। তাঁর দাবি, ‘বাংলায় সিবিআইয়ের অপব্যবহার চলছে, যাতে বিরোধীদের মনে ভয় ধরিয়ে নির্বাচন জেতা যায়।’ তামিলনাড়ুর এমকে স্ট্যালিনও মমতার পাশে দাঁড়িয়ে টুইটারে লেখেন, ‘বিজেপি সরকারের অধীনে সব প্রতিষ্ঠানগুলির স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা হচ্ছে। গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে রক্ষা করতে আমি মমতাদি-র পাশে আছি।’
বরাবর বিজেপি বিরোধী হিসাবে পরিচিত মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার রাজ ঠাকরে। দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি জারি করে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদক্ষেপে আমাদের সমর্থন রয়েছে। ওঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ব আমরা।’ বিজেপি-নীতীশ কুমার জোট ছেড়ে পৃথক দল গড়েছেন তিনি। এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ান সেই শরদ যাদবও। তাঁর দাবি, ‘সিবিআই, ইডি-র মতো সংস্থাগুলির অপব্যবহার হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। এই সংস্থাগুলির উপর থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মমতাজির ধর্না সমর্থন করি আমি।’
অন্যদিকে বিজেপির পক্ষ নেওয়ার বদলে, রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত বলে মত শরিক দল শিবসেনার নেতা সঞ্জয় রাউতের। তিনি বলেন, ‘বাংলার মতো একটি বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি ধর্নায় বসেন, তার মানে সমস্যা গুরুতর। এটা সিবিআই বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম বিজেপি, খুব শীঘ্র জানতে পারব আমরা। সিবিআইয়ের অপব্যবহার হলে গোটা দেশের পক্ষে তা অপমানজনক। সিবিআইয়ের পক্ষেও কম অপমানজনক নয়।’ অর্থাৎ শুধু বিজেপি বিরোধী দলগুলিই নয়, শরিকরাও এই ঘটনায় একপ্রকার কেন্দ্রকেই দুষছে। ঠিক এখানেই নৈতিক পরাজয় ঘটেছে মোদী সরকারের। আর লোকসভায় তাদের হার তো এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে দেশের তাবড় তাবড় শীর্ষ নেতাদের সমর্থন পেয়ে মমতাই হয়ে উঠছে প্রধান মোদী বিরোধী মুখ।