দেশের রাজনীতি যখন ‘রাফাল যুদ্ধবিমান’, ‘কৃষক আত্মহত্যা’, ‘বিরোধী জোট’, ‘গো-রাজনীতি’, ‘বিভিন্ন সরকারি চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে উত্তাল ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএসএসও (ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস) এর অন্তর্গত পিএলএফএস (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে)র দেশের বেকারত্ব বিষয়ক একটি গোপন রিপোর্ট স্থান পেয়েছে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ। সেই রিপোর্টে ভারতে বেকারত্বের ভয়াবহতাকে তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই রিপোর্টটি প্রকাশ্যে আসার আগেই রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান কমিশনের (এনএসসি) কার্যবাহী চেয়ারম্যান পি সি মোহনন এবং কমিশনের সদস্যা জে ভি মীনাক্ষী তাঁদের আধিকারিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের মতে, গত বছরের জুন মাসেই এই রিপোর্টটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বর্তমান কেন্দ্র সরকার সেটিকে প্রকাশ্যে আনতে বাধা দিচ্ছিলো। এছাড়াও এই দুই প্রাক্তন পদাধিকারীর কথায় সরকার কর্ণপাত করছিল না বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন। যার জন্য তাঁরা ক্ষুদ্ধ হন এবং শেষ পর্যন্ত ইস্তফার রাস্তাকেই বেছে নেন। যদিও নীতি আয়োগের সহ-চেয়ারম্যান রাজীব কুমার মোহননের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, মোহনন তাঁর পদে আসীন থাকতে কোনোদিনই এ বিষয়ে তাঁর সাথে কোনো কথাই মোহনন বলেননি। তাই মোহননের ইস্তফা তাঁর নিজস্ব কারণের জন্য।
কিন্তু এখন প্রশ্নটা হলো, কি এমন আছে সেই রিপোর্টে যা নিয়ে এত হইচই? আসুন সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক:
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৭২-৭৩ সালের পর দেশে বেকারত্ব সর্বাধিক। যা খুবই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং যা অত্যন্ত গম্ভীর এবং চিন্তার বিষয়।
২০১৭-১৮ তে দেশে বেকারত্ব বিগত ৪৫ বছরের রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। শেষ এক বছরে বেকারত্বের হারকে দেখানো হয়েছে ৬.১%। গত এক বছরে দেশে ১.১ কোটি রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের সরাসরি প্রভাব বিশেষত মহিলাদের উপর পড়েছে বলেও রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও এই রিপোর্টে এরূপ ভয়াবহ বেকারত্বের জন্য নোট বাতিলকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
- গ্রামীণ এলাকায় বেকারের হার ৫.৩%
- শহর এলাকায় বেকারের হার ৭.৮%
*গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষিত মহিলাদের বেকারত্বের হার ১৭.৩%
*গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষিত পুরুষদের বেকারত্বের হার ১০.৫%
*গ্রামীন যুবতীদের বেকারত্ব বেড়েছে ২.৮ গুণ। - ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ১৫-২৯ বছর বয়সী গ্রামীণ যুবকদের বেকারত্ব ৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৪%, যা তিনগুণেরও অধিক।
- গ্রামের মহিলাদের বেকারত্বও ব্যাপক হারে বেড়েছে।
২০১১-১২ সালে যা ছিল ৪.৮% , সেটাই ২০১৭-১৮ সালে বেড়ে হয়েছে ১৩.৫% । - রিপোর্ট অনুসারে, শহরগুলিতেও বেকারত্বের ছবি খুব একটা ভালো নয়।
শহরে পুরুষদের বেকারত্ব ২০১১-১২ সাল থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ৮.১% থেকে বেড়ে ১৮.৭% হয়েছে।
শহরে মহিলাদের বেকারত্ব পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত শহরের মহিলাদের বেকারত্ব ১৩.১% থেকে বেড়ে ২৭.২% হয়েছে।
অপরদিকে, দ্য লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট (এলএফপিআর) (অর্থাৎ, রোজগারে নিযুক্ত হওয়া অথবা নতুন রোজগার খুঁজতে বেরোনো জনসংখ্যার হার) ২০১১-১২ তে ছিল ৩৯.৫% যা কমে ২০১৭-১৮ য় হয়েছে ৩৬.৯%। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে, রোজগারের সন্ধানে থাকা জনসংখ্যার হারও অনেকটাই কমেছে।
এই রিপোর্টটি জনসম্মুখে আসার পর থেকেই কেন্দ্র সরকার যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়েছে। সরকারের দাবি, মুদ্রা লোন, প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা, স্কিল ইন্ডিয়া প্রভৃতি সরকারি স্কীমের মাধ্যমে দেশে রোজগার মোটেও কমেনি বরং তা আগের তুলনায় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভয়াবহ বেকারত্ব ভারতের মতো আর্থিক মহাশক্তির পক্ষে খুবই হতাশাজনক এবং আর্থিকভাবেও তা বিপজ্জনক। এর খারাপ প্রভাব দেশের জিডিপি বৃদ্ধির উপরও পড়তে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। বেকারত্ব, নোট বাতিল নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ইতিপূর্বে অনেক রিপোর্ট প্রকাশ করলেও এনএসএসও র মতো নামকরা সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান সমন্বিত রিপোর্টটির গুরুত্ব অনেক গুণ বেশি। কিন্তু, এই রিপোর্ট যে বিরোধীদের হাতে মোদী সরকারকে নতুন করে ঘেরার চাবিকাঠি তুলে দিলো তাতে কোনো সন্দেহই নেই। রিপোর্টটি জনসম্মুখে আসার পরপরই বিরোধীরা সরব হন। বিরোধীদের বক্তব্য, তাঁরা এই গম্ভীর বিষয়টি নিয়ে বহুদিন যাবৎ আওয়াজ তুলছেন কিন্তু সরকার তাঁদের কথায় কোনোদিনই কর্ণপাত করেনি বরং উল্টে সরকার জনগণকে সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিয়েছে। কিন্তু এবার এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসায় দেশের জনগণ সরকারকে এর পাল্টা জবাব দেবে বলেও তাঁরা দাবি করেন।
দেশে লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। এখন শুধু এটাই দেখার যে এই রিপোর্ট নির্বাচনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতটা প্রভাব ফেলে। উল্লেখ্য যে, ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনে রোজগারের সন্ধানে থাকা ৩৪% বেকার যুবক-যুবতী বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন।