ব্রিগেডে ১৯শের ঐতিহাসিক মহাসমাবেশের মঞ্চে এবার উঠে আসবে আগামী ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আজ থেকে ৪১বছর আগে ৭৭এর ব্রিগ্রেডের সমাবেশের মঞ্চে ছিল জয়প্রকাশ নারায়ণ, বাজপেয়ী, বসু সহ দেশের তাবড় নেতাদের দাপট। কিন্তু এবারের মঞ্চ যেন দেশের তরুণ ও তরুণতর নেতৃত্বের আবাহনের জন্য তৈরি করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, হার্দিক প্যাটেল, জিগনেশ মেওয়ানি, অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কে এম স্ট্যালিন, কুমারস্বামী, বদরুদ্দিন আজমল, ওমর আবদুল্লার মত তরুণ নেতারা এই মহাসমাবেশে ঘোষিত বিজেপি বিরোধী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেশের রাজনীতির একেবারে সামনের সারিতে এসে দাঁড়াবেন। এবারের সমাবেশে এই ব্যাপারটা আমার খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। সত্যিই, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই তো উঠে আসে পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব।
এই মহাসমাবেশ আরেকটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চার দশক পর ব্রিগেডে মহাসমাবেশের আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব। প্রবীণ নেতাদের মধ্যে সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন এইচ ডি দেবগৌড়া, চন্দ্রবাবু নাইডু, মায়াবতী, ফারুক আবদুল্লা, যশোবন্ত সিনহা, শারদ পাওয়ার, অজিত সিং, শত্রুঘ্ন সিনহা প্রমুখ। কোন পদ নয়, আসন নয়, কে কতটা গুরুত্ব বা ক্ষমতা পাবেন তা নিয়ে আকছাআকছি নয় এই মহাসমাবেশের একটাই আওয়াজ তা হল দেশ বাঁচাতে, গরিব মানুষদের বাঁচাতে বিজেপির অপশাসনের অবসান ঘটাতেই হবে। ৭৭-এর বিরোধী জোটের সূচনা হয়েছিল বাংলা থেকে। এবারও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সর্বভারতীয় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার মাটিতে বিজেপি বিরোধী মহাজোটের পথ চলা শুরু হল।
সমাবেশের মঞ্চ থেকে সর্বভারতীয় বিরোধী নেতৃত্ব দেশের মানুষের কাছে বার্তা দেবেন বিজেপি তোমাদের দিন শেষ, বিরোধীরা এখন ঐক্যবদ্ধ এবং কুৎসা, প্রলোভন ও টাকা ছড়িয়ে এই ঐক্য ভাঙা যাবে না। দেশ বাঁচাতে, ধর্মীয় বিভাজন ছড়িয়ে দাঙ্গা রুখতে; গরীব মানুষদের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ রুখতে; মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পপতির হাতে দেশের ভবিষ্যৎ রুখতে লড়াই গড়ে তোলার দিশা দিতেই বিরোধী নেতারা এই সমাবেশে আসছেন।
না এলে তারা জাতীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন। এই সমাবেশ একটা সময়ের দাবী। এতে না এলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হত। দেশের বিরোধী নেতারা ঠেকে শিখে এখন বুঝতে পেরেছেন তাদের নিজেদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য থাকতেই পারে কিন্তু বিজেপির বিভেদপন্থা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করার জনবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে সেসব ভুলেই একসঙ্গে লড়তে হবে। এটাই সময়ের দাবী। আর এই কাজটা এখন না করতে পারলে দেশে গণতন্ত্রের নুন্যতম পরিসরটুকুই থাকবে না। এই সত্যটুকু বুঝতে পেরেছেন বলেই উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ, মায়াবতীরাও নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে বিজেপি বিরোধী জোটে সামিল হয়েছেন। আমার খুব ভালো লাগছে আজ থেকে প্রায় বছরখানেকের বেশি আগে থেকে আমাদের দিদি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একথাটাই দেশের সব বিরোধী নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মহাজোটের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে তিনি নিজে তাদের কাছে পৌঁছেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে এই মহাসমাবেশকে ঘিরে যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে তার অনুঘটকের কাজটা কিন্তু দিদিই করেছেন। মহাজোটের ভাবনাটাও কিন্তু প্রথমে তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল।
জাতীয় রাজনীতির এই বাস্তবতা সিপিএমসহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই তাদের দল ও দেশের মঙ্গল। অন্ধ মমতা বিরোধিতা এবং রাজ্যের শাসনক্ষমতা চলে যাওয়ার দুঃখ সিপিএম এখনও ভুলতে পারেনি। তাই তারা এই মঞ্চে আসতে অস্বীকার করলো রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে। মুখে তারা বিজেপি বিরোধিতার কথা বললেও তাদের কাজকর্ম কিন্তু বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে। বাম নেতারা বলেন, মমতা বিজেপির বি টিম। আমার প্রশ্ন বামপন্থীরা বিজেপিকে রোখার জন্য এখনও অব্দি ঠিক কী কী করেছেন? আমি জানি এ প্রশ্নের কোন উত্তর আসবে না। বাংলার কংগ্রেস নেতাদের অবস্থানটা আরও অদ্ভুত! দিল্লিতে তাদের সর্বভারতীয় নেত্রী সনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধী বিজেপির বিপদ বুঝতে পেরেছেন বলেই এই জোটে এসেছেন। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে নারাজ। কারণ, মমতা বিরোধিতা ছাড়া তাদের আর কোন রাজনীতি নেই। যে কোন মূল্যে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বজায় রাখতে চান।
এ কাজ করা মানে যে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসকে পিছনে টেনে রাখা এটুকু বোঝার বুদ্ধিও তাদের নেই। অথচ নানা প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও ব্রিগেড সমাবেশে মল্লিকার্জুন খাড়গেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেস বার্তা দিয়েছে তারা এই মহাজোটের সঙ্গে আছে। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী-অখিলেশরা কংগ্রেসকে জোটে না নিলেও রাহুল কিন্তু মহাজোটের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। অন্যদিকে প্রদেশ কংগ্রেসের রাজনীতি যে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে তা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন কিনা আমি জানিনা।
ভিড়, আয়োজন ইত্যাদি ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে ডাকা ব্রিগেডের বিরোধী দলগুলির এই মহাসমাবেশ আগেকার সমাবেশগুলিকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু আমার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল বাংলা থেকেই বিজেপির কফিনে শেষ পেরেকটি পোতার কাজ শুরু হল। আবার প্রমাণিত হল বাংলা আজ যা ভাবে কাল সারাদেশ তা ভাবে।
ব্রিগেডের মহাসমাবেশকে নিয়ে নানা বিশ্লেষণ ও আলোচনা নিশ্চয় হবে। আমি শুধু ভাবছি কালীঘাটের আদিগঙ্গার ধারে বাস করা একটা সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কথা। নিজের কোন স্বার্থের কথা না ভেবে একটি মহাজোট ও মহাসমাবেশকে তিনি আস্তে আস্তে রূপ দিয়েছেন। আজ সারা দেশের বিরোধী রাজনীতি তা গ্রহণ করেছে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে দেখেছি মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদকে তিনি কীভাবে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। বঞ্চিত মানুষগুলির অবস্থা আজ বদলে গেছে। দেশজোড়া বিজেপি বিরোধী লড়াই দেশের রাজনৈতিক চিত্রটাকেই বদলে দেবে। ভোটে হেরে বিদায় নিতে হবে বিজেপিকে। দেশের মানুষ কোন ধর্মান্ধতার তোয়াক্কা না করে নির্ভয়ে বাঁচবে। কোন মানুষকে দেশ থেকে অন্যায়ভাবে তাড়ানোর জিগির উঠবে না। দেশ এগোবে নির্বিঘ্নে। এটুকুতেই আমাদের দিদির সুখ। আমি নিশ্চিত সমাবেশের শেষে দিদির মুখে আমি একটা তৃপ্তির হাসি দেখবো।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )